নাগিন পাহাড় ধ্বংস করে ৮০টি বহুতল ভবন, শতাধিক প্লট
দেড় লাখ বর্গফুট আয়তনের নাগিন পাহাড়ের দুই-তৃতীয়াংশ কেটে গত দুই দশকে গড়ে তোলা হয়েছে দুটি আবাসিক এলাকা। পাহাড়ের বুক চিরে গড়ে ওঠা এই আবাসনের নাম দেওয়া হয়েছে গ্রিনভ্যালি হাউজিং-১ ও ২, যেখানে ইতোমধ্যেই ৮০টি বহুতল ভবন ও শতাধিক কাঁচাবাড়ি উঠেছে। আবাসনের নামে এখনো সেখানে চলছে পাহাড় কাটা।
চট্টগ্রাম নগরের বায়েজিদ বোস্তামি এলাকার টেক্সটাইল গেট থেকে পাঁচ মিনিট দূরত্বের এই স্থানটিতে জমি ও ফ্ল্যাট ক্রেতাদের চাহিদা বিপুল। এ চাহিদাকে সামনে রেখে আবাসন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও সেখানে ব্যক্তিপর্যায়ে গড়ে উঠেছে অসংখ্য বহুতল ভবন।
সম্প্রতি 'নাগিন পাহাড়' কেটে স্থাপনা নির্মাণের প্রমাণ পেয়ে গ্রিনভ্যালি হাউজিং-১ ও ২ আবাসিক এলাকার ৪৯ জন বাড়ির মালিককে ৬৪ লাখ ৭৮ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। এছাড়া প্রায় এক লক্ষ ৮২ হাজার ৮৭৫ ঘনফুট পাহাড় কেটে ফেলার অভিযোগে ১০ জনের বিরুদ্ধে নগরের বায়েজিদ বোস্তামি থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে।
শুক্রবার (০৮ অক্টোবর) সকালে গ্রিনভ্যালি-১ আবাসিক এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, আবাসিকের শেষ প্রান্তের ৭ নম্বর সড়ক তৈরির জন্য পাহাড় কাটার চিহ্ন পুরোপুরি সাম্প্রতিক সময়ের। সেই সড়কে একপাশে খাড়াভাবে কাটা হয়েছে 'নাগিন পাহাড়'। ঠিক তার উল্টো পাশেই এক সারিতে গড়ে তোলা হয়েছে ৭টি বহুতল ভবন।
একই ভাবে গ্রিনভ্যালি হাউজিং-১ আবাসিক এলাকার ১, ৪, ও ৭ নম্বর সড়কের প্রায় প্রতিটি বাড়ি তৈরির জন্য পাহাড়ের মাটি কাটা হয়েছে। পাহাড় কেটে তৈরি হয়েছে স্কুল-মাদ্রাসাও। এছাড়া পাহাড়ের পাদদেশেও বাড়ি তৈরি করে বসবাস করছে কয়েকটি পরিবার।
গ্রিনভ্যালি হাউজিং-২ এর জন্য নাগিন পাহাড়ের দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিম অংশটি কেটে একেবারে খাড়া করে ফেলেছে ভূমিদস্যূরা। সেই পাহাড়ের ঢালেই গড়ে উঠেছে শতাধিক কাঁচাবাড়ি, যেখানে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাস করছে নিম্ন আয়ের মানুষ। পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ এই বসবাস হয়ে উঠতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনার কারণ।
নাগিন পাহাড়ের কোল ঘেষেই ফিরোজ আহমদের বাড়ি। ২৬ সেপ্টেম্বর পাহাড় কাটার দায়ে তাকে দুই লাখ টাকা জরিমানা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। জরিমানা গুনেও সেই বাড়িতে ঝুঁকি নিয়েই বসবাস করছে তার পরিবার।
ফিরোজ আহমদের দাবি, তিনি দশ বছর আগে সমতল জমি কিনেছেন। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তর তাকে পাহাড় কাটার জন্য অভিযুক্ত করছে।
গ্রিনভ্যালি হাউজিং-২ এর জমি মালিক মো. তৌয়বুর রহমানের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ি লাগোয়া পাহাড় কেটে প্রায় দ্বিগুণ জমি দখল করেছেন তৌয়বুর। এ বিষয়ে কথা বলতে তার বাড়িতে প্রবেশের চেষ্টার করলে কয়েকজন যুবক প্রতিবেদককে বাধা দেন।
তবে পাশের বাড়ির সোনিয়া বেগম বলেন, "এখানে আমার স্বামীর জায়গা আছে। আমরা কোনো পাহাড় কাটছি না। পাহাড় কে কাটছে জানি না।"
পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, নাগিন পাহাড়ের পূর্ব-দক্ষিণ পাশে গ্রিনভ্যালি হাউজিং- ২ এ ১২ হাজার ৯৬০ বর্গফুট পাহাড় কেটে ১১ তলা ভবন করেছেন মো. হাবিবউল্লাহ বাহার ও নাসির উদ্দিন। ৮৭৫ বর্গফুট পাহাড় কেটেছেন খোকন শিকদার, পূর্ব উত্তর পাশে ২ হাজার ৩৫০ বর্গফুট পাহাড় কেটে ৮ তলা ভবন করেছেন সাইফুল আলম সুমন, ১,৫০০ বর্গফুট পাহাড় কেটে ৫ তলা ভবন নির্মাণ করেছেন নুরুল আলম, ৩ হাজার বর্গফুট পাহাড় কেটে ৭ তলা ভবন নির্মাণ করেছেন মোহাম্মদ ইছা খান।
৬০০ বর্গফুট পাহাড় কেটে দুটি স্থাপনা নির্মাণ করেছেন মোহাম্মদ শফি উল্লাহসহ ছয়জন, এক হাজার বর্গফুট পাহাড় কেটে চারতলা ভবন করেছেন শহিদ উল্লাহ এবং পাহাড়ের পূর্ব-দক্ষিণ পাশে ১,৪০০ বর্গফুট পাহাড় কেটে ১৩টি ঘর নির্মাণ করেছেন মোতাহের হোসেন, এক হাজার ৫০০ বর্গফুট পাহাড় কেটে ১২টি টিনশেড ঘর স্থাপনা করেছেন নুরুল ইসলাম।
এ বিষয়ে কথা বলতে গ্রিনভ্যালি হাউজিং-এর সভাপতি আজিম উদ্দিনের বাড়িতে (৪ নং সড়ক) গিয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি এই প্রতিবেদকের সঙ্গে দেখা করেননি।
পরিবেশ অধিদপ্তর মহানগর কার্যালয়ের উপপরিচালক মিয়া মাহমুদুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "মানুষ প্রকৃতিকে ধ্বংস করছে। বছরের পর বছর ধরে কেটে প্রায় দেড় লাখ বর্গফুট আয়তনের একটি পাহাড়কে কেটে পুরোপুরি বিলীন করার পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে। আমরা স্থানীয়দের কাছ থেকে জেনেছি, এই নাগিন পাহাড়ের আশপাশে আরো বেশ কয়েকটি পাহাড় ছিল। কিন্তু ভূমিদস্যুরা সেসব পাহাড়কে শেষ করে দিয়েছেন। তাই আমরা নাগিন পাহাড়কে রক্ষা করতে সব ধরনের চেষ্টা করছি।"
তবে পরিবেশবিদরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের পদক্ষেপগুলো প্রশংসনীয় হলেও সক্ষমতার তুলনায় তাদের আওতাধীন এলাকা অনেক বড়। তাছাড়া নমনীয় পরিবেশ আইন ও যথাযথ তদারকির অভাবও চট্টগ্রামে অবাধে পাহাড় কাটার অন্যতম কারণ।
২০১১ সালে চট্টগ্রামের পাহাড় কাটা নিয়ে 'হিল কাটিং ইন অ্যান্ড অ্যারাউন্ড চিটাগং সিটি' শীর্ষক একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, বেশিরভাগ পাহাড় কাটা হয় পাহাড়তলী, খুলশী, বায়েজিদ, লালখান বাজার মতিঝর্ণা, ষোলশহর এবং ফয়'স লেকে।
১৯৭৬ থেকে ৩২ বছরে চট্টগ্রাম নগর ও আশেপাশের ৮৮টি পাহাড় সম্পূর্ণ এবং ১৯৫টি আংশিক কেটে ফেলা হয় বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়। ১৯৭৬ সালে নগরের পাঁচ থানা এলাকায় মোট পাহাড় ছিল ৩২ দশমিক ৩৭ বর্গকিলোমিটার। ২০০৮ সালে তা কমে হয় ১৪ দশমিক ০২ বর্গকিলোমিটার। এ সময় ১৮ দশমিক ৩৪৪ বর্গকিলোমিটার পাহাড় কাটা হয়। এটা মোট পাহাড়ের প্রায় ৫৭ শতাংশ। নগরের বায়েজিদ, খুলশী, পাঁচলাইশ, কোতোয়ালি ও পাহাড়তলী থানা এলাকায় এসব পাহাড় কাটা হয়। সবচেয়ে বেশি ৭৪ শতাংশ কাটা পড়ে পাঁচলাইশে।
চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ের পরিচালক মোহাম্মদ নূরুল্লাহ নূরী বলেন, "পাহাড় কাটার অভিযোগের সত্যতা পেলে প্রতি বর্গফুটে ৫০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ এক হাজার টাকা হারে জরিমানার বিধান রয়েছে।"
"একবার জরিমানা আদায় করার পরেও দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ভবিষ্যতে পাহাড় কাটার অভিযোগ প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও সতর্ক করে দেওয়া হচ্ছে। পরপর কয়েকবার আদেশ অমান্য করলে বা শুনানিতে হাজির না হলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। কিন্তু এসব মামলার নিষ্পত্তি হতে পাঁচ থেকে ১০ বছর সময় লেগে যায়," বলেন মোহাম্মদ নূরুল্লাহ নূরী।