ঘোষণা দিয়েও ঢাকার উড়ালসড়কগুলোর নিচ দখল-দূষণমুক্ত করতে পারেনি দুই সিটি
রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোর উপর চাপ কমিয়ে যানজট নিরসনে ঢাকায় তৈরী হয়েছে ১০টির মতো উড়ালসড়ক, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বিআরটি প্রকল্প, মেট্রোরেল সহ বেশ কয়েকটি উড়ালপথ। কিন্তু এসব উড়ালপথের নিচের অধিকাংশ জায়গাই দখল ও দূষণমুক্ত করতে পারেনি ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন।
নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব উড়াল সড়কের নিচে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা দোকানপাট, ট্রাক স্ট্যান্ড, বর্জ্যের ভাগাড়সহ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে জায়গাগুলো নগরবাসীর জন্য বিনোদনের স্থান ও সবুজায়ন করার ঘোষণা দিলেও তা করতে অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছে ঢাকার দুই মেয়র।
শুধু তাই নয়, গত দুই দশকে রাজধানীতে নির্মিত উড়ালপথের নিচে দখল-বেদখল, ব্যবহার-অব্যবহার ও অপব্যবহারে পড়ে আছে প্রায় ২০৭ একর জমি, যার বিভিন্ন নেতিবাচক প্রভাবের ফলে প্রতিবছর সামাজিক, অর্থনৈতিক, পরিবেশগত ও জনস্বাস্থ্যগত ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ওপরে। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা অন্তত ২১ হাজার কোটি টাকা।
জুন মাসে প্রকাশিত জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) অর্থায়নে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইনক্লুসিভ আর্কিটেকচার অ্যান্ড আরবানিজমের (সিআইএইউ) এক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।
এ গবেষণায় বলা হয়, ঢাকার যানজট নিরসনে গত দুই দশকে উড়াল সড়ক, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বিআরটি, ইউলুপ ও মেট্রোরেল সহ নানা ধরনের উড়াল পথ নির্মিত। বিভিন্ন এলাকায় বিস্তৃত মোট ১০৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এসব উড়ালপথের নিচে দখল-বেদখল, ব্যবহার-অব্যবহার ও অপব্যবহারে পড়ে আছে প্রায় ২০৭ একর জমি। ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকায় এটি মূল্যবান নগর-সম্পদের অপচয়।
নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উড়াল পথের নিচের এসব জায়গায় ব্যবহারের নানা উপায় রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এসব জায়গায় শিশুদের জন্য খেলার স্পেস, সবুজায়ন, হাঁটার পথ, জলাধারসহ নানা উপায়ে ব্যবহার করছে। এমনকি এসব স্থান থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার মতোও নানা উদ্যোগ নিতে পারতো সিটি কর্পোরেশন। এসব জায়গা নিয়ে পরিকল্পিত কোনও পদক্ষেপ না নেওয়ায় দখল-দূষণের পাশাপাশি এসব স্থান হয়ে উঠেছে অপরাধী ও মাদকসেবীদের অভয়াশ্রম।
২০২১ সালের ১০ মার্চ ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস ঘোষণা দিয়েছিলেন, যানবাহন চলাচল ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করতে দক্ষিণ সিটির আওতাধীন এলাকায় ফ্লাইওভারের নিচে দখল হয়ে যাওয়া জায়গাগুলো পর্যায়ক্রমে পুনরুদ্ধার করা হবে। এরপরে আড়াই বছর কেটে গেলেও তাপসের প্রতিশ্রুতির তেমন অগ্রগতি দেখা যায়নি।
সে বছরই ১ সেপ্টেম্বর ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলামও বলেছিলেন, "কুড়িল ফ্লাইওভার লেককে নতুন বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত করা হবে। ফ্লাইওভারের নিচে থাকা জলাশয়কে নিয়ে হাতিরঝিলের মতো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে।"
তিনি বিভিন্ন সময় ফ্লাইওভারের নিচের জায়গা দখল ও দূষণমুক্ত করতে নানা পদক্ষেপের কথা বললেও সে প্রতিশ্রুতিরও খুব একটি বাস্তবায়ন দেখা যায়নি।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোঃ আতিকুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "আমরা সেতু কর্তৃপক্ষের সাথে মিটিং করেছি এবং এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে সহ ফ্লাইওভারগুলোর নিচের জমিতে আরবান পার্ক গড়ে তুলতে একটি মডেল তৈরী করেছি। পরীক্ষামূলকভাবে কাওলা এলাকায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নিচের একটি স্থান নির্ধারণ করেছি এবং সে অনুযায়ী ডিজাইন হচ্ছে পার্ক গড়ে তোলার। যেখানে সবুজায়ন, শিশুদের খেলার জায়গা, হাঁটা ও বসার জায়গা তৈরী করা হবে।"
যেসব জায়গা দখল হয়ে আছে সেগুলোর বিষয়ে মেয়র বলেন, "আমরা একে এক দখলমুক্ত করছি। তবে একসাথে সব জায়গা দখলমুক্ত করে রাখা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে ডিএমপির সহযোগিতা প্রয়োজন যাতে আবার দখল হয়ে না যায়।"
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, "যখন ঢাকার উড়ালসড়কের ডিজাইন হয় তখনই এর নিচের জায়গার ব্যবস্থাপনার ডিজাইন হওয়া দরকার কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে পরেও হয় না। পুরো ঢাকার এসব জমি নিয়ে ইন্টিগ্রেটেড প্লানিং দরকার। কোন এলাকায় কোন ধরনের উন্নয়ন হতে পারে তার পুরো একটি প্লান করে সিটি কর্পোরেশনকে কাজ করতে হবে।"
তিনি বলেন, উড়াল সড়কের নিচে কেবল ফুলের গাছ লাগানোই যথেষ্ট নয়, স্থানভেদে সেখানে হতে পারে নান্দনিক পার্ক, জলাধার, হকারদের কর্মসংস্থান এবং পথশিশুদের বিনোদনকেন্দ্র। এমনকি বিভিন্ন প্রাইভেট কোম্পানির কাছে দিয়ে সৌন্দর্য বর্ধনের মাধ্যমে সিটি কর্পোরেশন আয়ও করতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এসব জমি দখল ও দূষণমুক্ত করতে রাজনৈতিক হস্থক্ষেপও দরকার।
দখল-দূষণের ভয়াবহ চিত্র
গত সপ্তাহে রাজধানীর কুড়িল, বাড্ডা, রামপুরা, মহাখালী, মালিবাগ, মৌচাক, খিলগাঁও, তেঁজগাও, ফার্মগেট, মগবাজার, গুলিস্তান, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ি সহ বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে উড়াল সড়কগুলোর নিচের জায়গার দখল-দূষণের ভয়াবহ চিত্র দেখা যায়।
বিজয় সরণি থেকে তেজগাঁও সাতরাস্তাগামী ফ্লাইওভারের নিচে দেখা যায়, নিচের অধিকাংশ জায়গা দখল করেই গড়ে উঠেছে একটি কাঁচাবাজার। এর একটি অংশ দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে থাকার ঘর ও ট্রাক ও রিকশা স্ট্যান্ড।
মগবাজার ফ্লাইওভারের নিচের জায়গায় কোথাও রাখা হচ্ছে ডাম্প করা মোটরসাইকেল, আবার কোথাও বর্জ্যের স্তুপ।
রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকাগুলোর মধ্যে কারওয়ান বাজার অন্যতম। এর কাছেই মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার। ভোরবেলায় সেখানকার মাছ বাজারে বেচাকেনা শুরু হলে ফ্লাইওভারের মগবাজার-কারওয়ান বাজার অংশের নিচের জায়গাটিতেও মানুষের আনাগোনা বাড়তে থাকে।
মগবাজারের বাসিন্দা আবু রায়হান টিবিএসকে বলেন, "উত্তরের মেয়র ঢাকঢোল পিটিয়ে ফ্লাইওভারের কয়েকটি পিলারে আর্ট করে গেলেন কিন্তু এর নিচের উন্নয়নে আর নজর দেয়নি। এখন লোহার গ্রিল দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে কিন্তু ভিতরে ঠিকই বর্জ্য জমছে ও ধুলা উৎপন্ন হচ্ছে।"
শুধু তাই নয়, গত ১০ আগস্ট মগবাজার ফ্লাইওভারের একটি গোপন আস্তানা (সুড়ঙ্গের মতো) থেকে তিন নারী ও এক পুরুষ ছিনতাইকারীকে আটক করে হাতিরঝিল থানা পুলিশ।
মালিবাগ-মৌচাক-খিলগাঁও ফ্লাইওভারের নিচের অংশ দখল করে বেশ কয়েকটি স্থানে তৈরী হয়েছে লেগুনা, রিকশা, মোটরসাইকেল স্ট্যান্ড। মেইন রাস্তার পাশের অংশে বর্জ্য ফেলে দূষণে পরিপূর্ণ করে রেখেছে আশেপাশের ব্যবসায়ীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজারবাগ এলাকার ফ্লাইওভারের নিচের একটি অংশ গাড়ি পার্কিং এর জন্য ইজারাও দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। এর বাহিরেও লেগুনা ও মোটরসাইকেল পার্কিং করা হয় ফ্লাইওভারের নিচের জায়গা দখল করে।
খিলগাঁও, শাহজাহানপুরের ফ্লাইওভারের নিচের অংশ অনেকটাই দখল করে বাসানো হয়েছে কাঠের আসবাবপত্রের দোকান। আছে ময়লার ভাগাড়ও।
রামপুরা, বাড্ডা ফ্লাইওভার ও ইউলুপের নিচের অংশ দখল করে গড়ে উঠেছে নানা দোকানসহ নার্সারী।
কুড়িল ফ্লাইওভারের নিচে অব্যবস্থাপনায় পড়ে আছে অনেক জায়গা। লেকগুলোও হয় না নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ। অবৈধভাবে নির্মিত হয়েছে দোকান সহ অবৈধ স্থাপনা।
এ এলাকা দিয়ে নিয়মিত চলাচলকারী হাসিবুল টিবিএসকে বলেন, "বৃষ্টি হলে কুড়িল ফ্লাইওভারের নিচে চলাচলের উপযোগী থাকে না আবার রোদের সময় ধুলায় অন্ধকার থাকে। ফ্লাইওভারের নিচের কিছু অংশ বর্জ্যে পরিপূর্ণ থাকে আবার কিছু অংশ কাঁদামাটিতে পরিপূর্ণ। এছাড়া অবৈধভাবে গড়ে ওঠা দোকান ও স্থাপনা তো আছেই। এ এলাকার সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনতে অবশ্যই ফ্লাইওভারের নিচেও নজর দিতে হবে সিটি কর্পোরেশনকে।"
প্রায় ১০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের হানিফ ফ্লাইওভারের নিচে হওয়ার কথা ছিল হাঁটার পথ, ফুল বাগান সহ সৌন্দর্যবর্ধনের নানা কিছু। কিন্তু বাস্তবে এর উল্টো চিত্র। ফ্লাইওভারের নিচে ময়লার ভাগাড় থেকে শুরু করে অস্থায়ী ঘরও আছে এর নিচে। শনির আখড়া হতে বকশিবাজার পর্যন্ত বিস্তৃত ফ্লাইওভারের নিচের অংশ অধিকাংশই দখল-দূষণে বিপর্যস্ত। সায়েদাবাদের কিছু এলাকা দখলমুক্ত করলেও দূষণমুক্ত করতে পারেনি সিটি কর্পোরেশন।
সায়েদাবাদ এলাকার পথচারী বিপুল কর্মকার বলেন, "রাস্তার পাশে হাঁটার মতো জায়গা নেই। বাধ্য হয়ে মেইন রাস্তার ভিতর দিয়ে হাঁটতে হয়।"
এ ফ্লাইওভারের নিচে শনির আখড়া-যাত্রাবাড়ী অংশে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে দোকান, রিকশা-ভ্যান স্ট্যান্ড, চায়ের দোকানসহ নানা স্থাপনা। আবার কিছু অংশে তৈরী হয়েছে ময়লার ভাগাড়। যেখানে ফেলা হয় ডাবের খোসা, পলিথিন, নানা পণ্যের বক্সসহ বিভিন্ন বর্জ্য।
টিকাটুলীর রাজধানী সুপার মার্কেট এলাকায় ফ্লাইওভারের নিচে ছিন্নমূল মানুষের বাস। কাপ্তানবাজার অংশে মুরগির খাঁচা ও বর্জ্যের কারণে দুর্গন্ধে ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে চলাই দায়। গুলিস্তান-ফুলবাড়িয়া অংশে ফ্লাইওভারকে ছাদ বানিয়ে জুতার দোকান, ফলের দোকান, ভাতের হোটেল বসানো হয়েছে।
এ রাস্তা দিয়ে নিয়মিত চলাচলকারী রিপন হাওলাদার বলেন, "বিকালে এ রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলারই কোনও উপায় থাকে না। হকারে পরিপূর্ণ থাকে। উপরে ফ্লাইওভারের কারণে গাড়ির গতি বেড়েছে ঠিকই কিন্তু নিচে তো আরও সমস্যা বাড়িয়ে দিয়েছে।"
বঙ্গবাজার থেকে নিমতলী গেটের আগ পর্যন্ত ঘোড়ার আস্তাবল আর ময়লার ভাগাড়। ঘোড়ার বিষ্ঠা আর পাশের মুরগির বাজারের বর্জ্যে প্রচন্ড দুর্গন্ধ ছড়িয়ে থাকে এলাকাজুড়েই।
মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের সায়েদাবাদের একটি বড় অংশ ইজারা দেওয়া হয়েছে বাসসহ বিভিন্ন যানবাহন রাখার জন্য। ফলে জায়গাটি অনেকটাই পরিণত হয়েছে বাস-ট্রাকের স্ট্যান্ডে।
ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে নিয়মিত চলাচলকারী আসগর আলী বলেন, "ময়লা আবর্জনার গন্ধে নিচ দিয়ে চলাই যায় না। সবাই ফ্লাইওভারের নিচে ময়লা ফেলে। কিন্তু কেউ পরিষ্কার করে বলে মনে হয় না।"
এদিকে গত মাসে উদ্বোধন হওয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নিচের খালি জায়গাও অধিকাংশ স্থানে দখলে-দূষণে বিপর্যস্ত। ফার্মগেট এলাকায় দেখা যায়, ইতিমধ্যেই অব্যবস্থাপনার কারণে ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। এমনকি এ অংশে প্রস্রাব-পায়খানা করে আশেপাশে চলাচলের অনুপযোগী করে রাখা হয়েছে।