রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ১০ বছর পূর্তি হলো আজ
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির আজ ১০ বছর পূর্তি হলো। ২০১৩ সালের এইদিন সকালে ভয়াবহ এক ভবন ধসে প্রাণ হারান কমবেশি ১ হাজার ১৩৬ জন শ্রমিক, আহত হন দুই হাজারেরও বেশি মানুষ। বিশ্বের পোশাক শিল্পের ইতিহাসে এই ট্রাজেডি অন্যতম শিল্প দূর্ঘটনা হিসেবে পরিচিত।
অন্যান্য বছরের মত এ বছরও এই দিনটিতে রানা প্লাজা ধসে নিহতদের স্বরণে সকাল থেকেই রানা প্লাজার সামনে জড়ো হয়েছেন দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিক, নিহত শ্রমিকদের পরিবার-স্বজন, বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
এছাড়াও, দিনটি উপলক্ষে সকাল থেকে রানা প্লাজার সামনে নির্মিত অস্থায়ী বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান তারা। এসময় পৃথকভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি ও সভা-সমাবেশ পালন করে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন।
অধিকার সংগঠনগুলো এসময় বিভিন্ন দাবি উত্থাপন করেন। এরমধ্যে রানা প্লাজা ধসের জন্য দায়ী সকলের পরিচয় প্রকাশ, ভবন মালিক সোহেল রানাসহ সকল দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা, সারাদেশের ৪০ লাখ পোশাক শ্রমিকের জন্য অবিলম্বে মজুরি বোর্ড ও ২৫ হাজার টাকা নূন্যতম মজুরি নির্ধারণ, মজুরি বৃদ্ধির আগ পর্যন্ত ৬০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা প্রদান, ক্ষতিপুরণের আইন বদল করে রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় নিহত শ্রমিকের পরিবারের সদস্যদের ক্ষতিপূরণ প্রদান, আহত শ্রমিকদের একজীবনের সমপরিমাণার আয়ের ক্ষতিপুরণ, আহত শ্রমিকদের দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসার ও প্রয়োজনীয় পূর্নবাসন, রানা প্লাজা এলাকা যথাযথ সংরক্ষণ ও স্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি, সকল শ্রমিকদের জন্য মালিক-সরকার ও বায়ারের উদ্যোগে জরুরি তহবিল গঠন এবং ২৪ এপ্রিলকে জাতীয়ভাবে শোক দিবস ও নিরাপত্তা দিবস হিসাবে সকল কারখানা বন্ধ ঘোষণা করার দাবি জানানো হয়।
এ সময় মাসুদা নামে রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় আহত এক পোশাক শ্রমিক বলেন, "আমরা সেদিন ভবনে ঢুকতে চাইনি। কারখানার কর্মকর্তারা জোর করে আমাদের কারখানায় কাজে নিয়েছেন। এর পরই দূর্ঘটনা ঘটে। মুহূর্তের মধ্যে সব অন্ধকার হয়ে যায়।"
"৪ ঘন্টা ধ্বংসস্তুপে আটকে থাকার পর আমাকে উদ্ধার করা হয়, স্পাইনাল কর্ডে ইনজুরি নিয়ে সাড়ে ৩ মাস পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলাম। আজও পুরোপুরি সুস্থ হতে পারিনি, আজও রাত হলে যন্ত্রণায় ছটফট করি," যোগ করেন মাসুদা।
তিনি বলেন, "আজ ১০ বছর পার হয়ে গেলো, অথচ আমরা কোনো ক্ষতিপূরণ পাইনি। প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে ৬০ হাজার টাকা পেয়েছিলাম, এছাড়া আর কোনো ক্ষতিপূরণ পাইনি। আমরা চাই, অবিলম্বে রানাসহ সকল দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা হোক, একইসঙ্গে রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় আহত সকল শ্রমিককে এক জীবনের সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণ, আমাদের পুনর্বাসন ও নিয়মিত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হোক।"
এদিন জয়পুরহাট জেলা থেকে রানা প্লাজার সামনে এসেছিলেন ফেরদৌসী বেগম নামে ষাটোর্ধ এক নারী।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, "আমার ছেলে মাহিদুল ইসলাম কাজ করতো রানা প্লাজার ৫ম তলায়। আজ ১০ বছর পার হলো, আজও আমার ছেলের সন্ধান জানিনা, লাশটাও পাইনি। যত কষ্টই হোক, তাই প্রতি বছর এই দিনে ছুটে আসি এখানে, মনে হয় এখানেই মিশে আছে আমার সন্তান।" কথা বলার এক পর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
ফেরদৌসী বেগম বলেন, "আমি কিচ্ছু চাইনা, শুধু আমার সন্তানকে ফিরিয়ে দেওয়া হোক, মারা গেলে জানতে চাই, কোথায় তাকে দাফন করা হয়েছে। আর কিচ্ছু চাইনা আমি।"
বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড'কে বলেন, ১০ বছর পার হয়ে গেলো অথচ আজও দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করা হয়নি। "আমাদের ধারণা, যেসব সরকারি কর্মকর্তা, যারা সেসময় দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন, স্থানীয় মেয়রসহ, যারা রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় হওয়া বিভিন্ন মামলায় আসামী, তাদের বাঁচাতে, রেহাই দিতেই এই গড়িমসি হচ্ছে।"
তিনি বলেন, পোশাক শিল্পের ইতিহাস বলতে গেলে রানা প্লাজা সামনে আসে। রানা প্লাজা ধসের পরই বদলে গেছে অনেক কিছু। তাই ২৪ এপ্রিল দিনটিকে রানা প্লাজা দিবস হিসাবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পালনের ব্যবস্থা করা হোক।
"রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় আহত সকল শ্রমিককে এক জীবনের সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণ, আহত ও নিহত শ্রমিকের পরিবারকে পুনর্বাসন ও আহত শ্রমিকদের আমৃত্যু চিকিৎসার ব্যবস্থা করার দাবি জানাই আমরা, যোগ করেন তিনি।