বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনে বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে
২০২১ সালের আগস্ট মাস। কথা ছিল মামুন সেদিন আনন্দ উৎসবের মধ্যে দিয়ে বিয়ে করবেন। অথচ ঠিক সেদিনই তাকে নিজের ১৬ জন আত্মীয়কে কবরস্থ করতে হয়। কেননা বিয়েতে আসতে যেয়ে বজ্রপাতে প্রাণ হারিয়েছেন তারা। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগটিতে মৃত্যু বাংলাদেশে যেন বেশ সাধারণ চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। খবর বিবিসির।
জাতিসংঘের তথ্যমতে, প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রবল ঝড়ের সময় বজ্রপাতে গড়ে ৩০০ জন মারা যায়। অথচ অপেক্ষাকৃত দিগুণ জনসংখ্যার দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই মৃত্যুর হার গড়ে মাত্র ২০ জনেরও কম।
সেই হৃদয়বিদারক দিনটি নিয়ে বিবিসির সাথে কথা বলেছেন দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের শিবগঞ্জ এলাকায় বাসিন্দা মামুন। তিনি যখন বরের সাজ সাজছিলেন তখন বজ্রপাতের তীব্র শব্দ শুনতে পান। ঠিক তার কিছুক্ষণ পর সে মৃত্যুর কথা শুনতে পেয়ে ঘটনাস্থলে হতভম্ব হয়ে দ্রুত উপস্থিত হন।
সেই দৃশ্যের বর্ণনা দিতে যেয়ে মামুন বলেন, "কিছু লোক লাশগুলো জড়িয়ে ধরেছিল। আহতরা যন্ত্রণায় চিৎকার করছিল... শিশুরা কান্না করছিল। আমি দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম। আমি আগে কার কাছে যাব সেটাও ঠিক করতে পারছিলাম না।"
সেই ঘটনায় মামুন নিজের বাবা, দাদা-দাদি, চাচাতো ভাই, চাচা এবং খালাকে হারিয়েছিলেন। তার মা নৌকায় না থাকায় বজ্রপাত থেকে বেঁচে যান।
মামুন বলেন, "বাবার মৃতদেহ দেখে আমি কান্নায় ভেঙে পড়ি। আমি এতটাই হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম যে, আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম।"
সন্ধ্যার দিকে নিজের এতজন স্বজনকে দাফন করেন মামুন। আর বিয়ের জন্য যে খাবারের আয়োজন করা হয়েছিল সেটি গরীব মানুষের মাঝে ভাগ করে দেওয়া হয়।
পরবর্তীতে মামুন বিয়ে করেছে ঠিকই, তবে আজ পর্যন্ত তিনি নিজের বিবাহবার্ষিকী পালন করেননি। কেননা সেদিন ঐ ঘটনায় তার জীবনে যে শুন্যতা তৈরি হয়েছে সেটি চাইলেও সে ভুলতে পারবেন না।
মামুন বলেন, "মর্মান্তিক ঘটনার পর এখন আমি বৃষ্টি ও বজ্রপাতকে ভয় পাই।"
বজ্রপাত বেশ মরণঘাতী। দেশে বন্যার থেকেও বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয় এটি। বজ্রপাতের মৃতের সংখ্যা ১৯৯০-এর দশক থেকে প্রতি বছর বহুগুণে বেড়েছে। নাসা, জাতিসংঘ ও বাংলাদেশ সরকার এতে মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝড়ের বৃদ্ধিকে উল্লেখ করেছে।
এই বিষয়ে বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের মহাপরিচালক মোঃ মিজানুর রহমান বিবিসিকে বলেন, "বৈশ্বিক উষ্ণতা, পরিবেশগত পরিবর্তন, জীবনযাত্রার ধরণ সবই বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধির কারণ।"
বজ্রপাতের ভয়াবহতা বিবেচনা করে বাংলাদেশ সরকার বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প ও খরার মতো বজ্রপাতকেও সরকারি দুর্যোগের তালিকায় যুক্ত করেছে।
দেশে বজ্রপাতের শিকার অধিকাংশই কৃষক। তারা গ্রীষ্ম, বর্ষাকালের ঝড়, বৃষ্টিতে মাঠে কাজ করে। সাতক্ষীরায় একটি মাঠের পাশে বেড়ার উপর ঝুলতে থাকা একটি ফুটবল জার্সি যেন এমন স্মৃতিকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। কেননা কিছুদিন আগেই এটি পরে ছিলেন আব্দুল্লাহ নামের এক কৃষক। যিনি বজ্রপাতে নিহত হয়েছেন।
আব্দুল্লাহর স্ত্রী রেহানা বিবিসিকে জানান, রৌদ্রজ্জ্বল একটি দিনে তার স্বামী অন্য কৃষকদের সাথে মাঠে কাজে যায়। তবে শেষ বিকেলে প্রবল ঝড় শুরু হয়। তখন বজ্রপাতের কবলে পরে তার স্বামী।
গলি বরাবর একটি ছোট খুপরি দেখিয়ে রেহানা বলেন, "ঘটনার পর রাস্তার পাশের এই দোকানে তাকে নিয়ে আসেন আরও কয়েকজন কৃষক। কিন্তু ততক্ষণে তিনি মারা গিয়েছিলেন।"
দম্পতিটি সম্প্রতি বাড়িতে দ্বিতীয় ঘর তৈরির জন্য ঋণ নিয়েছিলেন। তার স্বামীর মৃত্যুর পর কোনো প্রাথমিক উপার্জনকারী না থাকায় রেহানা এখন বেশ অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছেন।
কান্নারত অবস্থায় রেহানা বলেন, "ভয়টা আমাকে এত গভীরভাবে আঁকড়ে ধরেছে যে, এখন যদি আমি আকাশে মেঘ দেখি তবে আমি আমার ছেলেকে আর বাইরে যেতে দেবার সাহসও করি না।"
শুধু বাংলাদেশই নয়, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও সম্প্রতি বজ্রপাতের প্রবণতা বেড়েছে। তবে বেশ কয়েকটি উদ্যোগ গ্রহণের ফলে হতাহতের সংখ্যা প্রতিবেশী দেশটিতে বেশ কমে এসেছে। ফলে এর থেকে প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষের জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশেও বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এক্ষেত্রে বজ্রপাতের প্রবণতা কমাতে প্রত্যন্ত গ্রামীণ এলাকায় আরও লম্বা গাছ লাগানো দরকার। বিশেষ করে এমন জায়গায় সেগুলো লাগাতে হবে যেখানে বন উজাড়ের প্রভাব পড়েছে। অন্যদিকে কৃষকদের জন্য মাঠের আশেপাশে ছাউনি নির্মাণ ও ঝড়ের আগাম বার্তা হিসেবে ওয়ার্নিং সিস্টেমের মাধ্যমে বাসিন্দাদের সতর্ক করা যেতে পারে।
বজ্রপাতের মৃত্যুর ক্ষেত্রে আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে সচেতনতার অভাব। দেশের বেশিরভাগ লোকই এর ভয়াবহতা সম্পর্কে আঁচ করতে পারে না।
ঠিক তেমনি একজন রিপন হোসেন, যিনি আব্দুল্লাহর মৃত্যুর দিন তার পাশেই ছিল। তিনি কখনও ভাবতেও পারেনি যে, বজ্রপাত ঠিক এতটা ক্ষতি করবে।
রিপন হোসেন বলেন, "বেশ জোরে একটি শব্দ হলো এবং তারপর আমি আলোর প্রচুর ঝলকানি দেখলাম। কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে দেখি, আব্দুল্লাহ আর বেঁচে নেই।"
নিজে কীভাবে বেঁচে গেলেন সেটি ভাবতেই রিপনের অবিশ্বাস্য লাগে। তিনি এখন খোলা জায়গায় কাজ করতে ভয় পান। কিন্তু দরিদ্র কৃষি এলাকাটিতে চাষ করা ছাড়া তার আয়ের আর কোনো উপায় নেই।
আব্দুল্লাহর কথা স্মরণ করে রিপন বলেন, "বন্ধু আবদুল্লাহর কথা মনে হলেই রাতে কান্না আসে। রাতে চোখ বন্ধ করলেই সেদিনের সব স্মৃতি ফ্ল্যাশব্যাকের মতো ফিরে আসে। নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারছি না।"