হিটস্ট্রোকে মারা যাচ্ছে ব্রয়লার মুরগি, খরচ বাড়ছে পশুপালনে
ফেনীর আমানউল্লাহ মুন্সির খামারে দুটি শেডের ২৫০০ মুরগি রয়েছে। কিন্তু জেনারেটর না থাকায় প্রতিদিন ১৬-১৭ ঘণ্টার লোডশেডিংয়ে এই খামারির গত সপ্তাহখানেক ধরে গড়ে ৪০টির মত ব্রয়লার মুরগির মারা যাচ্ছে।
তিনি বলেন, 'একদিকে তীব্র গরম, অন্যদিকে লোডশেডিং। দুয়ে মিলে মুরগির অবস্থা খারাপ, প্রতিদিনই হিটস্ট্রোকে মুরগি মারা যাচ্ছে। ফ্যান চালানো যাচ্ছে না, রাতের বেলা আলো দেওয়া যাচ্ছে না।'
আমানউল্লাহ মুন্সির মত অবস্থা সারাদেশের ছোট ও মাঝারি খামারির। দেশের বেশ কয়েকটি জেলার খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৬-৭ ঘণ্টার বেশি কোথাও বিদ্যুৎ থাকে না। যে কারণে সারাদেশেই ব্যাপকহারে মুরগি মারা যাচ্ছে। কমে যাচ্ছে মাংসের উৎপাদন। এই পরিস্থিতিতে খামারিরা নতুন করে বাচ্চা উৎপাদনে যাচ্ছে না, ফলে বাচ্চার দামও পড়ে যাচ্ছে।
অন্যদিকে গরু-ছাগল মারা যাওয়ার খবর পাওয়া না গেলেও গবাদিপশুর খামারিরা বিপাকে পড়েছে, তাদেরকে জেনারেটরের পেছনে অতিরিক্ত খরচ করতে হচ্ছে। যে কারণে আগামী কোরবানিতে মোটাতাজা করা গরুর খরচ ২০ শতাংশ বেড়ে যেতে পারে বলে জানা গেছে।
পোল্ট্রি খামারিরা জানান, রাতের বেলা কিছুটা স্বস্তি থাকলেও বিপদে পড়তে হচ্ছে দিনের বেলা। এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকলে ২-৩ ঘণ্টা থাকে না। প্রচন্ড গরমে মুরগি বাঁচানো যাচ্ছে না। আবার যারা জেনারেটর ব্যবহার করছে তাদের প্রতিদিন ১৫০০-১৮০০ টাকার বাড়তি তেল কিনতে হচ্ছে।
নরসিংদীর পোল্ট্রি খামারি মো. সুমনের ফার্মে এখন ৩ হাজার মুরগি রয়েছে। কিন্তু প্রতিদিনই হিটস্ট্রোকে মুরগি মরছে ৫-৭টা করে। লোডশেডিংয়ে বিকল্প জেনারেটর ব্যবহার করেও মুরগির হিটস্ট্রোক ঠেকানো যাচ্ছে না।
তিনি জানান, প্রতিদিনই ১৮০০ টাকার তেল লাগছে, কারণ ১৮ ঘণ্টার মত লোডশেডিং হচ্ছে। এই সময়টা পুরোটাই জেনারেটরে ব্যাকআপ দিতে হচ্ছে।
নরসিংদীর পোল্ট্রি কনসালটেন্ট মো. রমজান আলী পোল্ট্রি মুরগির চিকিৎসা করে থাকেন। তিনি বলেন, 'এখন ৯৯ শতাংশ সমস্যাই পাচ্ছি হিটস্ট্রোক। অনেকের মুরগি মরে যাচ্ছে গরমের কারণে।'
তিনি বলেন, 'তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রির বেশি হলেই সেটা পোল্ট্রির জন্য সমস্যা। কিন্তু যখন লোডশেডিং হচ্ছে তখন ছোট খামারিরা গরমে আর মুরগি বাঁচাতে পারছে না।'
বাংলাদেশ পোল্ট্রি এসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার টিবিএসকে বলেন, 'সারাদেশেই ছোট-মাঝারি খামারগুলোতে ব্যাপকহারে মুরগি মরছে। এর প্রধান কারণ লোডশেডিং। এই অবস্থা থাকলে আর ছোট খামার টিকবে না।'
এদিকে মাসখানেক সময়ও নেই কোরবানির ঈদের। কিন্তু লোডশেডিংয়ের প্রভাবে ব্যাপক সমস্যার মধ্যে পড়তে হচ্ছে খামারিদের। ফ্যান ও বিদ্যুতের জন্য তাদের নিয়মিত জেনারেটরে ভরসা করতে হচ্ছে। ঈদের আগে যেন কোনোভাবেই মোটাতাজাকরা গরুগুলো অসুস্থ না হয়, সেজন্য যা যা দরকার সবই করছে খামারিরা। এটা করতে গিয়েই ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।
আশুলিয়ার শিকড় এগ্রো ফার্মের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী মোহাম্মদ আবু সুফিয়ান টিবিএসকে বলেন, 'চলমান এই লোডশেডিংয়ের কারণে একদিকে যেমন আমাদের খরচ ২০-৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যাচ্ছে, অপরদিকে এই প্রচণ্ড গরমে খামারের পশুগুলো নিয়েও ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।'
তিনি বলেন, 'আমাদের ফার্মে এখন ১২০টি গরু রয়েছে যার অধিকাংশই কোরবানির ঈদের জন্য আমরা লালনপালন করেছি। এর মধ্যে একটা বড় অংশের পশুই কিন্তু ৫০০ কেজি থেকে শুরু করে ৮০০ কেজি বা তারও উপরে। গরুগুলোকে নিয়মিত চারপাশ থেকে ফ্যান দিয়ে রাখতে হয়, যেটি আমরা করতে পারছি না ক্রমাগত লোডশেডিংয়ের কারণে। যে কোন সময় গরুগুলো অসুস্থ হয়ে যেতে পারে, দিনের একটা বড় সময় আপাতত জেনারেটর চালাচ্ছি, এতেও খরচ বাড়ছে।'
তিনি বলেন, 'এতে করে অতিরিক্ত গরমের কারণে গরুগুলোর হিট স্ট্রোক করার ঝুঁকিও কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে আমাদের অতিরিক্ত জনবলও নিয়োগ দিতে হয়েছে খামারে।'
সাভার উপজেলা প্রাণীসম্পদ অফিস সূত্রে জানা যায়, উপজেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার গরুর ফার্ম আছে। এছাড়া পোল্ট্রি ফার্ম আছে ২ শতাধিক।
সাভার উপজেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. সাজেদুল ইসলাম বলেন, 'ফার্মগুলোতে সার্বক্ষণিক বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়, কাজেই চলমান এই লোডশেডিংয়ের কারণে প্রতিটি খামারই একটা বড় সমস্যা ফেইস করছে। তারা বাধ্য হচ্ছেন জেনারেটর দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে। এতে করে যেটি হচ্ছে যে খামারে ওভারঅল ১৫-২০ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। আবার একটি বড় অংশের গরুর খামার কিন্তু কোরবানির ঈদ মাথায় রেখে পশু লালনপালন করে, কাজেই এই অতিরিক্ত ব্যয় কিন্তু বাজারে এসব পশুর মূল্যে প্রভাব ফেলবে।'
বিদ্যুৎ না থাকার কারণে ফ্যাটেনিং করা গরুগুলো নিয়ে সারাদেশের খামারিরাই দুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছে বলে জানা যায়। কারণ একটা গরু কোন কারণে মারা গেলে লাখ টাকা বা তারও বেশি ক্ষতির মুখে পড়তে হবে।
শুধু ছোট খামারিরাই নয়, খারাপ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে মুরগির বাচ্চা, ফিড ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রেডের মুরগি উৎপাদনকারীরা। সেক্টরের উদ্যোক্তারা জানান, লোডশেডিং এবং চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে গত মে মাসেই এক লাখ টনের বেশি ফিডের উৎপাদন কমে গেছে। প্রতি মাসে গড়ে সাড়ে চার লাখ টনের বেশি খাবার লাগে মাছ, মুরগি ও গরু-ছাগলের খামারে। মুরগির বাচ্চার দাম উৎপাদন খরচের নিচে নেমে গেছে যা এখন ১৫-২৫ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে।
প্রথম সারির একটি ফিড মিল ও মুরগি উৎপাদনকারী কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, '১৪ ঘণ্টা লোডশেডিং হলে ফিডমিল চালানো খুবই কষ্টকর। আবার একই পরিস্থিতিতে বাচ্চা উৎপাদন করতে গেলে খরচ হয়ে যাচ্ছে দ্বিগুণ, কিন্তু দাম নেমে গেছে তলানিতে।'