এমআরআই সেবা মিলছে না সরকারি হাসপাতালে, দুর্ভোগে রোগীরা
অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কনস্টেবল মিয়া মোহাম্মদ ইদ্রিস (৭০)। বাথরুমে পা পিছলে কোমরে মারাত্মক আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন তিনি। বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি আছেন। প্রায় দুই সপ্তাহ আগে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে এমআরআই পরীক্ষার নির্দেশ দিলেও আর্থিক কারণে তা করা সম্ভব হয়নি। এ কারণে সাবেক এই পুলিশ কর্মকর্তার চিকিৎসা করাতে পারছেনা তার পরিবার।
মিয়া মোহাম্মদ ইদ্রিস জানান, স্বল্প খরচে চিকিৎসা পেতে চমেকে ভর্তি হলেও হাসপাতালের এমআরআই মেশিন নষ্ট থাকায় সেবা মিলছে না। বেসরকারি হাসপাতালে যে ফি চাইছে তা সরকারি হাসপাতালের চাইতে তিনগুণ বেশি; যা তার পরিবারের পক্ষে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
চট্টগ্রামসহ আশেপাশের পাঁচটি জেলার রোগীদের সেবার জন্য সরকারিভাবে উচ্চক্ষমতার ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং বা এমআরআই মেশিন রয়েছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল ও চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে। কিন্তু চমেকের মেশিনটি দুই বছর ধরে অকেজো হয়ে পড়ে আছে। এছাড়া প্রায় চার বছরের বেশি সময় ধরে নষ্ট হয়ে আছে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের এমআরআই মেশিন। যার ফলে রোগীরা, বিশেষ করে দরিদ্র রোগীরা দীর্ঘদিন ধরে সেবা পেতে দারুণ সমস্যা পোহাচ্ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু চট্টগ্রাম নয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল, জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, খুলনার শহীদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতাল, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল, মানিকগঞ্জ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালসহ দেশের অনেক সরকারি হাসপাতালে মেশিন থাকলেও মিলছে না ব্যয়বহুল এমআরআই সেবা।
টিআইবি চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী অভিযোগ করে বলেন, 'মন্ত্রণালয়ের গাফিলতি ও চিকিৎসকদের সদিচ্ছা না থাকায় সরকারি হাসপাতালে কাঙ্খিত সেবা মিলছে না। কমিশন বাণিজ্যের জন্য চিকিৎসকরা পরিকল্পিতভাবে রোগীদের বেসরকারি খাতে সেবা নিতে বাধ্য করছেন। এটি একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট।'
দেড় হাজার টাকার সেবা পেতে খরচ হচ্ছে ৯ হাজার
বর্তমানে চট্টগ্রামের ৮টি বেসরকারি ডায়গনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতাল রোগীদের এমআরআই সেবা দিয়ে থাকে। চট্টগ্রামের সরকারি হাসপাতাল দুটিতে যখন মেশিন সচল ছিলো, তখন দেড় থেকে তিন হাজার টাকায় এই সেবা মিলতো। কিন্তু বর্তমানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে সর্বনিম্ন ৯ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্য়য় হয় রোগীদের।
চমেক হাসপাতালের ফিজিক্যাল মেডিসিন এন্ড রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগের বহির্বিভাগ ও ইনডোরে প্রতিদিন প্রায় ৩০০ রোগীকে সেবা নেন। এর মধ্যে প্রায় ২৫ শতাংশ রোগীর এমআরআই পরীক্ষার প্রয়োজন হয়। কিন্তু হাসপাতালের এমআরআই মেশিন নষ্ট থাকায় তাদের বাধ্য হয়ে বেসরকারি ডায়গনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষার জন্য যেতে হয়।
বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. নিতাই প্রসাদ দত্ত দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'এমআরআই বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। রোগীর সমস্যার উপর ভিত্তি করে আমরা পরীক্ষা দিয়ে থাকি। ন্যূনতম তিন হাজার টাকা থেকে লাখ টাকায়ও এমআরআই করানো হয়ে থাকে। আমাদের হাসপাতালের মেশিনটি নষ্ট থাকায় দরিদ্র রোগীরা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অনেক সময় টাকার সংকটে অনেক জরুরী স্বাস্থ্যপরীক্ষাও করাতে চান না রোগীরা স্বজনেরা।'
চট্টগ্রামের এপিক হেলথ কেয়ারের এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে টিবিএসকে জানান, প্রতি মাসে তাদের প্রতিষ্ঠানে দেড় হাজারের বেশি রোগী এমআরআই পরীক্ষার জন্য আসেন। পপুলার ডায়গনস্টিক সেন্টারের চট্টগ্রাম শাখায় এমআরআই পরীক্ষার জন্য যান অন্তত এক হাজার রোগী। এছাড়া শেভরন, ইবনে সিনা সহ বাকি ছয় ডায়গনস্টিক সেন্টারে প্রায় ৭ হাজার রোগী এমআরআই সেবা নিয়ে থাকেন। সারা দেশের পরিস্থিতিও চট্টগ্রামের মতোই।
সিলেট জেলা সিভিল সার্জন ডা. এম শাহরিয়ার জানান, জেলার কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে এমআরআই সুবিধা থাকলেও সরকারি হাসপাতালগুলোতে এই সেবা নেই। যে কারণে রোগীদের বাধ্য হয়ে বেশি টাকায় বেসরকারি সেবা নিতে হচ্ছে।
রাজশাহী জেলা সিভিল সার্জন ডা. আবু সাইদ মোহাম্মদ টিবিএসকে বলেন, 'বেসরকারি ছাড়া রাজশাহীতে এমআরআই সেবা নেই।'
মেশিন নষ্ট হয়, ঠিক হয় না
২০১৭ সালের ২৫ অক্টোবর প্রায় ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে চমেক হাসপাতালে এমআরআই মেশিনটি স্থাপন করা হয়। মেশিনটি সরবরাহ করেন ঢাকার মেডিটেল প্রাইভেট লিমিটেড নামের এক প্রতিষ্ঠান। ক্রয়ের চুক্তি অনুযায়ী, তিন বছরের ওয়ারেন্টি ছিল মেশিনটির। কিন্তু তিন বছর যেতে না যেতেই ২০২১ সালের ২৮ অক্টোবর বিকল হয় মেশিনটি। এ কারণে এমআরআই সেবা বন্ধ রয়েছে চমেকে।
চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান বলেন, 'বৃহত্তর চট্টগ্রামের রোগীদের ভরসাস্থল হচ্ছে চমেক হাসপাতাল। সেবা নিতে আসেন যারা, তাদের সিংহভাগই হচ্ছেন গরীব। একমাত্র এমআরআই মেশিনটি সচলের জন্য একাধিকবার চিঠি পাঠানো হয়েছে। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানও এসে দেখেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোন সুরাহা হয়নি। এ অবস্থায় বাড়তি খরচ দিয়ে বাইরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাটা রোগীদের জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে।'
অন্যদিকে, ২০১৫ সালে এমআরআই মেশিনটি স্থাপন করা হয় চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে। স্থাপন করার পর চার বছর সচল থাকলেও, ২০১৯ সালে অকেজো হওয়া মেশিনটিও আজ পর্যন্ত সচল করা সম্ভব হয়নি।
হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, 'আমি দায়িত্ব নেয়ার পর মেশিনটি সচল করতে একাধিকবার চিঠি প্রেরণ করেছি। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এক কোটি টাকার উপর খরচ হবে বলে জানিয়েছিল। তাই এখন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সিদ্ধান্তের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হচ্ছে।'
চট্টগ্রামের মতোই ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে দুটি এমআরআই মেশিনই নষ্ট হলেও ঠিক করা যায়নি। জানা গেছে, ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে রেডিওলজি বিভাগের এমআরআই মেশিনটি গত ২ ফেব্রুয়ারি থেকে নষ্ট আছে। এর আগে করোনার সময় বহির্বিভাগের এমআরআই মেশিনটি নষ্ট হয়।
হাসপাতালে পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক টিবিএসকে বলেন, 'যে প্রতিষ্ঠান থেকে রেডিওলজি বিভাগের এমআরআই মেশিনটি কেনা হয়েছিল, তাদের ইঞ্জিনিয়াররা জানিয়েছেন এটি আর চালু করা সম্ভব নয়। এ কারণে হাসপাতালে রোগীদের জন্য এমআরআই সেবা পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। বিষয়টি আমরা মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি।'
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর (এইচএসএম) প্রফেসর ডাঃ মোঃ মাজহারুল হক টিবিএসকে জানিয়েছিলেন, সরকারি হাসপাতালের বিকল চিকিৎসা সরঞ্জামাদি সচল করার উদ্যোগ নিয়েছে মন্ত্রণালয়।