মহানন্দার পাথরের স্পর্শে জীবিকা নির্বাহ করে হাজারো মানুষ
দেশের উত্তর সীমান্ত এলাকা বাংলাবান্ধা থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার অংশে বাংলাদেশ ও ভারতকে দুভাগ করেছে মহানন্দা নদী। বাংলাবান্ধা থেকে তেঁতুলিয়া সদর পর্যন্ত গ্রামের প্রায় প্রতিটি পরিবারই জীবন-জীবিকার জন্য এই নদীর ওপরই নির্ভরশীল।
বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র ও গভীর সমুদ্রবন্দর, অর্থনৈতিক অঞ্চল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বড় বড় প্রকল্পে সবচেয়ে দরকারি পণ্য পাথর। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন জায়গায় রাস্তা-ঘাট ব্রিজ-কালভার্ট, বাড়ি নির্মাণে পাথর ব্যবহার হয়ে থাকে।
বাংলাবান্ধা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কুদরত ই খুদা মিলনের তথ্যমতে, এখানে মিলে এলাকার প্রায় ৪০ হাজার মানুষ প্রত্যক্ষভাবে এ পেশায় জড়িত।
পাথর শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা জানান, জেলা থেকে প্রতিদিন প্রায় ২০০ ট্রাক পাথর দেশের বিভিন্ন জেলায় যায়। এর মূল্য ২ কোটি টাকার উপরে।
পাশাপাশি অন্তত দেড় শতাধিক পাথরের ট্রাক বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। পঞ্চগড় থেকে প্রতিদিন প্রায় ২০০ থেকে ২৫০ ট্রাক বালু দেশের বিভিন্ন জেলায় যায়।
তেঁতুলিয়ার চৌরাস্তা এলাকার বাসিন্দা অহিদুল আসলাম প্রায় ২০ বছর ধরে মহানন্দায় পাথর তুলে জীবিকা নির্বাহ করছেন। জানালেন, "একসময় এই নদীতে অনেক বড় বড় পাথর পাওয়া যেতো। এখন ছোট ছোট নুড়ি পাথর মেলে। পাথর তোলার শ্রমিক বেড়েছে। দিনের বেলায় নদী কানায় কানায় ভরে যায়। হাজার হাজার মানুষ নদীতে নামে। এই কারণে সকালে আসি পাথর তুলতে। বিকেল চারটার দিকে বাসায় চলে যাই।"
তেঁতুলিয়া চৌরাস্তা এলাকার আরব আলী পাথর তোলার যন্ত্রপাতি নিয়ে প্রতিদিন ভোরে মহানন্দায় আসেন। তার সাথে এই নদীর ঘনিষ্ঠতা অন্তত ২৫ বছরের। ৫০ বছর বয়সী এই শ্রমিক এখনো সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পাথর তোলেন।
তিনি বলেন, প্রতি সিএফটি গড় পাথর (ছোট-মাঝারি-কুচি বালু) ৬০ থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করা হয়। এখন একজন শ্রমিক দিনে ১৪ থেকে ১৮ সিএফটি পাথর তুলতে পারেন। গড়ে একজন শ্রমিক ১ হাজার টাকার পাথর তোলেন।
মহানন্দায় এখন তেতুলিয়ার ভজনপুরের পাথর শ্রমিকই বেশি। ১০ বছরের অধিক সময় ধরে ডাকবাংলা এলাকায় পাথর তোলেন ভজনপুরের শহিদুল ইসলাম ও আব্দুল হাকিম।
তারা বলেন, "নদী সীমান্ত এলাকায় হওয়ার কারণে প্রায়ই ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ পাথর তোলায় বাধা দেন। এই সময় আমাদের কিছু লোকজনকে (খুচরা ব্যবসায়ী) তারা জানান যে পরিস্থিতি ভালো না, তখন আমরাও পাথর তুলি না। দু একদিন পর আবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যায়।"
তবে, সাধারণত এলাকার নারী সদস্যরা নদীতে নেমে পাথর তোলেন না। তারা মূলত পাথর শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন।
পাথর শ্রমিকের কাজ করা আলেয়া বেগমের স্বামী অন্তত ১৫ বছর ধরে পাথর তুলছেন মহানন্দার ডাক বাংলা এলাকা থেকে। এখানেই এক ব্যবসায়ীর প্রতিষ্ঠানে পাথর নেট (বাছাই) করার কাজ করেন আলেয়া। দিনে ৮ ঘণ্টা কাজ করে মজুরি পান ২১৬ টাকা।
জানালেন, "বাড়িতে বসে থাকার চেয়ে এখানে কাজের সুযোগ হয়েছে। স্বামীর সাথে সংসারে সহযোগিতা করতে পারছি এটা অনেক ভালো লাগার বিষয়।"
ভারত থেকে বয়ে আসা ছোট বড় ৪৭ টি নদ নদী প্রবাহিত হয়েছে পঞ্চগড় জেলার ওপর দিয়ে। এর মধ্যে মহানন্দা, করতোয়া, ডাহুক নদী থেকে পাথর তোলেন শ্রমিকরা। তবে মহানন্দার পাথরের জৌলুস সবচেয়ে বেশি।
দেশে একটিমাত্র দিনাজপুরের পার্বতীপুরে মধ্যপাড়া খনি থেকে পাথর উত্তোলিত হয়। এটিও মাঝে মাঝেই বন্ধ থাকে। তবে শ্রমিকরা জানান, পঞ্চগড়ের নদী থেকে একদম পাথর তোলা বন্ধ হয়নি কখনো।
জীবনের প্রথম ১৫ বছর মহানন্দায় পাথর তুলে জীবিকা নির্বাহ করেছেন মো. আব্দুল সামি। এখন তিনি নিজেই পাথর ব্যবসায়ী। প্রতিদিন শ্রমিকদের কাছ থেকে অন্তত ৪ ট্রাক পাথর কেনেন।
৫৭ বছর বয়সী এই ব্যবসায়ী জানান, তেঁতুলিয়ার অধিকাংশ পরিবার চলে পাথরের উপর দিয়ে। তাদের মধ্যে কেউ পাথর তোলেন, কেউবা পাথরের ব্যবসা করেন। মহানন্দার পাথরই তাদের বেঁচে থাকার শক্তি। মাসে প্রায় দেড়-দুই লাখ সিএফটি পাথর তোলা হয় নদী থেকে।
মহানন্দায় পাথর কেনাবেচায় অন্তত ৩০০ জন ব্যবসায়ী রয়েছেন। তাদের মধ্যে মো. ওমর ফারুক এখানে ১৫ বছর ধরে ব্যবসা করছেন। তিনি জানান, এই নদী থেকে প্রতিদিন অন্তত ৩ ট্রাক পাথর কেনেন। এগুলো নদীর উপরে উঁচু জমিনে নিয়ে নেট পদ্ধতিতে বাছাই করেন। এরপর সেগুলো দেশের বিভিন্ন বড় বড় পাইকারি ব্যবসায়ী কিংবা ঠিকাদারের কাছে বিক্রি করেন।
বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে ভারত ও নেপাল থেকে পাথর আমদানির সঙ্গেও অনেক ব্যবসায়ী জড়িত।
শোভন এন্টারপ্রাইজের মালিক সাইদুর রহমান বলেন, "প্রতিদিন প্রায় ৪০০ ট্রাক পাথর বন্দর দিয়ে প্রবেশ করে। তবে দেশে মোট কত পরিমাণ পাথর উত্তোলন করা হয় তার কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই।"
ট্রাক ট্রাক্টর কাভার্ড ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক রমজান আলী বলেন, পঞ্চগড় থেকে পাথর ও বালু পরিবহন করে পরিবহন মালিকরা এক কোটি টাকার বেশি পান।
বাংলাবান্ধা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কুদরত-ই-খুদা মিলন জানান, এলাকার প্রায় ৪০ হাজার মানুষ সরাসরি এ পেশার সঙ্গে জড়িত।
পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "জেলার প্রাকৃতিক সম্পদ, বিশেষ করে পাথর নিয়ে একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। এই শিল্পকে কেন্দ্র করে এলাকায় বাণিজ্যিক কেন্দ্র তৈরি করা গেলে তা আরও বেশি করে গড়ে উঠবে। এই অঞ্চলের মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে তা।"