অধিকাংশ মধ্যবিত্তের সামনে কোনো আশার আলো নেই
গত কয়েক দশকে অর্থনৈতিক রূপান্তরের সুবাদে দেশে মধ্যবিত্তের সংখ্যা বাড়ছিল। তবে কোভিড সংকটে কর্মচ্যুতি ও আয় হারানোর কারণে তাদের বড় একটা অংশ দারিদ্রসীমার নিচে নেমে এসেছে। আবার ধনীদের একটা অংশও মধ্যবিত্তের কাতারে নেমে এসেছেন।
কিছুটা যোগ-বিয়োগ হলেও মধ্যবিত্তের সংখ্যাই এখন দেশে সবচেয়ে বেশি। তবে সমস্যা হলো এই সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রেণী সরকারের কোনো নীতিমালায় নেই। প্রান্তিক, সুবিধাবঞ্চিত ও পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্য সমাজের বিভিন্ন পক্ষ থেকে দাবি আসায় তাদের কল্যাণের জন্য সাময়িকভাবে হলেও সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছে।
আবার উচ্চ ধনী শ্রেণীর শিল্প মালিক, ব্যাংক মালিক, আমলা ও রাজনীতিকদের জন্য সরকারের নীতিমালা সব সময় সহায়ক হয়ে থাকে। তারা অর্থনীতিতে সব সময় ভালো অবদান রাখেন, আবার তাদের অভিগম্যতা ও প্রভাবও অনেক বেশি।
কিন্তু মাঝের যে বড় অংশ তাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। তাদের পক্ষে কেউ কোনো কথা বলছেন না। আবার তারা নিজেরাও তাদের দাবির পক্ষে এক হয়ে আওয়াজ তুলতে পারছেন না। বিভিন্ন কারণেই মধ্যবিত্তদের চাহিদাগুলো অদেখা থেকে গেছে। কোনো অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণের সময় মধ্যবিত্তদের ওপর সম্ভাব্য প্রভাবও হিসাব করা হয় না।
করোনার কারণে লকডাউনে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অনেকেই কাজ হারিয়েছেন। আবার ছোটোখাটো অনেক ব্যবসা এবং শিল্প-প্রতিষ্ঠানও বন্ধ হয়েছে। প্রায় এক বছরের বেশি সময় ধরে এই শ্রেণী খুবই মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়েছে।
তাদের অনেকেই কাজে ফিরে আসলেও আয়ে আগের অবস্থানে ফিরতে পারেননি। এরই মধ্যে শুরু হওয়া যুদ্ধের কারণে বাড়তি মূল্যস্ফীতির চাপে তাদের আয়ও কমেছে, ক্রয়ক্ষমতাও কমেছে।
একেবারেই দরিদ্র মানুষদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মিত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে বিনামূল্যে ও ভর্তুকি মূল্যে খাবার সরবরাহ করা হয়েছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণী লোকলজ্জার ভয়ে এসব কর্মসূচি থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা নিতে পারছেন না। কোভিড থেকে শুরু করে ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধ পর্যন্ত বিভিন্ন সংকটে জর্জরিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কার্যত কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
উচ্চ-মধ্যবিত্তরাও ব্যয়ের চাপ কমাতে ড্রাইভার, কাজের লোক ছাড়িয়ে দিচ্ছেন। বিভিন্নভাবে তারা ব্যয় সীমিত রাখার চেষ্টা করছেন। ব্যাংকে আমানত কমে আসছে মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সঞ্চয় কমে আসায়।
মধ্যবিত্তরা বিদ্যমান আয়ে চাল, ডালসহ অত্যাবশ্যক পণ্যের ব্যয় মেটাতে পারছেন না। তাদের অনেকেই খাবারের পরিমাণ, ফ্রিকোয়েন্সি বা কোয়ালিটি কমাতে বাধ্য হচ্ছেন। চিকিৎসা ও সন্তানদের শিক্ষার ব্যয়ও মেটাতে পারছে না অনেক পরিবার।
এই ধারা অব্যাহত থাকলে পুষ্টি পরিস্থিতি তথা সার্বিক মানব সম্পদে বড় ধরনের অবনমন হবে। কর্মক্ষমতা কমে আসলে দীর্ঘ মেয়াদে আয়ও কমে আসবে।
আগামী বছর গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম আরও বাড়বে বলে এখনই ধারণা করা হচ্ছে। এর ফলে মধ্যবিত্তরা জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে আরও চাপে পড়বেন। এই সময়ে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো লক্ষণ নেই। মূল্যস্ফীতি হয়তো নয় থেকে একসময় সাতে নেমে আসবে। তবে পণ্যের দাম কমার কোনো সম্ভাবনা আমি দেখছি না।
এ অবস্থায় মধ্যবিত্তদের জন্য আশার কোনো আলো অন্তত আগামী বছরের জন্য আমি দেখছি না। কোয়ালিটি অব লিভিং নিয়ে তাদের আগামী বছর আরও কম্প্রোমাইজ করতে হবে।
তবে চাকুরীর বাজারে আগামী বছরে বড় কোনো উন্নতির সম্ভাবনা না থাকলেও কোন খাতে কর্মচ্যুতির তেমন কোনো আশঙ্কা দেখছি না। দেশের রপ্তানি খাত তথা তৈরি পোশাক শিল্প ভালো করছে। তবে দেশি বিদেশি উদ্যোক্তারা শিল্প স্থাপনের জন্য একটি সহায়ক পরিবেশের অপেক্ষায় থাকায় ব্যাপক হারে কর্মসংস্থান বৃদ্ধিরও কোনো সম্ভাবনা দেখছি না।
এক বছরের উদ্যোগে মধ্যবিত্তদের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করা কঠিন। সংখ্যায় বেশি থাকায় তাদের জন্য খাদ্য সহায়তা কর্মসূচি পরিচালনা করা কঠিন। তবে চলমান সংকট মোকাবেলায় তাদের জন্য নগদ ও খাদ্য সহায়তা কর্মসূচি চালুর উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
সরকারের পুরোনো প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন হলেও মধ্যবিত্তরা কিছুটা সস্তিতে থাকবেন। ইউনিভার্সাল পেনশন স্কিম প্রতিশ্রুতি এবং আলোচনায় থাকলেও এখনও বাস্তবায়ন শুরু হয়নি।
উন্নত বিশ্ব এমনকি প্রতিবেশী দেশগুলোতেও সবার জন্য স্বাস্থ্যবীমার ব্যবস্থা রয়েছে। শিক্ষায় সরকারের বিপুল পরিমাণে বিনিয়োগ রয়েছে। সবার জন্যে পেনশনের ব্যবস্থা রয়েছে। এই ব্যবস্থাগুলো এখানে চালু থাকলে মধ্যবিত্তরা একটু সস্তিতে থাকতে পারতেন।
ড. ফাহমিদা খাতুন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-র নির্বাহী পরিচালক। টিবিএসের সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট জাহিদুল ইসলাম কথা বলেছেন ড. ফাহমিদা খাতুনের সাথে।