‘স্বপ্নকে দুঃস্বপ্নে রূপান্তর করে পরের ঘরে আশ্রিত করেছে রানা প্লাজা’
"২০০২ সালে বাবা মারা যায়। এরপর থেকেই আমাদের পরিবারের বেঁচে থাকার যুদ্ধ শুরু হয়। মা আর ৪ ভাই বোনের সংসারে আমরা দুই বোন, আমি আর কবিতা চাকরি করতাম রানা প্লাজার ৮ম তলায় নিউ ওয়েভ স্টাইল লিমিটেডে। সবারই কম বেশি স্বপ্ন থাকে জীবন নিয়ে, আমারও ছিল। কিন্তু রানা প্লাজা সব স্বপ্নকে দুঃস্বপ্নে রূপান্তর করে আজ পথে বসিয়েছে, পরের ঘরে আশ্রিত করেছে। পঙ্গু হয়ে আজ ১০টা বছর বোনের ঘরে আশ্রিত হয়ে আছি," কথাগুলো দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলছিলেন রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় আহত পোশাক শ্রমিক মোছাঃ বুলবুলি।
আজ থেকে ১০ বছর আগে, ২০১৩ সাথে ২৪ এপ্রিল পোশাক শিল্পের ইতিহাসে ভয়াবহ ট্র্যাজেডি রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন তিনি।
বুলবুলি পোশাক খাতে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন ২০১০ সালের দিকে। রানা প্লাজা দুর্ঘটনারও বছর তিনেক আগে। পিতৃহারা হয়ে অন্যান্য ভাই বোনের মত জীবিকার তাগিদে তৎকালীন সাভারের উলাইলে অবস্থিত আল ইসলাম নামে একটি পোশাক কারখানায় মাত্র ১৬শ টাকা বেতনে যোগদানের মাধ্যমে পোশাক খাতে কর্মজীবন শুরু করেন এই নারী। অন্য সকলের মত বুলবুলিরও স্বপ্ন দেখতেন সমাজে খেয়েপরে ভালোভাবে বেঁচে থাকার।
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ১০ বছর পূর্তিতে আজ সোমবার (২৪ এপ্রিল) অন্য অনেকের মত স্ক্রেচে ভর দিয়ে বুলবুলিও এসেছিলেন সাভারের ধসে পড়া সেই রানা প্লাজার সামনে। ক্ষতিপূরণসহ বিভিন্ন দাবিতে অন্যান্য বছরের মত এবারও তিনি দাঁড়িয়েছেন দুর্ঘটনার ওই স্থানে।
রানা প্লাজা ধসের সেই ভয়াবহ দূর্ঘটনার স্মৃতিচারণ করে এ সময় বুলবুলি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "দুর্ঘটনার দিন সকালে (২৪ এপ্রিল ২০১৩) আমি আর আমার বোন কারখানার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। কেন যেন মন চাচ্ছিলো না উপরে উঠতে। এক পর্যায়ে আমাদের কারখানার প্রোডাকশন ম্যানেজার রানা আমাদের জোর করে উপরে নিয়ে যান। আমার বোন কেন যেন আমার হাত চেপে ধরেছিল তখন। মনের ভিতরে সকাল থেকেই কেমন যেন করছিল। তাও কাজ শুরু করলাম। এক পর্যায়ে বিদ্যুৎ চলে গেল। লাইনম্যানকে বললাম জেনারেটর চালু করতে। বললো (লাইনম্যান), জেনারেটর নষ্ট। এরপর হঠাৎ দেখলাম একটা আলো, সাথে সাথে প্রচণ্ড ঝাকুনি, এরপরই সব অন্ধকার।"
"১২ ঘন্টা আটকে ছিলাম আমি ধ্বংসস্তুপের ভেতর। মেরুদণ্ডের একটা হাড় ভেঙ্গে যায়, বেশ কয়েকটা আঙ্গুল ভেঙে যায়। এখনো ঠিকমতো হাটতে পারিনা, দাড়াতে পারিনা। একটা হাত অবশ। যখন জ্ঞান ফেরে তখন আমি হাসপাতালের বেডে। আমার বোন কবিতা অবশ্য দূর্ঘটনার পরপরই জীবিত উদ্ধার হয়," বলছিলেন বুলবুলি।
টিবিএসের সঙ্গে কথা বলার সময় আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। বারবার চেষ্টা করছিলেন এক হাতে চোখের পানি মুছে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে।
বুলবুলি বলেন, "রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর থেকে এখন পর্যন্ত আমি আমার মা ছোট বোনের বাসাতেই আছি। সে এখনো অবিবাহিত। কবিতাও রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় আহত হয়, তবে সুস্থ হওয়ার পর আবারো যোগ দেয় একটি পোশাক কারখানায়। কিন্তু আমি তো পঙ্গু হয়ে গেছি, আমি কোনো কাজ করতে পারিনা। আমাকে এখন বোনের আশ্রয়েই থাকতে হয়। কিন্তু এভাবে কতদিন বেঁচে থাকা যায়?"
"রানা প্লাজা ধসের ৫ বছর পর একজনকে বিয়ে করি। কিন্তু পঙ্গু মানুষকে নিয়ে আর কে থাকতে চায়। ১ বছর সংসার করার পর সেও চলে গেছে। এখন আবারও বোনের ঘরে আশ্রিত হয়ে বেঁচে আছি", যোগ করেন তিনি।
বুলবুলি বলেন, "আমি রানা প্লাজার যেই কারখানায় কাজ করতাম, সেটির মালিকের এখন গাজীপুরে একাধিক ফ্যাক্টরি। হাজার হাজার শ্রমিক। গাড়ি-বাড়ি সম্পদ কোনো কিছুর অভাব নেই তাদের। কিন্তু আমরা কি পেলাম? রানা প্লাজা ধসের পর মাত্র ৫০ হাজার টাকা সহযোগিতা পেয়েছিলাম, এর কয়েকগুণ বেশি অর্থ খরচ হয়েছে আমার চিকিৎসায়। এখন চিকিৎসাও করতে পারিনা। দোষীদের কোনো শাস্তি হয়নি আজও।"
এসময় তিনি আবারও সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণ ও অবিলম্বে রানা প্লাজার মালিক রানাসহ সকল দোষীদের অবিলম্বে শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানান।
শুধু বুলবুলি নন, তার মত অনেকেই আছেন, যারা রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় আহত হয়ে এখনো বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন। অনেকেই আছেন যারা সব হারিয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করে পরিবারের অন্য সদস্যদের উপর নির্ভরশীল হয়ে বেঁচে আছেন, ক্ষতিপূরণের দাবিতে পথে পথে ঘুরে ফিরছেন।
রানা প্লাজা ট্রাজেডির ১০ বছর পূর্তিতে বিভিন্ন অধিকার সংগঠনগুলো বলছে, পোশাক শিল্পের ইতিহাসে ভয়াবহ এই দুর্ঘটনা সারাবিশ্বের পোশাক শিল্পে এক নতুন পরিবর্তন আনে। কিন্তু এই দূর্ঘটনায় যারা বেঁচে ফিরেছেন, তাদের জীবনে কোনো পরিবর্তন আসেনি, বরং ক্ষত বয়ে নিয়ে এক দুর্বিষহ জীবন যাপন করছেন আহত প্রত্যেকে।
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ১০ বছর পূর্তিতে আজ সকালে রানা প্লাজার সামনে নির্মিত স্মৃতি স্তম্ভের সামনে জড়ো হয়ে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দাবি তুলে ধরা হয়।
যার মধ্যে অন্যতম হলো- সকল দোষীদের পরিচয় জনগণের সামনে প্রকাশ, সারাদেশের ৪০ লাখ পোশাক শ্রমিকের জন্য অবিলম্বে মজুরি বোর্ড ও ২৫ হাজার টাকা মজুরি নির্ধারণ, মজুরি বৃদ্ধির আগ পর্যন্ত ৬০% মহার্ঘ ভাতা দাবি, ক্ষতিপুরণের আইন বদল করে রানা প্লাজা ট্রাজেডিতে আহত ও নিহত শ্রমিকের পরিবারকে একজীবনের সমপরিমাণ ক্ষতিপুরণ প্রদানের দাবি, আহত শ্রমিকদের দীর্ঘমেয়াদী শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির দায়, চিকিৎসাভার ও প্রয়োজনীয় পূর্নবাসন নিশ্চিত করা, রানা প্লাজা এলাকা যথাযথ সংরক্ষণ ও স্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা, সকল শ্রমিকদের জন্য মালিক-সরকার ও বায়ারের উদ্যোগে জরুরি তহবিল গঠন এবং ২৪ এপ্রিল শোক ও নিরাপত্তা দিবস হিসাবে সকল কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা।