জলদস্যুদের প্রধান লক্ষ্য মুক্তিপণ, হত্যা নয়: ২০১১ সালে জিম্মিদশা থেকে ফেরা নাবিক ইদ্রিস
মোজাম্বিক থেকে দুবাই যাওয়ার পথে বাংলাদেশি পাতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ ও এর ২৩ নাবিক এখন সোমালি জলদস্যুদের হাতে জিম্মি। গতকাল মঙ্গলবার (১২ মার্চ) ভারত মহাসাগর থেকে কয়লাবাহী জাহাজটির নিয়ন্ত্রণ নেয় দস্যুদল। চট্টগ্রামের কবির গ্রুপের (কেএসআরএম) সহযোগী প্রতিষ্ঠান এসআর শিপিং লিমিটেডের মালিকানাধীন এ জাহাজের নাবিকদের ভাগ্যে কী ঘটতে যাচ্ছে তা এখনো নিশ্চিত নয়।
আন্তর্জাতিক সমুদ্রপথে বাংলাদেশি জাহাজের জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হওয়ার ঘটনা এবারই প্রথম নয়। এর আগে ২০১০ সালে একই কোম্পানির এমভি জাহান মনি জাহাজও সোমালি জলসদ্যুরা ছিনতাই করেছিল। ওইসময় জাহাজে ২৫ ক্রু এবং ক্যাপ্টেনের স্ত্রীসহ মোট ২৬ ব্যক্তি ছিলেন। ১০৫ কোটি টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ১০০ দিন পর তাদের দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।
এমভি জাহান মনিতে জিম্মি থাকা নাবিকদের একজন মোহাম্মদ ইদ্রিস। বর্তমানে তিনি ভ্যাগার্ড শিপিং নামক একটি সমুদ্রগামী জাহাজে কর্মরত আছেন। বুধবার (১৩ মার্চ) তার সঙ্গে কথা বলেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর ওমর ফারুক ও শাহাদাত হোসেন চৌধুরী। এ সময় নিজের অভিজ্ঞতাসহ সমুদ্রপথে দস্যুবৃত্তির বিভিন্ন দিকের কথা তুলে ধরেন তিনি।
সশস্ত্র রক্ষী, জলকামান: বেসামরিক জাহাজের নিরাপত্তা
মোহাম্মদ ইদ্রিস বলেন, আন্তর্জাতিক নৌপথে চলাচলকারী প্রতিটি জাহাজেই জলদস্যু প্রতিরোধে কিছু ব্যবস্থা থাকে। এর মধ্যে রয়েছে অস্ত্রধারী ব্যক্তি মোতায়েন, রেলিংয়ে কাঁটাতার লাগানো ও জলকামানের ব্যবহার।
জলদস্যু হামলার নজির ও ঝুঁকি আছে এমন নৌপথে ভ্রমণের সময় পণ্যবাহী জাহাজ চাইলে অস্ত্রধারী ব্যক্তি ভাড়া করতে পারে। আফ্রিকান এ নৌপথে শ্রীলঙ্কা থেকে বেসরকারি সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষীদের জাহাজে তোলা হয়।
'তারা সোমালিয়া পার করে দিয়ে সুয়েজ খালে গিয়ে নেমে যান। দস্যুরা জাহাজে আক্রমণ করতে চাইলে অস্ত্রধারী প্রহরীরা সতর্কতামূলক গুলি চালান। তখন দস্যুরা বুঝতে পারে এ জাহাজে শ্যুটার আছে; তারা আর জাহাজের কাছে ঘেঁষে না,' বলেন ইদ্রিস।
এছাড়া জাহাজের রেলিংয়ে কাঁটাতার মোড়ানো থাকে। এসব তারের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের ব্যবস্থা থাকে। দস্যুরা জাহাজে উঠতে চাইলে বিদ্যুতায়িত এ তার থেকে তাদের গায়ে শক লাগে।
ইদ্রিসের দাবি অনুযায়ী, এ দুটি ব্যবস্থার কোনোটিই এমভি আব্দুল্লাহয় ছিল না।
তুলনামূলক দুর্বল একটি নিরাপত্তব্যবস্থা হলো জলকামানের ব্যবহার। 'জাহাজের ইঞ্জিন ব্যবহার করে পানি গরম করে ফায়ার হোসের মাধ্যমে দস্যুদের গায়ে ছেটানো হয়। এটি হচ্ছে সর্বনিম্ন প্রস্তুতি,' বলেন ইদ্রিস।
তবে এমভি আবদুল্লাহর নাবিকদের পাঠানো অডিওবার্তা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত ভিডিও থেকে ধারণা করা হচ্ছে, কোনো ধরনের প্রতিরোধ ছাড়াই জাহাজটির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল জলদস্যুরা। তাছাড়া ইঞ্জিনের মাধ্যমে পানি গরম করে আগত দস্যুদের গায়ে ছেটাতে কিছু সময়েরও প্রয়োজন হয়।
মুক্তিপণ ও উদ্ধার প্রক্রিয়া
মোহাম্মদ ইদ্রিস বলেন, 'কোনো জাহাজ অপহরণের পর অপহরণকারীরা প্রথমে নাবিকদেরকে তাদের আস্থানায় নিয়ে যায়। এরপর জাহাজ মালিকের বিস্তারিত খোঁজ নিয়ে মুক্তিপণ দাবি করে। এতে প্রায় এক সপ্তাহ পার হয়ে যায়।'
এর আগে মঙ্গলবার টিবিএস-এর সঙ্গে কথা বলার সময় এমভি জাহান মনি উদ্ধার প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত থাকা এক কর্মকর্তাও বলেন, ছিনতাইয়ের সঙ্গে কারা জড়িত এবং তারা কী চায় তা জানতে জাহাজ হাইজ্যাক হওয়ার পর আরও এক সপ্তাহ সময় লাগে।
ইদ্রিস বলেন, 'আন্তর্জাতিক কিছু গোষ্ঠী আছে যারা তৃতীয় পক্ষ হয়ে অপহরণকারীদের মুক্তিপণের বার্তা জাহাজ মালিকের কাছে পৌঁছায়। এ তৃতীয় পক্ষই অপহরণকারী এবং জাহাজ মালিকের মধ্যে সমঝোতার কাজ করে।'
ইদ্রিস জানান, অপহরণকারীদের দাবি অনুযায়ী মুক্তিপণ পরিশোধ করা হলে সাধারণত তারা অপহৃত নাবিকদের কোনো ক্ষতি করে না। গতবারের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে এসআর শিপিং এবারেও তাদের নাবিকদের অক্ষত অবস্থায় ফিরিয়ে আনবেন বলে আশা ব্যক্ত করেন এ নাবিক।
এসআর শিপিংয়ের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর শাহরিয়ার জাহান রাহাত টিবিএসকে বলেন, 'আমরা আশা করছি এক সপ্তাহের মধ্যে অপহরণকারীরা কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। যোগাযোগ প্রক্রিয়া শুরু হলে জাহাজে থাকা ২৩ নাবিককে উদ্ধারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবে কেএসআরএম।'
এমভি জাহান মনি: বন্দিদশার দিনগুলো
২০১০ সালে এমভি জাহান মনি জাহাজে ফিটার পদে কর্মরত ছিলেন ইদ্রিস। বন্দিদশার অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে তিনি বলেন, '২১ নভেম্বর ইন্দোনেশিয়া থেকে আমরা যাত্রা শুরু করি। সিঙ্গাপুর বন্দরে জ্বালানি, তিনমাসের খাবারসহ প্রয়োজনীয় রসদ সংগ্রহ করে ২৭ নভেম্বর গ্রিসের দিকে রওনা দিই।'
আরব সাগর দিয়ে যাত্রার সময় জাহান মনি জাহাজ সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়ে। 'হুক ও মই ব্যবহার করে জাহাজে উঠে আগ্নেয়াস্ত্রের মুখে আমাদের সবাইকে জিম্মি করে ব্রিজ এরিয়ায় বন্দি করে রাখে। ১১ ডিসেম্বর সোমালিয়ার উপকূলের একটি স্থানে নিয়ে যায়,' স্মৃতিচারণ করেন ইদ্রিস।
সোমালিয়ায় জলদস্যুদের নির্ধারিত জায়গায় আস্তানা রয়েছে। এসব স্থানে সাধারণত সোমালি সরকার কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর নিয়ন্ত্রণ থাকে না।
জিম্মি হওয়ার পাঁচদিন পর তাদের সকলকে পরিবারের সঙ্গে পাঁচমিনিট করে কথা বলার সুযোগ দেয় জলদস্যুরা। ইদ্রিস জিম্মি থাকা অবস্থায় দেশে তার কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। 'কয়েকদিন পরপর নাবিকের নাম উল্লেখ করে হত্যার হুমকি দিত তারা,' বলেন তিনি।
জিম্মি থাকাকালীন সোমালি জলদস্যুরা এমভি জাহান মনির নাবিকদের সঙ্গে ইংরেজি এবং আরবিতে কথা বলত। ইদ্রিস বলেন, 'সোমালি জলদস্যুদের প্রধান লক্ষ্য মুক্তিপণ আদায় করা। তাদের উদ্দেশ্য কাউকে হত্যা করা নয়।'
এসআর শিপিংয়ের সিইও মেহরুল করিম গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে টিবিএসকে বলেন, 'দুইদিন আগে এমভি আবদুল্লাহর গতিপথ পরিবর্তন করে সোমালিয়ার দিকে ঘুরিয়ে নিতে বাধ্য করে জলদস্যুরা। তারা জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। আমরা আজ [মঙ্গলবার] দুপুর দেড়টার দিকে জলদস্যুতার বিষয়ে জানতে পারি।'
এদিকে, জিম্মি ২৩ নাবিককে উদ্ধারে সোমালি জলদস্যুদের সঙ্গে এখনো যোগাযোগ করা যায়নি বলে আজ বুধবার জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। তবে নাবিকদের উদ্ধার 'তৎপরতা' চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, 'আমরা সেকেন্ড পার্টির মাধ্যমে চেষ্টা করছি।'
হাছান মাহমুদ বলেন, 'মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে অত্যন্ত কনসার্ন। বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রীসভায়ও অনানুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও কাজ করছে।'
ইতোমধ্যে কুয়ালালামপুরে পাইরেসি রিপোর্টিং সেন্টার, নয়াদিল্লীতে ইন্ডিয়ান ফিউশন সেন্টার, যুক্তরাজ্যের মেরিটাইম ট্রেড অপারেশন (ইউকেএমটিও) এবং এশিয়ায় দস্যুতা ও সশস্ত্র ডাকাতি প্রতিরোধে আঞ্চলিক সহযোগিতা চুক্তির আওতায় সিঙ্গাপুরে অবস্থিত দপ্তরকে খবর দেওয়া হয়েছে বলে জানান মন্ত্রী।
পাশাপাশি ওই অঞ্চলে চলাচলরত যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও চীনের জাহাজগুলোকেও বাংলাদেশের জাহাজটির অবস্থা রিপোর্ট করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে এ জাহাজটিকে এবং নাবিকদের মুক্ত করা। কিন্তু কৌশল কী হবে, এটা প্রকাশ্যে বলার বিষয় নয়,' বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।