ব্রয়লার মুরগির মাংস নিরাপদ: কৃষি গবেষণা কাউন্সিল
ব্রয়লার মুরগির মাংস, হাড় এবং কম্পোজিটের বেশিরভাগ নমুনায় এন্টিবায়োটিক ও ভারি ধাতুর উপস্থিতি পাওয়া গেলেও তা ছিল সহনীয় মাত্রার 'অনেক নিচে'।
ফলে ব্রয়লার মুরগির মাংস একটি নিরাপদ খাদ্য এবং এটি খাওয়া জনস্বাস্থের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ নয় বলে জানান কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক।
বৃহস্পতিবার (১২ জানুয়ারি) সচিবালয়ে তথ্য অধিদপ্তরের সম্মেলন কক্ষে গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করেন কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়ন ও উদ্যোগে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) অধীনে গবেষণাটি গত বছরের জানুয়ারি-জুন সময়ে পরিচালিত হয়েছে।
ঢাকা, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী এবং বরিশালের ছোট, মাঝারি ও বড় ফার্ম থেকে এসব নমুনা সংগ্রহ করা হয়।
সংগৃহীত প্রায় ১২০০টি ব্রয়লার মুরগি এবং ৩০টি ব্রয়লার মুরগির খাদ্য হতে ৩১৫টি নমুনা প্রস্তুত করে ১০টি এন্টিবায়োটিক এবং ৩টি ভারী ধাতুর উপস্থিতি পরীক্ষা করা হয়।
গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, ব্রয়লার মুরগির মাংস, হাড় এবং কম্পোজিটে অক্সিটেট্রাসিাইক্লিন ও ডক্সিসাইক্লিন নামের দুটি এন্টিবায়োটিক এবং আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম ও লেডের মত ৩টি হেভি মেটাল বা ভারী ধাতুর উপস্থিতি রয়েছে। তবে এই উপস্থিতির পরিমাণ সহনীয় মাত্রার অনেক নিচে।
তবে, মুরগির মাংস পরীক্ষার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ৭০ শতাংশ নমুনাতেই এন্টিবায়োটিক এবং ৯০ শতাংশ নমুনার মধ্যেই হেভি মেটাল পাওয়া গেছে।
গবেষণা টিমের প্রধান বিএসিআর এর চিফ সায়েন্টিফিক অফিসার (প্রাণীসম্পদ বিভাগ) মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "অধিকাংশ নমুনাতেই এন্টিবায়োটিক ও হেভি মেটালের উপস্থিতি থাকলেও তা সহনীয় মাত্রার অনেক নিচে, যা স্বাস্থের জন্য ক্ষতিকর নয়।"
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) এর একদল গবেষকের একটি রিসার্স পেপার গত ২৫ জুন নেচার জার্নালে প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়, ঢাকার পাঁচটি কিচেন মার্কেটে বিক্রির জন্য রাখা মুরগির দেহে কিছু শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী সুপারবাগের আশঙ্কাজনক মাত্রা দেখা যাচ্ছে। এর প্রভাবে মানবদেহে কাজ করছে না বহুল প্রচলিত ও গুরুত্বপূর্ণ ৬৭ শতাংশ অ্যান্টিবায়োটিক।
এছাড়া, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ব্রয়লার মুরগির উপর একটি গবেষণা পরিচালনা করেন। 'সোশ্যাল অ্যান্ড কগনিটিভ ফ্যাক্টরস ইনফ্লুয়েন্সিং কমার্সিয়াল চিকেন ফারমার্স অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ইউসেজ ইং বাংলাদেশ' শিরোনামের গবেষণাটিও সায়েন্টিফিক রিপোর্টস নামের একটি আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে গত ১১ জানুয়ারি।
এই গবেষণার ফলাফলে বলা হয়েছে, ১৩৭টি কমার্শিয়াল ফার্মের উপর পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে সব খামারিই পোল্ট্রির ডিজিস মোকাবেলায় এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করছে। এর মধ্যে ৩৮.৬ শতাংশ খামারি এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করছে মুরগির ভালো গ্রোথের জন্য এবং ১০.২ শতাংশ তাদের মুরগি ও ডিমের কোয়ালিটি বাড়ানোর উদ্দেশ্যে এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করছে।
এদিকে বিএআরসির গবেষণার ফলাফল তুলে ধরে কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক জানান, ব্রয়লার মাংসে গড়ে ৮.০ পিপিবি (পার্টস পার বিলিয়ন) অক্সিটেট্রাসাইক্লিন, ৯.১ পিপিবি ডক্সিসাইক্লিন, ৬.২ পিপিবি আর্সেনিক, ১৯০.৭ পিপিবি ক্রোমিয়াম এবং ২৫৯.১ পিপিবি লেড রয়েছে; যা সর্বোচ্চ সহনশীল সীমার চেয়ে যথাক্রমে ১২.৫ গুণ, ১০.৯ গুণ, ৬.৫ গুণ, ৫.২ গুণ এবং ২৩.১ গুণ নিচে রয়েছে।
একইভাবে ব্রয়লার মুরগির হাড়ের নমুনা পরীক্ষায় দেখা যায়, গড়ে ৫৩.৭ পিপিবি অক্সিটেট্রাসাইক্লিন, ২৭.০ পিপিবি ডক্সিসাইক্লিন, ৭.২ পিপিবি আর্সেনিক, ৪৩৯.৯ পিপিবি ক্রোমিয়াম এবং ৪৬৪.৬ পিপিবি লেড রয়েছে; যা সহনীয় সীমার চেয়ে যথাক্রমে ১.৮ গুণ, ৩.৭ গুণ, ৫.৫ গুণ, ২.২৭ গুণ এবং ১২.৯ গুণ নিচে রয়েছে।
ব্রয়লার মুরগির কম্পোজিটে (কলিজা, কিডনী এবং গিজার্ডের সমন্বয়) গড়ে ১৪.৫ পিপিবি অক্সিটেট্রাসাইক্লিন, ১৭.২ পিপিবি ডক্সিসাইক্লিন, ১০.৯ পিপিবি আর্সেনিক, ২৩৯.২ পিপিবি ক্রোমিয়াম এবং ৩০৭.৬ পিপিবি লেড রয়েছে; যা সর্বোচ্চ নির্ধারিত লিমিটের চেয়ে যথাক্রমে ৬.৮ গুণ, ৫.৮ গুণ, ৩.৬ গুণ, ৪.১৮ গুণ এবং ১৯.৫ গুণ নিচে রয়েছে।
কৃষিমন্ত্রী বলেন, ব্রয়লার মুরগির মাংস খাওয়া নিরাপদ কিনা, "এ নিয়ে আমাদের অনেকের মধ্যেই ভ্রান্ত ধারণা বা দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েছে। অনেক প্রচারণায় দেখা যায় যে, ব্রয়লার মাংসে এন্টিবায়োটিক, হেভি মেটাল এবং অন্যান্য ক্ষতিকর পদার্থের উপস্থিতি রয়েছে, যা মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ব্রয়লার মাংস সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা ছড়িয়ে পড়ায় মানুষ খাওয়া কমিয়ে দেয়, ফলে ব্রয়লার শিল্পের উপর বড় ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে।"
গবেষণায় ব্রয়লার মুরগির খাদ্যেও মধ্যে অক্সিটেট্রাসাইক্লিন ও ডক্সিসাইক্লিন ও টাইলোসিন নামক এন্টিবায়োটিক এবং আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম লেড পাওয়া গেছে। এটাও ক্ষতিকর মাত্রার চেয়ে অনেক কম।
গবেষণা দলটি দশটি এন্টিবায়োটিকের মধ্যে ৭টি এন্টিবায়োটিক (এনরোফ্লক্সাসিন, সিপরোফ্লক্সাসিন, নিওমাইসিন, টাইলোসিন, কলিস্টিন, এমোক্সাসিলিন এবং সালফাডায়াজিন) পরীক্ষার জন্য নমুনাসমূহ এসজিএস বাংলাদেশ লিমিটেডের মাধ্যমে ভারতের চেন্নাইয়ে অবস্থিত এসজিএস ল্যাবরেটরি থেকে পরীক্ষা করে। বাকি ৩টি এন্টিবায়োটিক (ক্লোরামফেনিকল, অক্সিটেট্রাসাইক্লিন এবং ডক্সিসাইক্লিন) এবং ৩টি ভারী ধাতু (আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম ও লেড) পরীক্ষা করা হয় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অধীন আইএসও সার্টিফায়েড অ্যান্ড অ্যাক্রেডিটেড কোয়ালিটি কন্ট্রোল ল্যাবরেটরি, সাভারে।
কৃষিমন্ত্রী বলেন, "মুরগির খাবারে ট্যানারির বর্জ্য ব্যবহার করা হয়, এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কেননা, দেশে বর্তমানে হাঁস/মুরগির খাবারের চাহিদার পরিমাণ ৯৫ লাখ টন, গবাদিপশু ১৪৫ লাখ টন; অথচ মোট ট্যানারির বর্জ্য হয় মাত্র ৮৫ হাজার টন।"