মিয়ানমার সংঘাত: সীমান্তবর্তী বাসিন্দাদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ
মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সংঘাত বিরতিহীন ভাবে চলছে। টানা গুলি বর্ষণ, মর্টার শেল সহ বিস্ফোরণের শব্দ বাড়ছে সীমান্ত এলাকাজুড়ে। এই পরিস্থিতিতে সীমান্তবর্তী ঝুঁকিপূর্ণ বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে প্রশাসন।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহিন ইমরান ও বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মুজাহিদ উদ্দিন এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের তথ্যমতে, বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়ন, কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়ন থেকে শুরু করে টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়ন পর্যন্ত সীমান্ত এলাকায় গোলাগুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যাচ্ছে। এসব এলাকায় অন্তত এক লাখের বেশি বাসিন্দা রয়েছে, যারা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহিন ইমরান বলেন, "মিয়ানমারে সংঘাত বেড়েছে। মিয়ানমার থেকে ছোঁড়া গুলি, মর্টার শেল এসে পড়ছে সীমান্তের এপারে বসত ঘরে। এর প্রেক্ষিতে সীমান্তের ঝুঁকিপূর্ণ বাসিন্দাদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার নিদের্শনা রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নিদের্শনা প্রদান করা হয়েছে।"
তিনি আরও জানান, সীমান্তবর্তী ১৫০ পরিবার তাঁদের আত্মীয়-স্বজনদের বাসায় চলে গেছেন, আরও ৩০ পরিবারকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিরাপদ আশ্রয়ে নেওয়া হয়েছে।
জেলা প্রশাসক বলেন, পরিস্থিতি বিবেচনা করে সীমান্তের বাসিন্দাদের নিরাপদে সরিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সবাইকে সরে যেতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে অনুরোধ করাও হচ্ছে।
বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মুজাহিদ উদ্দিন বলেন, "সীমান্ত পরিস্থিতি উত্তেজনাকর। এমন পরিস্থিতিতে স্থানীয় বাসিন্দা ঝুঁকিতে আছেন। প্রাথমিক অবস্থায় ঘুমধুম ও তুমব্রু সীমান্তের মানুষকে নিরাপদে আশ্রয়ে যেতে বলা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা কাজ করছেন।"
তিনি জানান, উত্তর ঘুমধুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে আশ্রয়কেন্দ্র করা হয়েছে। লোকজনকে আশ্রয়কেন্দ্রে আনতে স্থানীয় চেয়ারম্যান সহযোগিতা করছেন।
মিয়ানমার থেকে আসা গুলিতে একদিনে আহত ৫
মিয়ানমার থেকে ছোড়া গুলিতে মঙ্গলবার সারাদিন বাংলাদেশের ৫ নাগরিক আহত হয়েছেন। এর মধ্যে ঘুমধুম সীমান্তে একজন, উখিয়ার পালংখালী সীমান্তে ৪ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।
উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী জানিয়েছেন, মঙ্গলবার দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ৪ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন। পালংখালী ইউনিয়নের নলবনিয়া এলাকার আয়ুবুল ইসলাম, রহমতেরবিল এলাকার আনোয়ার হোসেন, পুটিবনিয়া এলাকার মোবারক হোসেন ও মো. কাল আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
এর আগে মঙ্গলবার বেলা ৪টার দিকে তুমব্রু পশ্চিমকুল পাহারপাড়া থেকে আশ্রয়কেন্দ্র উত্তর ঘুমধুম সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার সময় গুলিতে আহত হন মো. সৈয়দ আলম নামের একজন। তিনি তুমব্রু পশ্চিমকুল পাহারপাড়া-নিবাসী কাদের হোসেনের ছেলে।
আহত সৈয়দ আলম জানান, বাড়ি থেকে উত্তর ঘুমধুম সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার সময় মিয়ানমার থেকে ছোড়া গুলি প্রথমে একটি গাছে লেগে ছিটকে গিয়ে তার কপাল ঘেঁষে চলে যায়। এতে কপাল কেটে রক্ত ঝরতে শুরু করে। তখন তিনি স্থানীয় চিকিৎসা কেন্দ্রে গিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা নেন।
ঘুমধুম ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য (মেম্বার) মো. আনোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ঘুমধুম বেতবুনিয়া বাজার সংলগ্ন ছৈয়দ নুর এর বসতঘরে একটি মার্টর শেল এসে পড়েছে। এতে ভেঙে গেছে জানালা। ফাটল ধরেছে বাড়ির দেওয়ালে। একই সময় ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামের বাড়িতে এসে পড়ে আরও একটি মর্টার শেল।
এসময় লাগাতার গুলি এসে পড়েছে এপারে। এতে সীমান্তের ঘুমধুমের নজরুল ইসলামের বাড়ি, রহমতবিল সংলগ্ন এডভোকেট আবদুল মান্নানের বাড়ি সহ ৫টি বাড়িতে গুলির আঘাত লেগেছে।
পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, "সোমবার রাত থেকে দুই পক্ষের লড়াইয়ের ভয়াবহতা বেড়ে যায়। গোলাগুলির এমন প্রচণ্ডতা আমরা আর দেখিনি। একেকটি গোলা নিক্ষেপের পর পুরো এলাকা যেন কেঁপে ওঠে। একটি রাত নির্ঘুম কাটিয়েছেন স্থানীয় লোকজন।"
তিনি জানান, ঘুমধুমের মধ্যমপাড়া, জলপাইতলী, মন্ডলপাড়া, নয়াপাড়া, কোনারপাড়া, পশ্চিমকুল, বেতবুনিয়া বাজার পাড়া, পাশের পালংখালী ইউনিয়নের উখিয়ার ঘাট, পূর্ব ফাঁড়ির বিল, নলবনিয়া, আঞ্জুমান পাড়া, বালুখালী, দক্ষিণ বালু খালী এলাকা গোলা বিনিময়ের শব্দে প্রকম্পিত হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে অনেকেই। যাদের স্থানীয় লোকজন আটক করে বিজিবির কাছে সোপর্দ করছে।
ঘুমধুম ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, আমাদের ইউনিয়নে ১, ২ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ড এলাকার বাইশপারি তঞ্চঙ্গ্যা পাড়া থেকে ২০ পরিবার, ভাজাবনিয়া তঞ্চঙ্গ্যা পাড়া থেকে ৩০ পরিবার, তুমব্রু কোনার পাড়া থেকে ৩০ পরিবার, ঘুমধুম পূর্ব পাড়া থেকে ২০ পরিবার এবং তুমব্রু হিন্দু পাড়া থেকে ১০ পরিবার পাশবর্তী বিভিন্ন এলাকায় তাঁদের আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে।
পালিয়ে আসা ২৬৪ জন বিজিবি হেফাজতে
মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী- বিজিপি সদস্যরা ছাড়াও তাঁদের সঙ্গে পালিয়ে আসছেন দেশটির সেনাবাহিনীর সদস্য, কাস্টমস কর্মী ও আহত সাধারণ নাগরিকরা।
সর্বশেষ মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত পালিয়ে আসা ২৬৪ জন বিজিবির হেফাজতে রয়েছে।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এর সদর দপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরিফুল ইসলাম জানিয়েছেন, ২৬৪ জনের মধ্যে বিজিপি, সেনাসদস্যসহ অন্যান্যরাও রয়েছে।