নতুন জাত উদ্ভাবনের পরও চাষাবাদ কম জিঙ্ক সমৃদ্ধ ধানের
দেহে পুষ্টির ঘাটতি পূরণে এক দশক আগে বিশ্বের প্রথম জিঙ্ক সমৃদ্ধ ধানের উদ্ভাবন করে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)। মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে নতুন একটি জাত উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে সাতটিতে পৌঁছেছে দেশে জিঙ্ক সমৃদ্ধ ধানের জাত।
তবে চাল মোটা ও স্বাদ তুলনামূলক কম হওয়ায় এবং সচেতনতার অভাবে জিঙ্ক সমৃদ্ধ ধানের চাষাবাদ তুলনামূলক হারে বাড়ছে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি হাইব্রিড ধানের সহজলভ্যতা এবং জিঙ্ক ধানের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে মানুষের ধারণা না থাকায় তা জনপ্রিয় হচ্ছে না বলে তাদের মত।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক শাহজাহান কবির বলেন, 'মানুষের শরীরে জিঙ্কের যে চাহিদা, তার প্রায় ৭০ শতাংশ চালের মাধ্যমে পূরণ করা সম্ভব। কিন্তু এ ধানের গুণাগুণ মানুষকে বোঝানো, খাওয়ার পর হিউমান বডিতে তার প্রভাব অধ্যায়ন এবং কৃষকদের লাভবান করে না তোলার কারণে তা জনপ্রিয় হয়ে উঠছে না।'
বাংলাদেশে শিশু ও নারীদের মধ্যে জিঙ্কের ঘাটতি প্রকট হচ্ছে। দেশের প্রায় ৩২.৫ শতাংশ শিশুদের এবং ৪৫.৪০ শতাংশ নারীর মধ্যে জিঙ্কের ঘাটতি রয়েছে। পাঁচ বছরের কম বয়সী ৪১ শতাংশ শিশু জিঙ্কের ঘাটতিজনিত কারণে খর্বাকৃতির হচ্ছে। বেশি ঘাটতি নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে, যারা মূলত প্রাণিজ খাদ্য থেকে জিঙ্ক গ্রহণে পিছিয়ে।
জিঙ্ক বায়ো-ফর্টিফায়েড রাইসের মাধ্যমে এই অপুষ্টি অনেকটাই দূর করা সম্ভব বলে মনে করা হয়, যে কারণে বাংলাদেশে জিঙ্ক ফর্টিফায়েড চালের জন্য ভ্যারাইটি উদ্ভাবন করা হচ্ছে। ২০১৩ সালে প্রথম উদ্ভাবনের পর ব্রি'র ৭টিসহ এখন পর্যন্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মিলে ১৬টি জাত উদ্ভাবন করেছে। এখন পর্যন্ত ছয়টি জাত কৃষক পর্যায়ে চাষ করা হচ্ছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালে সারা দেশে মাত্র ১.২০ লাখ হেক্টর জমিতে জিঙ্ক সমৃদ্ধ ধান চাষ হয়েছে। যেখানে দেশে আমন, আউশ ও বোরো মিলে ১.০৮ কোটি হেক্টরের বেশি জমিতে ধান আবাদ হয়েছে।
জিংক সমৃদ্ধ চাল আসলে কী
মানুষের শরীরে প্রচুর মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস দরকার হয়। এজন্য শর্করা, আমিষের মতোই শরীরে জিঙ্কসমৃদ্ধ খাদ্য উপাদান দরকার। খাবারে মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস না থাকলে শরীর নানা রকম ভারসাম্যহীনতা তৈরি করে। ফলে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, স্থূলতা ও মুটিয়ে যাওয়ার মতো রোগ সৃষ্টি হচ্ছে। এগুলো শরীরে অন্য অসুখও তৈরি করে। এসবের যোগান দিতে পারে জিঙ্ক সমৃদ্ধ চালের ভাত।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট ১৯৯৫ সালে জিঙ্কসমৃদ্ধ ধান নিয়ে গবেষণা শুরু করে।
কয়েক বছর ধরে দেশি ধানের জাত এবং মাটি পরীক্ষা ও চিহ্নিত করে শুরু হয় পরীক্ষানিরীক্ষা। ২০১৩ সালে প্রথম ব্রি-৬২ নামে জিঙ্কসমৃদ্ধ একটি নতুন ধানের জাত উদ্ভাবনের ঘোষণা দেন ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের বিজ্ঞানীরা। এরপর একে একে আসে ব্রি-৬৮, ব্রি-৭২, ব্রি-৭৪, ব্রি-৮৪, ব্রি-১০০ এবং ব্রি-১০২।
ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আবদুল কাদের বলেছেন, উদ্ভাবিত এ ধানের মধ্যে ব্রি-৮৪ জাতের প্রতি কেজি ধানে ২৭ মিলিগ্রাম জিঙ্ক পাওয়া যায়। আর সম্প্রতি মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে নতুন উদ্ভাবিত জাত বঙ্গবন্ধু ধান-১০০ এ জিঙ্কের পরিমাণ প্রতি কেজিতে ২৫.৭ মিলিগ্রাম, যা মানুষের শরীরে জিঙ্কের চাহিদার প্রায় অর্ধেক পূরণ করতে সক্ষম।
তিনি জানান, জিঙ্ক ধান উদ্ভাবনের জন্য তারা প্রথমে জিঙ্কের জিনসমৃদ্ধ ধান বাছাই করেছেন। এসব জাতের ধান মাটি থেকে দানার মধ্যে জিঙ্ক স্থানান্তর করতে পারে। জিঙ্কের জিন থাকে ধানের খোসার মধ্যে।
এরপর জিঙ্ক জিনসমৃদ্ধ ধানগুলোকে উচ্চ ফলনশীল জাতের সঙ্গে ক্রস অর্থাৎ সঙ্করায়ন করা হয়।
তিনি বলেন, 'যেহেতু দেশের মানুষের প্রধান খাদ্য চাল, সেহেতু চালের মাধ্যমেই জিঙ্ক সরবারহ করা সহজ। জিঙ্কসমৃদ্ধ চালের মাধ্যমে বাচ্চাদের এবং মায়েদের শরীরের জিঙ্কের ঘাটতি প্রায় ৬০ শতাংশ পর্যন্ত পূরণ সম্ভব।'
মাঠে যাচ্ছে না উদ্ভাবিত জাত, প্রকল্প চালে জিঙ্ক যুক্ত করার
জাত উদ্ভাবন ও অবমুক্তের খবর প্রচার হলেও মাঠে এসব ধানের উপস্থিতি কম। সর্বশেষ পুষ্টিসমৃদ্ধ বঙ্গবন্ধু ধান-১০০ উদ্ভাবনে সাড়া ফেললেও তার তেমন কোনো জাত মাঠে নেই। ফলে কৃষক এখনও সাধারণ জাতের ধানই আবাদ করছেন।
সরকারের প্রচেষ্টা থাকলেও গ্রাহকদের অনাগ্রহের কারণে কৃষকরা এ ধান চাষাবাদ করছেন না বলে জানিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক।
তিনি বলেন, 'গ্রাহকরা জিঙ্ক চালের জন্য উৎসাহ দেখান না। কারণ জিঙ্কসমৃদ্ধ ধানের চাল মোটা। গ্রাহক চিকন আর চকচকে চাল পছন্দ করেন।'
জিঙ্ক সমৃদ্ধ ধান উদ্ভাবন করেও চাষাবাদ না বাড়িয়ে চালে আলাদাভাবে জিঙ্ক মেশাতে ৫৮ কোটি টাকা খরচের একটি প্রকল্প নিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়।
ব্রির মহাপরিচালক মো. শাহজাহান কবীর বলেন, 'জিঙ্ক ফর্টিফিকেশন (কৃত্রিমভাবে জিঙ্ক মেশানো) কোনোভাবেই টেকসই পদ্ধতি নয়। এভাবে জিঙ্ক মেশালে চালের পুষ্টি দীর্ঘস্থায়ী হয় না। দুইবার ধোয়ার পরই চলে যেতে শুরু করে জিঙ্ক।'
"সরকার কৃষকদের প্রণোদনা দিয়ে বায়ো ফর্টিফিকেশন বা প্রাকৃতিকভাবে জিঙ্ক ও পুষ্টি উপাদানসমৃদ্ধ চালের উৎপাদন বাড়াতে পারে। মানুষের মধ্যে সচেতনা তৈরি করে এ চালের বাজার তৈরি করতে পারে", যোগ করেন তিনি।