২০২২ দেশে শিশুহত্যা বেড়েছে, কমেছে বাল্যবিবাহ-ধর্ষণ
২০২২ সালে দেশে ৩১১ জন শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে, ২০১১ সালে এ সংখ্যা ছিল ১৮৩। অপরদিকে বাল্যবিবাহের হার ২০২১ সালের তু্লনায় ২০২২ সালে কমেছে ৯৪ শতাংশ; ধর্ষণের হারও প্রায় ৩২ শতাংশ কমেছে বলে দাবি করেছে বেসরকারি এনজিও সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন।
গত বছর পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার আশঙ্কাজনক মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে যৌন নির্যাতনের শিকার ছেলে শিশুর সংখ্যা। দেশের আটটি বাংলা ও ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত খবরের সূত্র ধরে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এসব তথ্য প্রকাশ করেছে।
সংস্থাটি জানিয়েছে, ২০২১ সালে পানিতে ডুবে ৪০৫ জন শিশু মারা গিয়েছিল। এক বছর পরে ২০২২ সালে এমন মৃত্যুর সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১৫২ জনে। গত বছর পানিতে ডুবে প্রাণ হারানো শিশুদের মধ্যে ৫২০ জন মেয়েশিশু ও ৬৩২ জন ছেলেশিশু।
এদিকে গত বছর শিশু যৌন নির্যাতনের সংখ্যা কমলেও তুলনামূলকভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার ছেলেশিশুর সংখ্যা বেড়েছে। গত বছর মোট ৯৬ জন শিশু যৌন নির্যাতনের ঘটনা উঠে এসেছে পত্রিকায়। এরমধ্যে ছেলেশিশুর সংখ্যা ২০, যা ২০২১ সালে ছিল ৬ জন।
সংবাদপত্রের খবর বিশ্লেষণ করে সংস্থাটি বলছে, ২০২১ সালের তুলনায় '২২ সালে ধর্ষণের ঘটনা কমেছে ৩১.৫ শতাংশ। গত বছর সারা দেশে শিশু ধর্ষণের ঘটনা ছিল ৫৬০টি। ৯৮ জন শিশুকে ধর্ষণচেষ্টা করা হয়েছে। ধর্ষণের শিকার হয়ে মারা গেছে ১২ জন মেয়েশিশু। ২০২১ সালে শিশু ধর্ষণ ঘটনা ছিল ৮১৮টি।
২০২১ সালের তুলনায় গত বছর বাল্যবিয়ের ঘটনা ৯৪ শতাংশ কমেছে বলে অভিমত দিয়েছে সংস্থাটি৷ এমজেএফ জানিয়েছে, ২০২১ সালে দেশের ২৩ জেলায় ৪১,০৯৫টি বাল্যবিয়ের সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে এসব পত্রিকায়। ২০২২ সালে এসে সেই সংখ্যা কমে হয়েছে ২৩০১টি। এর কারণ হিসেবে তারা বলছে, করোনার সময় অর্থাৎ ২০২০ ও ২০২১ সালে স্কুল বন্ধ থাকায় ও অভাব অনটনের কারণে বাল্যবিয়ে বৃদ্ধি পেয়েছিলো। ২০২২ এ এসে পরিস্থিতি বদলানোয় তা অনেক কমে গেছে।
এমজেএফ-এর পর্যবেক্ষণ হলো, অধিকাংশ শিশু ধর্ষণের ঘটনা পারিবারিক পরিবেশে পরিচিতদের দিয়েই হয়। পরিবারের পরিচিত লোকদের মাধ্যমে ধর্ষণের শিকার হওয়া ছাড়াও, প্রতিবেশীদের হাতে শিশুদের একটি বড় অংশ ধর্ষণের শিকার হয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে শিশুর সর্বনিম্ন বয়স ২ বছর। ৩,৪ বছর থেকে ১২ বছর পর্যন্ত শিশুরা বেশি ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। শিশুদের খেলার সময় লোভ দেখিয়ে পরিচিতরা ধর্ষণ করছে। কিশোরীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে বন্ধুদের কাছে, কর্মক্ষেত্রে, স্কুলে যাওয়ার পথে ও পরিবারের ভেতরে।
গত বছর ৪৪টি শিশু আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে ২৭ জন মেয়ে ও ১৩ জন ছেলে। মূলত পরীক্ষায় ফল-বিপর্যয়, পরিবারের উপর রাগ, প্রেমে ব্যর্থ হয়ে, উত্যক্ত হওয়ার পরে, ধর্ষণের শিকার হওয়ায় বা ধর্ষণ চেষ্টা করায় কিংবা ধর্ষণের বিচার না পাওয়ায় এবং সাইবার হেনস্তা বা ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয়েও আত্মহত্যার মতো ঘটনাগুলো ঘটছে বলে জানিয়েছে এই সংস্থা।
এছাড়া গতবছর হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়ে শিশুমৃত্যুর হার বেড়েছে। ৩১১ জন শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে এবং হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে ৪২ জন শিশুকে।ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিয়ে আলাদাভাবে আধেয় বিশ্লেষণ করে সংস্থাটি দেখিয়েছে, একই সময়ে মোট ১১টি এ সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর সংখ্যা ১৫ এবং সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ঢাকায়। ১৫ জন গৃহকর্মী ধর্ষণসহ নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এরমধ্যে ৫ জন নিহত, ৭ জন আহত ও ৩ জন আত্মহত্যা করেছে। নিহত গৃহকর্মীদের মধ্যে ৩ জন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। ২ জনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে।
সড়ক দুর্ঘটনাতেও বেড়েছে শিশুমৃত্যুর হার। গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ১৯৬ জন। গত বছর মোট নিখোঁজ শিশুর সংখ্যা ২০ জন। এরমধ্যে মেয়েশিশু ৬ জন ও ছেলেশিশু ১৪ জন। ৩০ জন শিশু অপহরণ হয়েছে বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি।
এমজেএফের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনামসহ অন্যান্য অতিথিরা বলেন, এমজেএফের বিশ্লেষণ অনুযায়ী শিশুরা নিজের বাসায় নিরাপদ নয়। শিশু ধর্ষণ ও শিশুর ওপর যৌন হয়রানি বন্ধ করার জন্য সবাইকে এখনই জোটবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে, নতুবা এই হার বাড়তেই থাকবে। শিশু সুরক্ষায় নিয়োজিত সরকারি প্রতিষ্ঠানের সবাইকে আরো বেশি সহৃদয় হওয়ার পাশাপাশি শিশু অধিকার রক্ষায় সম্মিলিতভাবে কাজ করার আহবান জানান তারা।