দেউলিয়া হওয়া থেকে সমৃদ্ধি: প্রবাসে নতুন জীবন গড়া এক বাংলাদেশির হার না মানার গল্প
আপরুল মানিক ফয়সালের সিলেট থেকে নেদারল্যান্ডসে গিয়ে সফল উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার পথটা মোটেও সহজ ছিল না। দীর্ঘ এই যাত্রায় তাকে অসংখ্য চ্যালেঞ্জ ও বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হয়েছে।
পরিবারের অভাব ঘোচাতে চাচার সঙ্গে ১৯৮৬ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে নেদারল্যান্ডসে যান আপরুল মানিক ফয়সাল।সেখানে গিয়ে প্রায় চার বছর একটি রেস্তোরাঁয় কাজ করেন তিনি।
নিজের উপার্জন দিয়ে একটি রেস্তোরাঁ খোলেন। এরপর এই রেস্তোরাঁর আয় দিয়েই একে একে আরও পাঁচটি রেস্তোরাঁ খোলেন।
কিন্তু সময়মতো ট্যাক্স পরিশোধ না করা এবং অব্যবস্থাপনার অভিযোগে নেদারল্যান্ডস সরকার তার চারটি রেস্তোরাঁ, বাড়ি, গাড়ি, ও সব সম্পদ জব্দ করে। তিনি একেবারে দেউলিয়া হয়ে যান।
তবে ইচ্ছাশক্তি, একাগ্রতা ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে আবার শূন্য থেকে ঘুরে দাঁড়ান ফয়সাল।
বর্তমানে তার রেস্টুরেন্টের বার্ষিক টার্নওভার ১.৩ মিলিয়ন ইউরো। গত বছর তিনি সব মিলিয়ে ২ লাখ ইউরো ট্যাক্স দিয়েছেন ডাচ সরকারকে।
সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার মটিউরা গ্রামে ১৯৭০ সালে জন্মগ্রহণ করেন আপরুল মানিক ফয়সাল। বাবা মাওলানা তজিমুল আলীর ৯ সন্তানের মধ্যে তিনি সপ্তম।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড- এর সঙ্গে একান্ত আলাপকালে আপরুল মানিক ফয়সাল বলেন, 'নিজের পরিশ্রম আর চেষ্টায় এতদূর এসেছি। নিজের ভুলের কারণেই সব হারিয়ে দেউলিয়া হয়ে ফের শূন্য থেকে শুরু করে, এ পর্যন্ত আসার কথা ভাবলে নিজেই চমকে উঠি। অতীতের কঠিন বাস্তবতা, দুঃখ ও পরিশ্রমের গল্পগুলো মনে হলে এখন অন্তরে প্রশান্তি পাই।'
তিনি বলেন, 'তাছাড়া আত্মীয়-স্বজন ও এলাকার মানুষের জন্য কিছু করতে পেরেছি ভেবে আনন্দে বুকটা ভরে ওঠে।'
আপরুল মানিক ফয়সাল বলেন, 'এসএসসি পাস করে ১৯৮৬ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে শূন্য হাতে চাচার সঙ্গে নেদারল্যান্ডসে আসি। নেদারল্যান্ডসে এসে আমি প্রথমে ডাচ ভাষাশিক্ষা কোর্স সম্পন্ন করি। তারপর দুই বছর মেয়াদি ম্যানেজমেন্ট ডিপ্লোমা সম্পন্ন করি। পড়াশোনার পাশাপাশি পার্টটাইম রেস্টুরেন্টে কাজ করতাম। প্রায় তিন বছর অন্যের অধীনে রেস্টুরেন্টে কাজ শিখি। এরপর নিজের টাকা দিয়ে বন্ধুর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ১৯৯০ সালে নেদারল্যান্ডসের হ্যাংলো শহরে ছোট্ট একটি রেস্টুরেন্ট খুলি। আমিই প্রথম বাংলাদেশি, যিনি এই শহরে প্রথম আমাদের সাব কন্টিনেন্ট খাবারের রেস্টুরেন্ট চালু করি।'
তিনি বলেন, 'প্রথম দিকে ডাচরা আমার এসব খাবার খেতে আসতেন না। পরে আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হয়ে গেলে বেশ সাড়া পাই এবং দিন দিন আমার বিজনেস বড় হতে থাকে। আমি ব্যবসায় এত পরিমাণ সাড়া পাই যে প্রতি ১/২ বছর পরপর নেদারল্যান্ডসের অন্য শহরগুলোতে একটি করে রেস্টুরেন্ট খুলি। এই ব্যবসার পুরো পুঁজি আমার রেস্টুরেন্ট ব্যবসার আয় দিয়ে। আমার ২৫ বছর বয়সে, অর্থাৎ ১৯৯০ সাল থেকে ১৯৯৫ সালের মধ্যে আমার নিজের পাঁচটি রেস্টুরেন্ট হয়। চারিদিকে আমার যশ-খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। আমি বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়ে যাই।'
আপরুল মানিক ফয়সাল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-কে বলেন, 'আমি ১৯৮৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত নেদারল্যান্ডসে আমার ভাই-বোন-শ্যালক-শ্যালিকাসহ প্রায় ৮০ জনকে এ দেশে এনে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছি। তাদেরকে আমি আমার রেস্টুরেন্টে জব করার সুযোগ করে দেই। তারা সবাই এখন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রতিষ্ঠিত।'
ফয়সাল বলেন, '২০০০ সাল পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু নেদারল্যান্ডসের ট্যাক্সের আইনকানুন সম্পর্কে সচেতন না থাকায়, ট্যাক্স দিতে গাফিলতি করায় এবং আমার রেস্টুরেন্টের ব্যবস্থাপনা ভালো না হওয়ায়; নেদারল্যান্ডস সরকার আমার পাঁচটি রেস্টুরেন্ট, বাড়ি ও গাড়িসহ যাবতীয় সম্পদ জব্দ করে। আমি মুহূর্তেই দেউলিয়া ও নিঃস্ব হয়ে যাই।'
তিনি বলেন, 'খালি হাতে আমি ফের বাংলাদেশে ফিরে আসি। ২০০০ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত আমি বাংলাদেশে ভালো কিছু করার চেষ্টা করি। তবে ভালো কিছু করার সুযোগ পাইনি। তারপর স্কটল্যান্ডে যাই, সেখানেও ভালো কোনো সুযোগ না পেয়ে বাধ্য হয়ে ফের নেদারল্যান্ডসে আসি।'
তিনি আরও বলেন, '২০০৩ সালে নেদারল্যান্ডসের ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে আমি আবার রেস্টুরেন্ট ব্যবসা শুরু করি। এই রেস্টুরেন্টের আয় দিয়ে ২০০৫ সালে নেদারল্যান্ডসে একটি বাড়ি কিনি। পরে সেটি মেরামত করে ভাড়া দেই। এরপর থেকে রেস্টুরেন্ট ও বাড়ি ভাড়ার আয় দিয়ে আমি প্রতি বছর একটি করে নতুন বাড়ি কিনতে শুরু করি। বর্তমানে নেদারল্যান্ডসে আমার ২৪টি বাড়ি রয়েছে। এছাড়া ইংল্যান্ডেও আমার একটি বাড়ি আছে।'
তিনি বলেন, 'দেশেও নিজ নামে সমাজসেবা করি। 'বাবাএইড' নামে আমার চ্যারিটি থেকে সিলেট অঞ্চলে প্রায় ৭০ জন গরীব-অসহায় শিক্ষার্থীর শিক্ষার খরচ দেওয়া হয়। এছাড়াও অনেককে বাড়ি করে দেওয়া হয়েছে এবং পানির পাম্প দেওয়া হয়েছে অসচ্ছল পরিবারের মাঝে।'
ব্যবসার পাশাপাশি ফয়সাল নেদারল্যান্ডসের রাজনীতির সঙ্গেও সম্পৃক্ত।
তিনি নেদারল্যান্ডসের লোকাল হ্যাংলো পার্টি থেকে দুইবার কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করেছেন। জিততে না পারলেও ভালো সংখ্যক ভোট পেয়েছেন তিনি।
ফয়সাল বলেন, 'আমি নেদারল্যান্ডস থেকে অনেক কিছু পেয়েছি জীবনে। এখন আমি নেদারল্যান্ডসকে কিছু দিতে চাই। আমি মনে করি, রাজনীতির মাধ্যমে নেদারল্যান্ডসের সমাজকে সেবা দেওয়া সম্ভব।'
বাংলাদেশ থেকে যারা নেদারল্যান্ডসে গিয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে চান তাদের উদ্দেশ্যে আপরুল মানিক ফয়সাল বলেন, 'নেদারল্যান্ডস ইঞ্জিনিয়ারিং ও তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর দেশ। এছাড়া এদেশে টেক্সটাইল সেক্টরে উন্নতির অনেক সুযোগ আছে। বাংলাদেশ থেকে কেউ এদেশে এসে ব্যবসা করতে চাইলে তাকে এসব বিষয় মাথায় রাখতে হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'এদেশ ব্যবসাবান্ধব, এখানকার সরকার নতুন উদ্যোক্তাদের ব্যাংক লোনসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে। তবে কাউকে এ দেশের যেকোনো সেক্টরে উদ্যোগী হতে হলে, তার এদেশের আইন-কানুন ভালোভাবে জেনেবুঝে তারপর কাজে হাত দেওয়া উচিত।'