বরিশাল-কুয়াকাটা মাত্র ২ ঘণ্টায়, যান চলাচলের জন্য আজ খুলে দেওয়া হচ্ছে লেবুখালী সেতু
বরিশাল থেকে পটুয়াখালীর কুয়াকাটাগামী যাত্রীদের চারটি পয়েন্টে ফেরি করে নদী পার হতে হতো, এতে অনেক সময় লেগে যেতো। কিন্তু গত ১০ বছরব্যাপী নির্মিত চারটি সেতু এখন থেকে এই রুটে ভ্রমণের সময় কমিয়ে দেবে।
আগে বরিশাল থেকে কুয়াকাটা ভ্রমণে প্রায় ৭ থেকে ১২ ঘন্টা সময় লাগত। পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলায় শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল সেতু নির্মাণের পর এ যাতায়াতের সময় কমে ৫-৭ ঘণ্টা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ এ রুটের চতুর্থ সেতুটি উদ্বোধন করবেন।
এর ফলে বরিশাল থেকে কুয়াকাটা ভ্রমণের সময় প্রায় দুই ঘণ্টায় কমে আসবে বলে জানিয়েছে বরিশালের বাস ও মিনিবাস মালিক সমিতি।
লেবুখালী সেতু সম্পন্ন হলে পটুয়াখালীর পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর দিয়ে সরাসরি সংযোগ সড়ক যোগাযোগ স্থাপন করা হবে।
এই পরিবহন ব্যবস্থা স্থানীয় কৃষক, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি এবং পর্যটন অপারেটরদের জন্যও নতুন সুযোগ সৃষ্টি করবে। উন্নত চিকিৎসাসেবা সহ যেসব স্থানীয়দের নানান উদ্দেশ্যে বরিশাল শহরে যাতায়াত করতে হয়, তারাও এতে উপকৃত হবেন।
লেবুখালী সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৬ সালের ২৪ জুলাই। চার লেনের এই সেতুর দৈর্ঘ্য ১ দশমিক ৪৭ কিলোমিটার, প্রস্থ ১৯ দশমিক ৭০ মিটার। সেতুর উভয় পাশে ৭ কিলোমিটার জুড়ে নির্মাণ করা হয়েছে সংযোগ সড়ক। সেতু বিভাগ জানিয়েছে, চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান লংজিয়ান রোড অ্যান্ড ব্রিজ কোম্পানি লিমিটেড ১,৪৪৪ কোটি টাকা ব্যয়ে সেতুটির নির্মাণকাজ করেছে।
বাণিজ্যের সম্প্রসারণে সেতুর অবদান
কুয়াকাটা ও বরিশাল সংযোগ সড়কের দু'পাশে ইতোমধ্যে বিভিন্ন কোম্পানি ও কারখানা জমি কিনেছে।
বরিশাল বিসিক শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি মিজানুর রহমান বলেন, "সেতুগুলোর মাধ্যমে বরিশাল, পায়রা বন্দর ও মোংলা বন্দরের মধ্যে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপন হওয়ায় এখানে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। আমরা বরিশাল থেকে পণ্য আমদানি ও রপ্তানির আরও ভালো সুযোগ পাব"।
ফরচুন গ্রুপের চেয়ারম্যান মিজান বলেন, "এই সড়ক ও সেতু বরিশালে বাণিজ্যের লাইফলাইন হয়ে উঠবে"।
পটুয়াখালীর জেলেরা আশপাশের নদী ও সাগর থেকে মাছ ধরে বরিশাল বিভাগের সবচেয়ে বড় মাছের বাজার কলাপাড়ার মহিপুরে বিক্রি করে। সেতু চারটির কাজ সম্পন্ন হলে জেলেরা তাদের মাছগুলো ভাল দামে বিক্রি করতে এবং দ্রুত দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাঠাতে সক্ষম হবে।
পটুয়াখালীর কলাপাড়ার জেলে শাহজাহান বলেন, "সেতু নির্মাণের আগে আমাদের ট্রলার বা অন্য কোন নৌযানে করে মাছ পরিবহন করতে হতো, এতে অনেক সময় লাগত। তাছাড়া অনেক রুটে মাছ পাঠানোও যেতো না"।
বরিশাল মৎস্য অধিদপ্তরের বিভাগীয় পরিচালক আনিসুর রহমান বলেন, "এটি দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জন্য একটি ঐতিহাসিক উন্নয়ন। বিশেষ করে, আমাদের জেলেরা অনেক উপকৃত হবেন কারণ তাদের আর শুধু স্থানীয় বাজারের ওপর নির্ভর করে থাকতে হবে না। তারা ন্যায্যমূল্যে শহরের বিভিন্ন বাজারে মাছ পাঠাতে পারবেন"।
সহজ পরিবহন ব্যবস্থার কারণে জেলেরা সব ধরনের মাছেই অন্তত ১০ থেকে ২০ টাকা বেশি লাভ করতে পারবেন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
পাশাপশি উর্বর উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষকেরাও সেতুর মাধ্যমে উপকৃত হবেন কারণ এর মাধ্যমে তারা তাদের পণ্য দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠাতে সক্ষম হবেন।
পটুয়াখালীর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক একেএম মহিউদ্দিন বলেন, "উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে আমরা এখন অল্প সময়ের মধ্যেই কৃষকদের জন্য সার ও বীজ পরিবহন করতে পারছি"।
তিনি বলেন, "কৃষকেরা এখানে প্রচুর পরিমাণে আমন ধান, ডাল এবং সবজি চাষ করে। এখন ফসলের বিক্রি এবং দাম দুটোই বৃদ্ধি পাবে, যা কৃষকদের আরও অধিক পরিমাণে ফসল ও সবজি চাষে অনুপ্রাণিত করবে"।
এদিকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক জ্যোতির্ময় বিশ্বাস বলেন, "এই সেতুর কারণে এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিকশিত হতে চলেছে। দ্রুত যোগাযোগ সুবিধার কারণে পুরো অর্থনীতির উন্নয়ন হতে চলেছে।"
তিনি আরও বলেন, সেতুগুলো দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের দেশের জিডিপিতে সরাসরি ভূমিকার পথ প্রসারিত করবে।
এছাড়াও এসব সেতুর মাধ্যমে পর্যটন ব্যবসা চাঙ্গা হয়ে উঠবে।
পটুয়াখালীর কুয়াকাটা ও টেংরাগিরি ইকো পার্ক এবং বরগুনার শুভসন্ধ্যা সমুদ্র সৈকতের মতো তিনটি পর্যটন স্পটকে সড়কপথে যুক্ত করবে সেতুগুলো।
কুয়াকাটা হোটেল মোটেল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোতালেব হোসেন বলেন, "আমরা আশাবাদী, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে খুব শীঘ্রই এই অঞ্চলে আসা মানুষের সংখ্যা দ্বিগুণ বৃদ্ধি পাবে।"
উন্নত চিকিৎসার সুযোগ বৃদ্ধির আশা
বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য প্রশাসনের পরিচালক ডা. বাসুদেব কুমার দাস বলেন, "সঙ্কটজনক রোগীদের অল্প সময়ের মধ্যে উপকূলীয় অঞ্চলের গ্রামসমূহ থেকে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা যাবে, যার ফলে তাদের জীবন রক্ষা পাবে।"
এর আগে, চারটি ফেরি পারাপারের কারণে উপকূলীয় এলাকা থেকে অনেক গুরুতর রোগীই হাসপাতালে পৌঁছাতে পারতো না। কখনও কখনও কলাপাড়া থেকে বরিশাল পৌঁছতে একটি অ্যাম্বুলেন্সের দশ ঘণ্টা সময়ও লেগে যেত, ফলশ্রুতিতে অনেক রোগী পথেই মারা যেত।