ভ্যাকসিনের জন্য চীন, রাশিয়ার দিকে ঝুঁকছে সরকার
চুক্তি অনুযায়ী ভারত থেকে ভ্যাকসিন না পাওয়ায় ভ্যাকসিন সংকট মেটাতে চীন ও রাশিয়ার ভ্যাকসিন আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
আজ সোমবার প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক উচ্চ পর্যায়ের সভায় এই দুটি দেশ থেকে ভ্যাকসিন আমদানির বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম।
এছাড়া, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা উদ্ভাবিত কোভিশিল্ড এবং জনসন অ্যান্ড জনসনসহ ২-৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা যায় এমন ভ্যাকসিন কিনতে আন্তর্জাতিক টেন্ডার আহ্বান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। প্রস্তাবিত টেন্ডারের বিভিন্ন শর্ত ও ডকুমেন্ট চূড়ান্ত করার কাজ চলছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, চীনের সিনোফার্ম তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে বাংলাদেশকে ৬০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন সরবরাহের প্রস্তাব পাঠিয়েছে। এছাড়া, রাশিয়ার উদ্ভাবিত স্পুটনিক ফাইভ আমদানি করে সরকারকে সরবরাহ করার আগ্রহ দেখিয়ে প্রায় তিন মাস আগেই তৃতীয় পক্ষ হিসেবে একাধিক কোম্পানি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে।
পাশাপাশি কোভ্যাক্স থেকে মে মাসের প্রথমার্ধে কিছু টিকা পাওয়ার আশা করছে সরকার। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট টিকা সরবরাহ বন্ধ করলেও দক্ষিণ কোরিয়া থেকে অক্সফোর্ডের টিকা সংগ্রহ করছে কোভ্যাক্স।
সেখান থেকে বাংলাদেশ ভ্যাকসিন পেলে চলমান টিকাদান কর্মসূচি অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে মনে করছে সরকার।
এদিকে, চুক্তি অনুযায়ী সরকারকে টিকা সরবরাহ করতে গত শনিবার বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যাল ও ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটকে চিঠি দিয়ে তাগাদা দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক।
চিঠিতে গত মার্চ মাসের ৫০ লাখ ডোজের সঙ্গে এপ্রিলের ৫০ লাখ ডোজসহ মোট এক কোটি ডোজ ভ্যাকসিন চলতি মাসেই সরবরাহ করতে বলেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এছাড়া, মে ও জুন মাসের নির্ধারিত এক কোটি ডোজও সময়মত সরবরাহ করতে প্রতিষ্ঠান দু'টিকে তাগাদা দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশকে ৬ কোটি ৮০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন সরবরাহ করার কথা রয়েছে কোভ্যাক্সের। এর মধ্যে প্রথম চালানে মার্চের শেষ দিকে ১ কোটি ২৮ লাখ ডোজ পাওয়ার কথা ছিল বাংলাদেশের। ভারত রপ্তানি বন্ধ করার পর কোভ্যাক্সও টিকার সংকটে পড়েছে। ফলে বাংলাদেশকে টিকা দেওয়ার সময় এক মাস পিছিয়ে মে মাসের প্রথম সপ্তাহ নির্ধারণ করেছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা সত্বেও সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে টিকা সংগ্রহে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে কোভ্যাক্স। চুক্তি অনুযায়ী কোভ্যাক্সকে টিকা না দেওয়ায় কোভিশিল্ডের উদ্ভাবক অ্যাস্ট্রাজেনেকা গত ৮ এপ্রিল সিরাম ইনস্টিটিউটকে নোটিশ পাঠিয়েছে।
আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও কোভিড-১৯ টিকা বিতরণ ও প্রস্তুতি কমিটির সদস্য ডা. এ এস এম আলমগীর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন,
'প্রথম ডোজ অব্যাহত রেখে সেকেন্ড ডোজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য কোভ্যাক্সের মাধ্যমেও অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন পাওয়ার চেষ্টা করছি আমরা।
'কোভ্যাক্স সিরামের পাশাপাশি দক্ষিণ কোরিয়া থেকেও অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন নিচ্ছে। আমরা সেই ভ্যাকসিনটি পাওয়ার চেষ্টা করছি। সেটা যদি মে মাসের মাঝামাঝি সময়েও পাওয়া যায়, তাহলেও আমাদের ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রমে কোন সমস্যা হবে না,' যোগ করেন তিনি।
এ এস এম আলমগীর বলেন, সরকার ওপেন টেন্ডারের মাধ্যমে আরও তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন কিনবো। ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় যেসব ভ্যাকসিন রাখা যায় সেসব কোম্পানি টেন্ডারে অংশ নিলে তাদের অগ্রাধিকার দেয়া হবে।
চুক্তি অনুযায়ী ফেব্রুয়ারির বাকি ৩০ লাখ ডোজ ও মার্চ ও এ্রপ্রিলের ৫০ লাখ করে ডোজ এখনো পায়নি বাংলাদেশ।
গত মাসে ভারত সরকার ভ্যাকসিন রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ওই নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। বাংলাদেশের চাহিদা অনুযায়ী ভ্যাকসিন সরবরাহ করার বিষয়ে ভারত সরকার নিশ্চয়তা দিয়েছে।
গতকাল রোববার এ বিষয়ে সালমান এফ রহমানের বক্তব্য জানতে তার মোবাইল ফোনে একাধিক এসএমএস ও কল করা হলেও তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
তবে বেক্সিমকোর একজন কর্মকর্তা জানান, "ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের কর্মকর্তারা বাংলাদেশকে চাহিদা অনুযায়ী ভ্যাকসিন সরবরাহের বিষয়ে নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন। কিন্তু তারা সে কথা রাখছেন না। তাই আমাদের এখন কিছু করার নেই।"
"সেরাম ইনস্টিটিউট বাংলাদেশকে ভ্যাকসিন দিতে রাজি থাকলেও ভারত সরকারের নিষেধাজ্ঞার কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, বেক্সিমকো ও সেরামের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তিতেও ভারত সরকারের অনুমোদন ছাড়া ভ্যাকসিন আমদানি করা যাবে না বলে উল্লেখ আছে," যোগ করেন তিনি।
৭ ফেব্রুয়ারি থেকে দেশব্যাপী টিকাদান কার্যক্রম শুরু হয়। এখন পর্যন্ত প্রথম ডোজ ভ্যাকসিন নিয়েছেন ৫৭.১৪ লাখ মানুষ। আর ৭ এপ্রিল থেকে সেকেন্ড ডোজ ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু হয়েছে। এখন পর্যন্ত সেকেন্ড ডোজ ভ্যাকসিন নিয়েছেন ১.৩৬ লাখ মানুষ।
বাংলাদেশের হাতে এখন ১ কোটি ২ লাখ ডোজের মধ্যে মাত্র ৩১.১৯ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন রয়েছে। এখন প্রতিদিন গড়ে দেড় লাখের বেশি মানুষ ভ্যাকসিন নিচ্ছেন। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ২০-২২ দিনের মধ্যে ভ্যাকসিন শেষ হয়ে যাবে।
ডা. এ এস এম আলমগীর বলেন,"ফার্স্ট ডোজ এখন কম দেওয়া হচ্ছে। সেকেন্ড ডোজ যে হারে যাচ্ছে মে মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত দিতে পারবো। এর মধ্যে আমরা অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন আনার চেষ্টা করছি। এছাড়া সেকেন্ড ডোজ ভ্যাকসিন ৮ সপ্তাহ থেকে তিন মাসের মধ্যে দেয়া যায় তাই তিন মাস বিরতির মধ্যে আমরা ভ্যাকসিন পাওয়ার চেষ্টা করছি।"
এদিকে, বিশ্বের সর্ববৃহৎ টিকা সরবরাহকারী দেশ ভারতও ভ্যাকসিন সংকটে পড়ে স্পুটনিক ফাইভ আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে। কোভিড ভ্যাকসিনের কাঁচামাল রপ্তানিতে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ও কাঁচামাল রপ্তানিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কঠোরতার কারণে বিশ্ব বাজারের ৬০ শতাংশ টিকা সরবরাহকারী দেশটি সক্ষমতা অনুযায়ী ভ্যাকসিন উৎপাদন করতে ব্যর্থ হচ্ছে।