সংখ্যায় বাড়লেও মধ্যবিত্ত এখন আলাদা শ্রেণি হিসাবে বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে: পিপিআরসি
দেশে অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে মধ্যবিত্তের সংখ্যা। নতুন মধ্যবিত্তদের কল্যাণে ভোক্তা শ্রেণি সৃষ্টি হয়েছে। মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধিও বাড়ছে। তবে আলাদা একটি শ্রেণি হিসাবে মধ্যবিত্তদের পরিচিতি বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ন্যায় প্রতিষ্ঠায় বঞ্চিত, গরিব ও মেহনতি মানুষের পক্ষে এক সময় শক্ত অবস্থান ছিল মধ্যবিত্তদের। রাজনীতিতে বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বেও এগিয়ে ছিল মধ্যবিত্তরা। জীবনধারণের প্রয়োজনে এই মধ্যবিত্তরা এখন সমাজ গঠনে ভূমিকা পালন থেকে তারা বিরত রয়েছে।
পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) আয়োজনে অনুষ্ঠিত 'আজকের এজেন্ডা' শীর্ষক আলোচনায় এসব বিষয় উঠে আসে। দেশের অর্থনীতির রূপান্তর নিয়ে বিশেষজ্ঞদের এ সিরিজ আলোচনার পঞ্চম পর্বের শিরোনাম ছিল 'সমাজের টার্নিং পয়েন্ট: মধ্যবিত্তরা কোথায় গেল?' অনলাইনে অনুষ্ঠিত হয় এ আলোচনাসভা।
আলোচনায় অর্থনীতিবিদ ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, 'অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিকসহ বিভিন্ন বিবেচনায় মধ্যবিত্তদের আলাদাভাবে সঙ্ঘায়িত করা যায়। গত ২০-৩০ বছরে দেশে দারিদ্র্যের হার দ্রুত কমেছে। ফলে মধ্যবিত্তের আকার বেড়েছে। দারিদ্র্য হারের পাশাপাশি বিভিন্ন আর্থসামজিক সূচক পর্যালোচনায় দেখা যায়, বাড়িঘরের চেহারার উন্নতি হয়েছে। নিজস্ব টেলিভিশন, বাইসাইকেল, মোটর সাইকেলের ব্যবহারও বেড়েছে।'
তিনি বলেন, 'নিম্ন মধ্যবিত্তরা সামাজিক মান-সম্মানে গুরুত্ব দেওয়ায় তারা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর বাইরে থাকেন। নিত্যপণ্যের মূল্য তাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়।'
তিনি আরও বলেন, 'গরিব মানুষেরা জীবনধারণের মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যস্ত। তাদের তুলনায় নিম্ন মধ্যবিত্ত থেকে উপরের দিকের লোকজন কিছুটা বেশি রাজনৈতিক সচেতন হতে পারেন। এ কারণেই মধ্যবিত্ত শ্রেণির আকার না বাড়া পর্যন্ত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুদৃঢ় হয় না।'
অনেকটা আক্ষেপ প্রকাশ করে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, 'বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব দিতে সক্ষম মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তারা নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন না দুর্বল হয়ে গেছেন, এ বিষয়ে প্রশ্ন রয়েছে।'
তিনি বলেন, 'সমাজে জ্ঞানমনষ্ক মধ্যবিত্তের সংখ্যা কি কমে গেছে? তাদের নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতায় দুর্বলতা আছে। যতটুকু চর্চা হচ্ছে, তার গুণগত মানও নিশ্চিত হচ্ছে না।'
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ আরও বলেন, 'উপনিবেশ যুগের পরে স্বাধীন দেশগুলোতে মধ্যবিত্ত, এমনকি নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকেই রাজনৈতিক নেতৃত্ব এসেছে। উচ্চবিত্তের ভূ-স্বামীরা শোষক হিসাবে পরিচিটি পাওয়ায় তারা জনপ্রিয় ছিলেন না। এ কারণে পোস্ট কলোনিয়াল যুগে শাসকরা নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে এসেছেন। আমাদের দেশেও তাই হয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণি রাজনৈতিক নেতৃত্বে আসছে না। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত যারাই রাজনীতিতে আসছেন, তারা রাতারাতি উচ্চধনী হয়ে যাচ্ছেন।'
সঞ্চালকের বক্তব্যে পিপিআরসি চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, 'এডিবির হিসাবে দৈনিক সর্বনিম্ন দুই ডলার আয়ের লোকজন মধ্যবিত্তের কাতারে পরেন। গড়ে সাড়ে চার সদস্যের পরিবারে মাসে ২০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা আয়ের লোকজন নিম্ন মধ্যবিত্ত। ৪১ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা মাথাপিছু আয়ের লোকজন মধ্যবিত্ত। আর ১ লাখ থেকে দুই লাখ পর্যন্ত আয়ের লোকজন উচ্চ মধ্যবিত্ত।'
তিনি বলেন, 'বাজারের বর্তমান বাস্তবতায় এই পরিমাণ আয় নিয়ে লোকজন কতটুকু স্বস্তিতে থাকবে, এটা আলোচনার বিষয়।'
উদাহারণ দিয়ে তিনি বলেন, 'ই-কমার্স আসায় ডেলিভারি খাতে কর্মসংস্থান বেড়েছে। এর ফলে নিম্নবিত্ত শ্রেণি সৃষ্টি হয়েছে। এই আয় নিয়ে একটা পরিবার কী ধরনের ভবিষ্যৎ নির্মাণ করবে, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।'
বিআইডিএস মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন বলেন, 'সংকট মোকাবেলায় মধ্যবিত্তদের যে ভূমিকার কথা বলে হয়ে থাকে, ঐতিহাসিকভাবে তার অনেকটাই সঠিক নয়। ইউরোপে শ্রমিক আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল মেহনতি খেটে খাওয়া মানুষের হাত ধরে। এরপরেও সব ধরনের গণআন্দোলন হয়েছে শ্রমিকদের হাত ধরে।'
তিনি বলেন, 'ষাটের দশকে দেশে মধ্যবিত্তের হার ছিল ৫ শতাংশ। এখন তা বেড়ে ৩০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। তবে সেই ৫ শতাংশের সঙ্গে বর্তমানের ৩০ শতাংশের বড় ধরনের পার্থ্যক্য রয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, "'৬৯-এর গণআন্দোলন, '৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্মাচনে জয় লাভ, '৭০-এর নির্বাচন, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ে বড় ভূমিকা রয়েছে মধ্যবিত্তদের। তবে বর্তমানে গভর্নেন্স, ডেমোক্রেটিক রাইট ও অন্যান্য ক্ষেত্রে অচলাবস্থায় মধ্যবিত্তরা বৃহত্তর গণমানুষের আন্দোলনে বিমুখ রয়েছেন। পাটকল বন্ধ হয়ে গেছে, সেখানে কোনো আন্দোলন হয়নি।'
'মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে গণমানুষের আন্দোলনে যুক্ত করতে একটি সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করতে হবে। সমাজ বদলের চিন্তায় মধ্যবিত্তদের পুনর্বিন্যাস করতে হবে। কৃষক, শ্রমিক ও মধ্যবিত্তরা এক হলে নতুন সমাজ বিনির্মাণ সম্ভব,' যোগ করেন ড. বিনায়ক সেন।
সাংবাদিক ফারুক ওয়াসিফ বলেন, 'মধ্যবিত্তরা নেতৃত্বের ভূমিকা, নায়কের ভূমিকা হারাচ্ছে। তাদের আকার বাড়লেও স্বকীয়তা হারাচ্ছে।'
'এক সময় মধ্যবিত্ত নিজেদেরকে মডার্নাইজার, অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীলতার বাহন মনে করত। এই মধ্যবিত্তরা ছিল মিনিং জেনারেটিং পাওয়ার হাউস। এক সময় মানুষের লক্ষ্য ছিল মননশীল মধ্যবিত্ত হয়ে ওঠা। এই মধ্যবিত্তদের মানবিকতা, সভ্যতা, নেতৃত্ব অগ্রসরতা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে,' বলেন তিনি।
ফারুক ওয়াসিফ আরও বলেন, 'পুরাতন মধ্যবিত্তদের পাশাপাশি মফস্বল থেকে এসে উঠতি মধ্যবিত্ত একটা শ্রেণি গড়ে উঠেছে। ছোট উদ্যোগ বা সেবায় তাদের বড় একটা অংশের কর্মসংস্থান হয়েছে। মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া, জিডিপি বৃদ্ধি তাদের মাধ্যমে হয়েছে।'
সেন্টার ফর ইনক্লুসিভ আর্কিটেকচার অ্যান্ড আরবানিজম, ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক এবং যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. আদনান মোর্শেদ বলেন, 'নাগরিক জঞ্জালের সবাই ব্যক্তিগত প্রাচুর্যের দিকে ছুটছে। এই ছুটাছুটির মধ্যেই মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্বকীয়তা হারিয়ে গেছে।'
তিনি বলেন, 'আজকে মধ্যবিত্তরা সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও পেশাগত দক্ষতার দিক বিবেচনায় কিছুটা বিভ্রান্ত।'
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড. এমএ সাত্তার মন্ডল বলেন, 'কৃষি প্রযুক্তি, র্যামিটেন্সের মতো নতুন কিছু ড্রাইভার যুক্ত হয়েছে। এসব খাতে কিছু উদ্যোক্তা সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে কৃষি আধিপত্য নির্ভর নতুন একটা মধ্যবিত্ত শ্রেণি সৃষ্টি হয়েছে।'
'গ্রাম থেকে শহরে সম্পদের স্থানান্তর হচ্ছে। একটু সম্পদ হলেই লোকজন শহরে এসে থাকছেন,' যোগ করেন তিনি।