স্বাস্থ্যবিধি মানার উদাসীনতায় আবার বাড়তে পারে করোনার সংক্রমণ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে করোনা মহামারির সামগ্রিক অবস্থা সন্তোষজনক হলেও সন্তুষ্টিতে ভোগার সুযোগ নেই। কারণ স্বাস্থ্যবিধি সঠিকভাবে না মানলে ভাইরাসটির নতুন ধরনের কারণে পরিস্থিতি আবারও খারাপের দিকে যেতে পারে।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ড. এম মুশতাক হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'যতক্ষণ পর্যন্ত করোনাভাইরাস সারা পৃথিবী থেকে বিলীন না হবে, ততদিন পর্যন্ত স্বস্তির সুযোগ নেই। দীর্ঘদিন সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখার পর ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়ায় সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে। তাই আমাদের স্বস্তির কোনো সুযোগ নেই। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের মানুষ যথেষ্ট মাত্রায় ভ্যাকসিন পায়নি, তাই নতুন নতুন ভেরিয়েন্ট আসতে পারে।'
তিনি পরামর্শ দেন, 'এখন যেহেতু সংক্রমণ কম, তাই রোবাস্ট সার্ভিলেন্স সিস্টেম চালু করতে হবে। রোগী শনাক্ত এবং তাদের কোয়ারেন্টিন ও আইসোলেশন করতে হবে। স্কুলগুলো খুলে দেওয়ায় এ কাজটি সহজ হয়েছে। স্কুলগুলো যেভাবে সার্ভেলেন্সের মধ্যে থাকছে, সেভাবে কমিউনিটিকেও সার্ভেলেন্সের মধ্যে রাখতে হবে। আর সাধারণ মানুষকে অবশ্যই ভিড়ে কম যেতে হবে ও মাস্ক পরতে হবে'।
টানা চারদিন ধরে দেশে করোনাভাইরাসের পজিটিভিটি রেট ৫ শতাংশের নিচে। নতুন রোগী শনাক্ত ও মৃত্যুও কমেছে। ভাইরাসের সংক্রমণ কমায় স্বাস্থ্যবিধি মানায় উদাসীনতা বেড়েছে। রাস্তাঘাট, মার্কেট, অনুষ্ঠান, গণপরিবহন—সর্বত্র মানুষের ভিড় বাড়ছে। মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি।
শনিবার চার মাসেরও বেশি সময় পর প্রথমবারের মতো দৈনিক শনাক্তের সংখ্যা ১ হাজারের নিচে নেমে এসেছে। শনিবার নতুন শনাক্ত সংখ্যা ৮১৮। এর আগে ১৭ মে ৬৯৮ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছিল।
শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ১৭ হাজার ৮১৮টি নমুনা পরীক্ষার পর করোনা শনাক্তের হার ৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ রেকর্ড হয়েছে। আর গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় আরও ২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে।
সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুসারে, দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা ২৭ হাজার ৩৯৩ জনে পৌঁছেছে এবং করোনায় শনাক্ত হয়েছে ১৫ লাখ ৫০ হাজার ৩৭১ জন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে, টানা দুই সপ্তাহ কোভিড পজিটিভিটি হার ৫ শতাংশের নিচে থাকলে সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে বলা যায়।
দেশে এ বছরের ১৮ জানুয়ারি থেকে ৮ মার্চ পর্যন্ত পজিটিভিটি ৫ শতাংশের নিচে ছিল। এপ্রিল মাস থেকে সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে এবং জুলাই ও আগস্টে ভয়াবহ রূপ নেয়।
শীর্ষস্থানীয় ভাইরোলজিস্ট ও জাতীয় কারিগরি কমিটির সদস্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'এখন দেশে জ্বরে আক্রান্ত অনেক রোগী পাওয়া যাচ্ছে, যারা বিভিন্ন ধরনের ভাইরাল ইনফেকশনে ভুগছে। এতে করে করোনাভাইরাসের শক্তি কমছে। এখন পজিটিভিটি রেট ৫ শতাংশের নিচে নেমেছে। সবাই যদি মাস্ক পরে, ভিড়ে না যায়, তাহলে তা ১ শতাংশে নেমে আসবে। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মানায় উদাসীন হলে আবার সংক্রমণ বেড়ে যাবে।'
তিনি আরও বলেন, দেশে গত বছরও শীতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কম ছিলে, এবারও শীতের আগে সংক্রমণ কমছে। শীতে বাংলাদেশে সংক্রমণ কেন কমে, সেটি নিয়ে গবেষণা করা প্রয়োজন বলে মনে করেন অধ্যাপক নজরুল ইসলাম।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ড. রোবেদ আমিন বলেন, 'বাংলাদেশ এখন ভালো অবস্থানে রয়েছে। সংক্রমণ পরিস্থিতি একটা স্থিতিশীল পর্যায়ে এসেছে। তবে তার মানে এই নয় যে, করোনা চলে গেছে। সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই'।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, গত ৬ জুলাই দেশে দৈনিক নতুন শনাক্ত রোগীর সংখ্যা প্রথম ১১ হাজার ছাড়িয়ে যায়। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কারণে জুলাই ছিল দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ মাস। জুলাই মাসে ১৯ দিনে দৈনিক মৃত্যু ২০০ এর বেশি ছিলো। আগস্টের শেষ সপ্তাহ থেকে সংক্রমণ ও মৃত্যু কমতে শুরু করে। আর চলতি মাসে সংক্রমণের হার কমে এসেছে ৫% এর নিচে।
সংক্রমণ কমে আসায় খুলে দেয়া হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সবকিছু চলছে স্বাভাবিক নিয়মে, কিন্তু কোথাও স্বাস্থ্যবিধি না মানায় সংক্রমণ বাড়ার শঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভাইরাসের নতুন নতুন ভেরিয়েন্টের কারণে যেকোন সময় আবার পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যেতে পারে। সে কারণে রোগী শনাক্ত ও তাদের ব্যবস্থাপনা এবং সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যবিধি মানার বিকল্প নেই।
দেশে এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ পেয়েছে ২ কোটি ৩৮ লাখ মানুষ ও দুই ডোজ ভ্যাকসিন পেয়েছে ১ কোটি ৫৭ লাখ মানুষ।
ড. এম মুশতাক হোসেন বলেন, 'মানুষের ভ্যাকসিনের প্রতি আগ্রহ আছে এবং অনেক মানুষকে ভ্যাকসিন দেয়ার সক্ষমতা আছে। সমস্যা ভ্যাকসিনের প্রাপ্যতায়। এখন পর্যন্ত মাত্র ১০% মানুষ ভ্যাকসিনের আওতায় এসেছে। এখন সংক্রমণ কম তাই দ্রুত বেশি সংখ্যক মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনতে হবে, তাহলে আবার সংক্রমণ বাড়লেও মৃত্যু বাড়বেনা'।