ভেদা মাছের বিলুপ্তি ঠেকানোর সংগ্রামে সান্তাহার প্রজননক্ষেত্র
শরীরজুড়ে কালচে-সবুজ ছোপ ছোপ দাগ থাকায় ভেদা মাছকে (গ্যাঙ্গেটিক লিফফিশ) প্রথম দেখাতে সহজেই কই মাছ (আনাবাস কোবোজিউস) ভেবে ভুল করে বসতে পারে যে কেউ। তবে বাজারে প্রচুর কই মাছ পাওয়া গেলেও প্রজনন স্থলের অভাবে ভেদা মাছ এখন বিলুপ্তীর পথে।
এই মাছ অঞ্চলভেদে ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত। উত্তরাঞ্চলে এই মাছকে 'ভেদা' বলে। অনেকে চেনেন 'মেনি মাছ' নামেও। কেউ কেউ এই মাছকে 'নন্দই' বা 'রয়না' বলেও জানেন।
এক সময় দেশের খালে-বিলে-হাওরে অহরহ পাওয়া যেত ভেদা মাছ। বর্ষাকালে প্লাবিত ধান ক্ষেত বা পাট ক্ষেতেও পাওয়া যেত। কিন্তু প্রধানত ফসলি জমিতে রাসায়নিক ও কীটনাশকের অত্যধিক ব্যবহার, পরিবেশ দূষণ, জলাশয়ের অভাব এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এটি এখন বিলুপ্তির পথে।
অন্যান্য মাছের মতো ভেদার বাণিজ্যিক চাষ হয় না। তবে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ইতিমধ্যে গবেষণাগারে এই প্রজাতির প্রজনন করেছে এবং এখন এই মাছ চাষে বড় পরিকল্পনা নিয়েছে।
বিজ্ঞানীদের দাবি, দেশে এমনকি সম্ভবত বিশ্বেও এই মাছের কৃত্রিম প্রজনন হয় শুধুমাত্র বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সান্তাহার প্লাবনভূমি উপকেন্দ্রে।
ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'ভেদা একটি দেশি মাছ। আমরা এর ব্যাপক চাষের পরিকল্পনা করেছি। আমরা প্রায় ৬৪টি বিলুপ্ত মাছ নিয়ে গবেষণা করেছি। এর মধ্যে প্রায় ৪০টি মাছের কৃত্রিম প্রজনন করা হয়েছে। এটি ইনস্টিটিউটের জন্য একটি বিশাল অর্জন।
স্বায়ত্তশাসিত সরকারি প্রতিষ্ঠানটির সদর দপ্তর ময়মনসিংহে অবস্থিত। বিভিন্ন জলজ বাস্তুতন্ত্রের উপর ভিত্তি করে সারা দেশে এর পাঁচটি স্টেশন এবং পাঁচটি সাব-স্টেশন রয়েছে।
ইনস্টিটিউটটি পুকুর ভিত্তিক মৎস্য চাষের উন্নয়ন, উন্নত মাছের জাত উন্নয়ন, মাছের পুষ্টি ও খাদ্যের উন্নয়ন, রোগ নিয়ন্ত্রণ, স্বাদু পানিতে ঝিনুকের মুক্তা উৎপাদন এবং বিপন্ন মাছের জিন পুল সংরক্ষণের উপর গবেষণা পরিচালনা করে।
সান্তাহার উপকেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডাঃ দেবিত রিন্টু দাস বলেন, পাঁচটি উপকেন্দ্রের মধ্যে সান্তাহারে ভেদা, বাতাসি, কাজলি, কাকিলা, গাং টেংরা এবং রানী সহ ১৬ প্রজাতির দেশীয় ছোট মাছের উপর গবেষণা চলছে, যেগুলো প্রায় বিলুপ্ত হতে চলেছে।
ভেদা মাছ (বৈজ্ঞানিক নাম নান্দুস নান্দুস) প্রায় ২০ সেন্টিমিটার লম্বা। এরা সাধারণত মাংসাশী এবং জলজ পোকামাকড়, পোকার লার্ভা এবং ছোট মাছ খায়। এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর তাদের প্রজনন মৌসুম।
রিন্টু বলেন, আমরা এই মাছটি ২০০৪-২০০৫ সালে উপকেন্দ্রের প্লাবনভূমিতে নিয়ে এসেছি এবং এর সংরক্ষণ, লালন-পালন এবং প্রজনন কার্যক্রম পরিচালনা করেছি।
তিনি আরও বলেন, সারাবিশ্বে শুধু সান্তাহার উপকেন্দ্রেই ভেদা মাছের এই কৃত্রিম প্রজনন হয়। এই মাছ সংরক্ষণের জন্য উপযুক্ত মাটি ও পানি প্রয়োজন।
প্রতি বছর প্রায় এক লাখ ভেদা মাছের পোনা চাষীদের মধ্যে বিতরণ করা হয় এবং পোনার সরবরাহ ক্রমান্বয়ে বাড়ানো হবে উল্লেখ করে রিন্টু দাস বলেন, প্রতিষ্ঠানটি কৃষকদের স্বল্পমূল্যে মাছের পোনা সরবরাহ করায় এখন পুকুরে এসব দেশি মাছ চাষ করা হচ্ছে।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২৬০টি মিঠা পানির মাছের ৬৪ প্রজাতি এখন বিপন্ন। এর মধ্যে নয়টি গুরুতরভাবে বিপন্ন, ৩০টি বিপন্ন এবং ২৫টি বিপন্ন হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
প্লাবনভূমি উপকেন্দ্রে বিলুপ্তপ্রায় বিভিন্ন মাছের উপর গবেষণা শুরু হয় ১৯৯৮ সালের দিকে। প্রজননে সাফল্য আসে ২০০৫ সালে। প্রজননে সাফল্যের পর সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে জলাভূমি ও খালে বিভিন্ন মাছের পোনা অবমুক্ত করা হচ্ছে। বেসরকারি হ্যাচারিতে এখনো এসব মাছের প্রজনন হয় না।
আট মাস আগে সান্তাহার থেকে ভেদা মাছের প্রায় ২০০ পোনা ক্রয় করে কৃষক লতিফুল পারভেজ কিছুদিন ধরে নওগাঁর মহদেবপুর উপজেলার ধনজাইল এলাকায় ভেদা মাছ চাষ করছেন। যদিও তিনি এখনো তা বাজারজাত করেননি।
এই কৃষক বলেন, অনেক দেশীয় প্রজাতির মাছ বিলুপ্তির পথে। তবে বিজ্ঞানীরা এই মাছের প্রজননে সফল হয়েছেন, যা ভালো খবর। এখন আমাদের কৃষকদেরও এ নিয়ে কাজ করতে হবে। আমি নিজে ভেদা মাছ চাষ করছি এবং শীঘ্রই বাজারজাত করার পরিকল্পনা করছি।
সান্তাহার উপকেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শিশির কুমার দে জানান, বর্তমানে এই মাছ বাজারে প্রতি কেজি ৫০০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, ছয় মাস পুকুরে চাষ করার পর, প্রতিটি ভেদা মাছের ওজন হবে প্রায় ৪০০ গ্রাম। বাজারে এর চাহিদা ভালো হওয়ায় এটি চাষীদের জন্য লাভজনক হবে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) বৈশ্বিক প্রতিবেদন 'দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার ২০২০' অনুসারে, চীন ও ভারতের পর বাংলাদেশ এখন বিশ্বে স্বাদু পানির মাছ উৎপাদনে তৃতীয় স্থানে রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে পুকুরে মাছ চাষে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে।