সীমান্তের চাষিদের কপালে চিন্তার ভাঁজ, ফসলভর্তি খেত ফেলে বাড়িঘর ছাড়ছে তাঁরা
৭৩ বছর বয়সী আবু সিদ্দিক বসবাস করেন বান্দরবানের নাইক্ষ্যাংছড়ি উপজেলার তমব্রুর বাজার এলাকার মিয়ানমার সীমান্তবর্তী কোনারপাড়ায়। একেবারে সীমান্তঘেঁষা প্রায় ৫ একর জমিতে, মরিচ, বাদাম, ভূট্টা, আলু, সীম, ফেলু দানা চাষ করেন। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের কারণে গত তিন দিন ধরে তিনি সপরিবারে ঘর ছাড়া। মর্টার শেল ও মুহুর্মুহু গোলাগুলির শব্দের কারণে ভয়ে তিনি ফসলী মাঠে যেতে পারছেন না।
আবু সিদ্দিক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "১ লাখ ৭২ হাজার টাকা শ্রমিক খরচ দিয়েছি কিছুদিন আগে। শুনেছি, আমার জমিতে মানুষের মরদেহ আছে। গোলাগুলির কারণে আমার পরিবারের ১০ জনকে আত্মীয়ের বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি। দুটি গরুকে সরিয়ে নিয়েছি। কিন্তু, ফসল নিয়ে খুব চিন্তায় আছি।"
"আমার এই বয়সে এমন পরিস্থিতি আর দেখিনি" মন্তব্য করেন তিনি।
আবু সিদ্দিকের মতো ঘুমধুম ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দাদের প্রধান পেশা- চাষবাদ ও পশুপালন। এ অঞ্চলের কৃষক শীত মৌসুমে বাদাম চাষ করেন। এখন বাদাম তোলার মৌসুম চলছে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের প্রভাবে সীমান্ত এলাকার চাষিরা ফসল তোলা, জমিতে সার দেওয়া বা পরিচর্যার কাজ করতে পারছেন না।
একই এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ তৈয়ব প্রায় ২ একর জমিতে মরিচ, ভূট্টা, আলু, টমেটো ও বাদাম চাষ করেছেন। সীমান্ত লাগোয়া জমিতে বাদাম তোলার কথা এখন তার। কিন্তু, গোলাগুলির কারণে সেখানে যেতেই পারছেন না। কপালে তাঁরও চিন্তার ভাঁজ।
তৈয়ব টিবিএসকে বলেন, "আমার জমির পরেই খাল। এরপরই মিয়ানমার সীমান্ত শুরু। ফসল তুলতে ও পরিচর্যা না করতে পারলে অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে।"
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গত শনিবার দিবাগত রাত ৩টা থেকে ঢেঁকিবনিয়ার পাশে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) তুমব্রু রাইট ক্যাম্প দখলকে কেন্দ্র করে মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরকান আর্মির সঙ্গে গোলাগুলি শুরু হয়। তুমব্রু রাইট ক্যাম্প সীমান্তচৌকিটি বাংলাদেশের বান্দরবানের নাইক্ষ্যাংছড়ি উপজেলার লোকালয়ের একদম কাছাকাছি।
ঢেঁকিবনিয়া সীমান্তচৌকি থেকে বাংলাদেশের লোকালয় প্রায় ৮০০ মিটার দূরে। ঢেঁকিবনিয়া ও ঘুমধুমের মাঝখানে নাফ নদীর সরু একটি শাখা ও প্যারাবন রয়েছে। এ কারণে তুমব্রু রাইট ক্যাম্পে গোলাগুলির সময় বাংলাদেশের বসতঘরে গুলি ও মর্টার শেল এসে পড়েছে। শনিবার মধ্যরাত থেকে শুরু হওয়া সংঘাত চলে রোববার (৪ ফেব্রুয়ারি) বিকাল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত। এরপর আবার রাত ১১টার দিকে সারারাতই থেমে থেমে সংঘাত চলে।
সোমবার (৫ ফেব্রুয়ারি) সকাল ৮টার পর কিছুটা থাকে। সোমবার সকাল ১১টা ২২ মিনিট থেকে আবার সংঘাত শুরু হয়। সীমান্তবর্তী মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) নিরাপত্তা চৌকি দখলে নিয়েছে বিদ্রোহী আরাকান আর্মি। তাদের লক্ষ্য করেই মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার গানশিপ মর্টার শেল ছুঁড়ছে। আরকান আর্মির হামলা থেকে বাঁচতে দুদিনে এপর্যন্ত ৯৫ জন বিজিপি সদস্য পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের অস্ত্রশস্ত্র জমা নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী- বিজিবি। সোমবার (৫ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে মিয়ানমার আর্মির হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া মর্টার শেলের আঘাতে বাংলাদেশ দুজন নিহত হয়েছে।
কোনারপাড়ার আরেক বাসিন্দা দিল খুশ বেগম টিবিএসকে বলেন, "আমার ৮টি মুরগি মারা গেছে। খেতেও যেতে পারছি না। সকালে এসেছিল। কিন্তু আবার যখন গোলাগুলি শুরু হয়, তখন পালিয়ে নিরাপদে চলে গেছি।"
স্থানীয় ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য দিল মোহাম্মদ ভুট্টো টিবিএসকে বলেন, "সীমান্তঘেঁষা এলাকার বাসিন্দারা নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছে। আমরা এখন পর্যন্ত সরকারি নির্দেশনা বা সহায়তা পাইনি। লোকজন নিজ দায়িত্বে নিরাপদে চলে গেছেন। এখনো আতঙ্কে দিন পার করছেন মানুষ।"
র্যাব-১৫ এর সহকারী পরিচালক মো. আবদুস সালাম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, "বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সঙ্গে র্যাব সতর্ক রয়েছে। আমরা উৎসুক জনতাকে সরিয়ে দিচ্ছি। এটি মিয়ানমারে অভ্যন্তরীণ সংঘাত। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিষয়গুলো অবগত করা হচ্ছে। সদর দপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করব।"
(তমব্রু সীমান্ত থেকে জানিয়েছেন টিবিএসের প্রতিবেদক জোবায়ের চৌধুরী)