ভাইকে ‘হত্যার’ মামলায় ট্রান্সকম সিইও সিমিনের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক যেসব অভিযোগ বোন শাযরেহের
ভাই আরশাদ ওয়ালিউর রহমানকে হত্যার অভিযোগে ট্রান্সকম গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সিমিন রহমান ও তার ছেলে যারাইফ আয়াত হোসেনসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেছেন তার ছোট বোন শাযরেহ হক।
শুক্রবার (২২ মার্চ) ডিএমপির গুলশান থানায় মামলাটি দায়ের করা হয়।
মামলার এজাহারে বাদী শাযরেহ হক বলেছেন:
আমার বাবা লতিফুর রহমান ট্রান্সকম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক সিইও। আমিসহ আমার বড় ভাই আরশাদ ওয়ালিউর রহমান এবং ১ নং আসামি সিমিন রহমান বাবার সকল স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির মুসলিম শরীয়া আইন অনুযায়ী ওয়ারিশ। কিন্তু, তাঁর মৃত্যুর পর থেকেই আমরা বড় বোন সিমিন রহমান এবং তাঁর ছেলে যারাইফ আয়াত হোসেন (ট্রান্সকম গ্রুপের হেড অফ ট্রান্সফর্মেশন) এই সম্পত্তির পুরোটা হস্তগত করার চক্রান্তে লিপ্ত হয়।
শাযরেহ'র দাবি, মামলার ১ ও ২ নং আসামি (সিমিন ও যারাইফ) আমাকে ও আমার বড় ভাই আরশাদ ওয়ালিউর রহমানকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার অসৎ উদ্দেশ্যে জালিয়াতির মাধ্যমে বিভিন্ন কাগজপত্র তৈরি করে সম্পত্তি আত্মসাৎ করেন।
"আমি ও আমার বড় ভাই এর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। এজন্য বড় ভাই আরশাদ ওয়ালিউর ২০২৩ সালের ৮ জুন আমাকে আম-মোক্তারনামা (পাওয়ার অব অ্যাটর্নি) প্রদান করেন।" পাওয়ার অব অ্যাটর্নি পাওয়ায় তাঁর হয়ে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষমতা পান শাযরেহ।
কিন্তু, 'তিনি আমাকে আম-মোক্তারনামা প্রদান করায় সিমিন আমাদের বড় ভাই ওয়ালিউর রহমানের ওপর ক্ষুদ্ধ হয়। এসময় তিনি জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে নিকটজনদের কাছে আশঙ্কা প্রকাশ করেন।'
ওয়ালিউর ডিভোর্সি এবং নিঃসন্তান ছিলেন বলে একা বসবাস করতেন। ১৬ জুন রাত সোয়া ১১টায় মোসলেম হাওলাদার নামে তাঁর বাবার সময়কার পুরোনো এক গৃহকর্মী শাযরেহকে ফোন করে জানান, ওয়ালিউর মারাত্মক অসুস্থ। ফোন পেয়ে দ্রুত ওই বাসায় গিয়ে (১১টা ২৫ মিনিটে) বড় ভাইকে মৃত অবস্থায় দেখেন শাযরেহ।
শাযরেহ এজাহারে বলেছেন, ঘটনার সময় ১১ জন আসামিকেই তিনি ওয়ালিউরের বাসভবনে উপস্থিত থাকতে দেখেন। কিন্তু, তাঁদের কেউই তাঁকে ওয়ালিউর মৃত্যুর খবর জানায়নি।
"আমার জানামতে, আমার বড় ভাইয়ের কোনো জটিল অসুখ ছিল না। ঘটনার ৩/৪ দিন আগে থেকেই চেষ্টা করেও তাঁর সাথে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না।"
গুলশানে ওয়ালিউরের ভাড়া বাড়ির নিচে একটি অ্যাম্বুলেন্স তাঁকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল।
বাড়িতে পৌঁছানোর পর সেখানে উপস্থিত এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস এর ম্যানেজার (মেডিকেল অ্যাফেয়ার্স) ডা. মুরাদ হোসেন (৫০) এবং মার্কেটিং অ্যান্ড সেলসের পরিচালক ডা. মুজাহিদুল ইসলাম (৫৫) এর সাথে সিমিন রহমানকে কথা বলতে দেখেন শাযরেহ।
সিমিন তাঁদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মৃত্যু সনদের ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দিচ্ছিলেন। একইসঙ্গে উপস্থিত অন্য আসামিদের সেদিন সন্ধার মধ্যেই আরশাদ ওয়ালিউর রহমানের দাফন সম্পন্ন করার নির্দেশ দেন বলে দাবি করেছেন শাযরেহ।
তাঁর মতে, অ্যাম্বুলেন্সে করে ওয়ালিউরকে হাসপাতালে নিয়ে যান ডা. মুরাদ। অ্যাম্বুলেন্স পৌঁছানোর আগে থেকেই এসকেএফ ফার্মার অজ্ঞাতনামা কিছুসংখ্যক কর্মকর্তা হাসপাতালে উপস্থিত ছিলেন।
"ইউনাইটেড হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক আসামীদের কাছে মন্তব্য করেন, আমার বড় ভাইয়ের মৃত্যু অনেক আগেই হয়েছে, এবং কেন এত দেরি করে লাশ হাসপাতালে আনা হলো?"
কর্তব্যরত চিকিৎসক এসময় আরশাদ ওয়ালিউর রহমানের শারীরিক অবস্থা, তাঁর কোনো দুরারোগ্য ব্যাধি ছিল কিনা এবং কীভাবে তিনি মারা গেছেন– এসব খোঁজখবর নেন।
জবাবে "ডা. মুরাদ বলেন, তিনি পারিবারিক চিকিৎসক, তাঁর কাছে সমস্ত তথ্য আছে এবং পুলিশ রিপোর্টেরও কোনো প্রয়োজন নেই।"
এজাহারে শাযরেহ বলেন, হাসপাতালের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হলে ডা. মুরাদ এবং এসকেএফ এর কর্মকর্তারা হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের থেকে লাশ নেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু, হাসপাতালের কর্মীরা তাঁদের জানান, মৃতের একজন আত্মীয়ের সই ছাড়া লাশ হস্তান্তর করা যাবে না।
শাযরেহ'র স্বামী আরশাদ হক অ্যাম্বুলেন্সের সাথে হাসপাতালে গিয়েছিলেন ঘটনা জানতে। তখন মৃতের ভগ্নিপতি হিসেবে রিলিজ ফর্মে সই করেন তিনি।
বাদীর দাবি, সিমিনের নির্দেশ মতো ডা. মুরাদ হাসপাতাল থেকে মৃত্যু সনদসহ অন্যান্য কাগজপত্র নিয়ে নেন। পরে সেগুলো ডা. মুজাহিদুলের মাধ্যমে সিমিনের কাছে হস্তান্তর করেন।
এদিকে মৃত্যু সনদ দেখে বিস্মিত হন শাযরেহ হকের স্বামী আরশাদ হক; কারণ কোনো ময়নাতদন্ত বা টক্সোকোলজি পরীক্ষা করা হয়নি। আরশাদ ওয়ালিউর রহমানের মৃত্যুর কারণও অজানা লেখা ছিল। তখন আরশাদ হক তাঁর মোবাইল ফোনের ক্যামেরা দিয়ে মৃত্যু সনদের একটি ছবি তুলে রাখেন।
শাযরেহ বলেছেন, তাঁর স্বামী মৃত্যু সনদের ওই ছবি বাড়িতে এসে তাঁকে এবং অন্যান্য আত্মীয়দের দেখিয়েছিলেন। এদিকে মামলার ১ নং আসামি সিমিনের নির্দেশে তাড়াহুড়ো করে বনানী কবরস্থানে আরশাদ ওয়ালিউর রহমানের জানাজা সম্পন্ন করা হয়।
"পারিবারিক কবরস্থানে আরো চারটি খালি দাফন স্থান থাকলেও আমাদের ছোট বোন শাজনীনের কবরে বড় ভাই ওয়ালিউর রহমানকে সমাধিস্থ করা হয়।"
১৯৯৮ সালের ২৩ এপ্রিলে গুলশানের পারিবারিক বাসভবনে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হন শাজনীন তাসনিম রহমান। তাঁকে ২০ বার ছুরিকাঘাত করা হয়েছিল।
শাজনীনের মরদেহ সবার আগে আবিষ্কার করেন গৃহকর্মী মোসলেম হাওলাদার, এই ব্যক্তিই শাযরেহকে ফোন করে তাঁর ভাইয়ের মৃত্যুর খবর জানান।
এজাহারে শাযরেহ আরো বলেন, ওয়ালিউর রহমানকে দাফন করার দিন সমস্ত সিদ্ধান্ত নিজেই নেন সিমিন।
তাঁর বড় ভাই ওয়ালিউর অসুস্থ ছিলেন না এবং তিনি অসুস্থ ছিলেন মর্মে কোনো তথ্য আমার বা আমাদের আত্মীয়দের কাছে ছিল না' বলেও এজাহারে উল্লেখ করেছেন শাযরেহ।
এবিষয়ে ওয়ালিউর রহমানের একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু লতিফুর রহমান খান রাসকিন বাদীর বড় বোন সিমিনকে প্রশ্ন করেন, কেন তারা মৃত্যুর কারণ খুঁজে বের করতে ময়নাতদন্ত বা টক্সিকোলজি পরীক্ষা করাননি।
"মৃত্যুর বিষয়ে ওয়ালিউরের ড্রাইভার (মিরাজুল) এবং বাবুর্চি (রফিক)-কে কেন পুলিশের মাধ্যমে জিজ্ঞাসাবাদ করেন নাই"-- তিনি এই প্রশ্নও করেন সিমিনকে।
শাযরেহ'র অভিযোগ, সিমিন এসব প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান বা কোনো সদুত্তর দেননি।
ওয়ালিউর রহমানের হত্যা মামলায় মিরাজুল এবং রফিককেও আসামি করা হয়েছে।
শাযরেহ বলেছেন, "ঘটনার দিন সকাল ১১টা ২৫ মিনিটের পূর্বে যেকোনো সময় আমার বড় ভাই আরশাদ ওয়ালিউর রহমানকে তারা শ্বাসরোধ/ বিষপ্রয়োগে হত্যা করেছে বলে আসামিদের আচার-আচরণে প্রকাশ ঘটেছে।"
তাঁর আরো অভিযোগ, আরশাদ ওয়ালিউর রহমানের মৃত্যুর সাথে সাথেই আসামিরা সিমিনের নির্দেশে তাঁর বাড়ি-গাড়ি ও অন্যান্য্ সম্পত্তির দখল নিয়ে নেয়।
শাযরেহ বলেছেন, 'সিমিনের নির্দেশে দুই আসামি মিরাজুল এবং রফিক বর্তমানে ট্রান্সকম লিমিটেডে কর্মরত আছেন।'