অস্থির এলাচের বাজার: বছরে চাহিদা ৮ হাজার টন হলেও দৈনিক বাণিজ্য ১ হাজার টনের বেশি
দেশে মসলাপণ্য এলাচের বার্ষিক চাহিদা ৮,০০০ টনেরও কম বলে ধারণা করা হয়। তবে দেশের বৃহত্তম পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে ডিও (ডেলিভারি অর্ডার) কেনাবেচার মাধ্যমে প্রতিদিন ১,০০০ টনেরও বেশি এলাচ ব্যবসায়ে আবারও অস্থির হয়ে উঠেছে এই মসলাপণ্যের বাজার।
বাংলাদেশ পাইকারি গরম মসলা ব্যবসায়ী সমিতির সিনিয়র সহ-সভাপতি অমর কান্তি দাশ বলেন, "দেশে বছরে এলাচের চাহিদা সর্বোচ্চ ৭,৬০০ টন। অথচ চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারেই প্রতিদিন হাজার টনের বেশি এলাচ ট্রেডিং হচ্ছে বলে নিশ্চিত করেছেন মসলা আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা।"
ডিও হলো— পণ্য বিক্রির বিপরীতে দেওয়া ডেলিভারি অর্ডার। এলাচের ক্ষেত্রে ডিও ট্রেডিংয়ের মধ্যমে সাথে সাথে এলাচের ডেলিভারি না নিয়ে ভবিষ্যতে নেওয়ার জন্য মসলাটির কেনা-বেচার চুক্তি করা হয়। এর মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা স্বল্প সময়ে পণ্যটির মূল্য ওঠানামা থেকে মুনাফা অর্জনের লোভে প্রায়ই বড় অঙ্কের চুক্তিতে যান। তাদের এই কারসাজিতে অস্থির হয়ে ওঠে এলাচের বাজার। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হন ভোক্তা ও ব্যবসায়ী উভয়ই।
খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী সেকান্দার হোসেন বলেন, "এটা এক ধরনের জুয়া খেলার মতো। যেখানে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা পণ্যের ডিও বা স্লিপ বিক্রি হয়। কিন্তু ক্রেতা-বিক্রেতারা জানেন না এই পণ্য কোথায়। এই ডিও বেচাকেনায় কোনো একটি পণ্যের দাম সর্বোচ্চ হয়ে হঠাৎ বড় দরপতন হয়। তখন ডিও বা স্লিপগুলো যাদের হাতে থাকে, তারা বড় লোকসানে পড়ে মার্কেট থেকে উধাও হয়ে যান।"
এক হাত থেকে আরেক হাতে ডিও বেচাকেনার মাধ্যমে ভোগ্যপণ্যের বাজার খাতুনগঞ্জে গত দুইমাসে এলাচের দাম বেড়ে বর্তমানে প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ৩,৯০০ টাকায়। অথচ বাজারে বিক্রি হওয়া এসব এলাচ আমদানি করতে প্রতিকেজিতে খরচ পড়েছে ১,২০০-১,৫০০ টাকা।
খাতুনগঞ্জের প্রকৃত মসলা ব্যবসায়ীরা জানান, বর্তমানে বাজারে প্রতিকেজি এলএমজি(২০২৩-২৭) এলাচ ৩,৯০০ টাকা এবং এলএমজি(২০২৪-২৮) ৩,৪৫০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে। অথচ একই সাপ্লাইয়ার (কারডেক্স) থেকে আমদানি করা একই পণ্য ঢাকার বাজারে এলএমজি (২৩-২৭) ৩,০০০ টাকা এবং এলএমজি(২৪-২৮) ২,৯৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। শুধুমাত্র লোকাল ট্রেডিং বা স্থানীয় বাজারে এক ব্যবসায়ী থেকে আরেক ব্যবসায়ীর হাত বদলের কারণে ঢাকার বাজার থেকে চট্টগ্রামের বাজারে একই পণ্য কেজিতে ৫০০-৯০০ টাকার ব্যবধানে বিক্রি হচ্ছে বলে জানান তারা।
মূল্য অস্থিরতার পেছনে ডিও কেনাবেচা দায়ী
পণ্যের মজুদ না থাকা স্বত্বেও ডিও ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে অদৃশ্যভাবেই এলাচের বেচাকেনা চলছে খাতুনগঞ্জে। মূলত এ কারণেই ঢাকার তুলনায় চট্টগ্রামে এই মসলা পণ্যের দাম বেশি বলে দাবি করেছেন প্রকৃত মসলা ব্যবসায়ীরা।
ডিও ট্রেডিং অনিয়ন্ত্রিত ও ঝুঁকিপূর্ণ
ডিও ট্রেডিং সরকার নিয়ন্ত্রিত নয়। ফলে এটি ঝুঁকিপূর্ণ একটি ব্যবসা পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত। যেসব ব্যবসায়ীরা ডিও ট্রেডিংয়ে জড়িত তাদের কোনো ইনভেন্টরি বা দোকান-অফিস না থাকা স্বত্বেও তারা সহজেই বড় অঙ্কের ডিও চুক্তি কেচাবেচা করে বাজারমূল্যে কারসাজি করতে পারেন।
এতে পণ্যের হঠাৎ মূল্য বৃদ্ধি, এমনকি দরপতনও হতে পারে। এতে করে ভোক্তা ও ব্যবসায়ী উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন।
খাতুনগঞ্জ বাজারে ডিও ব্যবসা যেভাবে প্রসার ঘটাচ্ছে
শনিবার (৪ মে) সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, খাতুনগঞ্জের সোনামিয়া মার্কেটের নীচ তলায় শত শত লোকের ভিড়। কারো হাতে কিংবা দোকানে কোনো পণ্য মজুদ না থাকলেও তারা সবাই পণ্য বেচাকেনা করছেন। বাজারে আগন্তুক এসব লোকজন মূলত পণ্যের বদলে ডিও বেচাকেনা করছেন।
মার্কেটের জাহানার এন্টারপ্রাইজের সামনে দাঁড়ানো ইব্রাহিম হোসেন জানান, তিনি খাতুনগঞ্জে তেল, চিনি ও এলাচসহ বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের ব্যবসা করেন। গত তিন-চার বছর ধরে তিনি এসব পণ্যের ব্যবসা করলেও তার কোনো দোকান বা অফিস নেই।
আজ শনিবার তিনি ২ টন এলাচ বিক্রি করেছেন কেজিপ্রতি ৩৯০০ টাকা দামে, যা গত বুধবারে ২,৭০০ টাকা দরে কিনেছিলেন তিনি। এতে গত চার দিনের ব্যবধানে তার মুনাফা হয়েছে ৪ লাখ টাকা।
এই ব্যবসায়ী বলেন, "গত চারদিনে কেজিতে ২০০ টাকা না বেড়ে উল্টো কমতে পারতো। ডিও ব্যবসা হলো অনেকটা জুয়া খেলার মতো। এখানে যেকোনো সময় পণ্যের দাম উঠা-নামা করে। ফলে লাভ-লসের ঝুঁকি বেশি।"
অপর ব্যবসায়ী রাজু সাহা বলেন, বাজারের সোনামিয়া মার্কেট, এজাজ মার্কেট, বাদশা মার্কেটে ও এমজি মার্কেট চলে এসব ডিও ব্যবসা।
"সাধারণত বেশিরভাগ সময় চিনি ও ভোজ্যতেলকে ঘিরে ডিও বেচাকেনা হয়। তবে চিনি ও ভোজ্যতেলের দাম ও বিকিকিন কম থাকলে এসব ব্যবসায়ীরা অন্য কোনো একটি পণ্যকে ঘিরে এই ডিও ব্যবসাকে চাঙ্গা করে তোলেন," যোগ করেন তিনি।
খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী সেকান্দার হোসেন বলেন, মসলা পণ্যের জন্য বাজারের পুরানো ও নামকরা মার্কেট হলো— ইলিয়াছ মার্কেট ও নবী মার্কেট। এই দুই মার্কেটের ব্যবসায়ীরা বেশিরভাগ মসলা পণ্য আমদানি ও বিকিকিনি করেন। কিন্তু যেসব মার্কেটের ব্যবসায়ীরা মসলা আমদানি ও বিকিকিনির সাথে জড়িত নন, তারাই এখন প্রতিদিন শত শত টন এলাচের ডিও বিক্রি করছেন।"
তিনি আরো বলেন, "এটা এক ধরনের জুয়া খেলার মতো। যেখানে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা পণ্যের ডিও বা স্লিপ বিক্রি হয়। কিন্তু ক্রেতা-বিক্রেতারা জানেন না এই পণ্য কোথায়।"
খাতুনগঞ্জে ডাল ও মসলার পাইকারি ব্যবসায়ী মেসার্স হক ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী আজিজুল হক বলেন, "খাতুনগঞ্জে এখন এলাচ নিয়ে যা হচ্ছে, তা ব্যবসায়ের পর্যায়ে পড়ে না। এখানে এলাচের পরিবর্তে স্লিপ (কাগজ) বেচাকেনা হচ্ছে। কিছু ব্যবসায়ীর সঙ্গে অব্যবসায়ী মিলে এসব কাগজ বেচাকেনা করে এলাচের বাজার অস্থির করে রেখেছে।"
"এসব স্লিপ বেচাকেনা করে বড় অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়ে অনেকে উধাও হয়ে যেতে পারে। অতীতেও মানুষের টাকা হাতিয়ে নিয়ে অনেকে খাতুনগঞ্জ থেকে পালিয়ে গেছে। এটা জুয়া খেলা। একজনের পকেটের টাকা অন্যজনের পকেটে চলে যাচ্ছে," বলেন তিনি।
প্রকৃত আমদানির খরচ কম
প্রকৃত আমদানিকারক ও ব্যবসায়ী ছাড়াও খাতুনগঞ্জে একটি মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণি তৈরি হয়েছে, যারা কখনো মসলা ব্যবসা করতেন না কিংবা এখনও সরাসরি মসলা ব্যবসায় যুক্ত নন। মূলত ডিও স্লিপ হাতবদলের মাধ্যমে এলাচের বাজার অস্থির করে তোলেন তারা। সময়-সুযোগে কয়েক হাত বদল হয়ে দাম বাড়িয়ে বড় অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেয় প্রভাবশালী চক্রটি।
আমদানিকারকদের তথ্যমতে, দেশে আমদানি হওয়া এলাচের বেশিরভাগই আসে গুয়াতেমালা থেকে। এলএমজি, জেবিস, আরএস-জাম্বো, এসএমজি, এসবি ব্রান্ড নামে আমদানি হওয়া এসব এলাচের মধ্যে মাঝারি মানের জেবিসি ও এলএমজি'র চাহিদা বেশি বাজারে।
চলতি বছর ২০২৪ সালের প্রথম দুই মাসে (২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) ১৩টি প্রতিষ্ঠান ২৩৭ টন ৮০ কেজি এলাচ আমদানি করেছে। ঘোষিত মূল্য ও রাজস্বসহ প্রতি কেজি এলাচের দাম পড়েছে ১,২৬৭ টাকা। গত বছর ২০২৩ সালে ৮৫টি প্রতিষ্ঠান ৪,৬৭৭ টন ২৯০ কেজি এলাচ আমদানি করে। আমদানিকারকদের ঘোষিত মূল্য ও রাজস্বসহ প্রতিকেজি এলাচের আমদানি খরচ পড়ে ১,২৫৭ টাকা করে।
এর আগে, ২০২২ সালে ১০৪টি প্রতিষ্ঠান রেকর্ড ৬ হাজার ১ টন ২০৫ কেজি, ২০২১ সালে ৭০টি প্রতিষ্ঠান ৪,৩৯৫ টন ৮০ কেজি, ২০২০ সালে ৬০টি প্রতিষ্ঠান ৩,১০১ টন ৬৮৩ কেজি এবং ২০১৯ সালে ৫০টি প্রতিষ্ঠান ৩,৬৭১ টন ২৫৬ কেজি এলাচ আমদানি করে।
আমদানিকার ও ব্যবসায়ীরা জানান, ২০১৮ সালে গুয়াতেমালায় এলাচ উৎপাদন কম হওয়ায় পণ্যটির দাম নিয়ে বাংলাদেশের বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়। ওই সময় প্রতিকেজি এলাচ ১,৫০০-২,০০০ টাকা থেকে বেড়ে ৫,০০০ টাকায় গিয়ে ঠেকে। পরের দুই বছর আমদানিকারকরা এলাচ আমদানি কমিয়ে দেন। অস্থিরতার সুযোগে খাতুনগঞ্জের বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী ২০২২ সালের দিকে এলাচে বিনিয়োগ শুরু করেন। এরপর থেকে পণ্যটির আমদানি বাড়তে থাকে দেশিয় বাজারে।
প্রকৃত ব্যবসায়ীরা ডিও কেনাবেচায় জড়িত নন
খাতুনগঞ্জের মসলা আমদানিকারক অসীম সাহা জানান, প্রকৃত মসলা আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা এ ধরনের স্লিপ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নন।
"আমরা এলাচ আমদানি করে তা বাজারে বিক্রি করি। কারও কাছে স্লিপ বিক্রি করি না। সোনা মিয়া মার্কেটসহ কয়েকটি মার্কেটের একটি ব্যবসায়ী চক্র স্লিপ বিক্রি করে এলাচের বাজার অস্থির করছে। এসব ব্যবসায়ীদের কারো কাছে এলাচ আছে এক টন, কিন্তু সে বাজারে স্লিপ বিক্রি করেছে ১০০ টনের। তারা মূলত স্লিপ বা কাগজ বিক্রির মাধ্যমে বাজার থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। পরে একটা সময় বাজারে বড় দরপতন হলে লোকসানে পড়বে ভ্রাম্যমান ব্যবসায়ীরা," বলেন তিনি।
অপর আমদানিকারক মেসার্স এ বি দাশ অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানির স্বত্বাধিকারী অমর কান্তি দাশ বলেন, "খাতুনগঞ্জের মূল মসলা ব্যবসায়ীদের কেউ ডিও বিক্রির সঙ্গে জড়িত নয়। যারা এলাচের ডিও বিক্রি করছে, তাদের কেউ আগে মসলা ব্যবসা করেনি। এখনো করছে না।"
"আমরাও চাই ডিও বা স্লিপ বিক্রির এই অবৈধ বাণিজ্য বন্ধ হোক। কারণ এতে প্রকৃত ব্যবসায়ীর চেয়ে ফটকাবাজ বা মধ্যস্বত্বভোগী একটি শ্রেণি অবৈধভাবে টাকা আয় করছে," যোগ করেন এই ব্যবসায়ী।
নিয়ন্ত্রণ সংস্থার ভূমিকা
চট্টগ্রাম বিভাগের জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ ফয়েজ উল্লাহ টিবিএসকে বলেন, "এলাচ নিয়ে বর্তমানে চলতে থাকা অবৈধ ব্যবসা সম্পর্কে আমরা অবগত। যেকোনো একক পণ্যকে কেন্দ্র করে ব্যবসা অবৈধ। আগে, আমরা তেল এবং চিনির ক্ষেত্রে এ ধরনের অবৈধ ব্যবসা তৈরি হতে দেখেছি। অবিলম্বে আমরা অবৈধ এই ব্যবসা প্রতিরোধে বাজারে প্রচারণা চালাব।"
খাতুনগঞ্জের পাইকারি ব্যবসায়ী সমিতির নেতারা জানান, তারা প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকে প্রায়ই ডিও ট্রেডিংয়ের বিষয়টি উত্থাপন করেন। ভোক্তা ও প্রকৃত ব্যবসায়ীদের বাঁচাতে এ ধরনের ফটকা বাণিজ্য বন্ধের আহ্বান জানান তারা।
খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক জামাল হোসেন টিবিএসকে বলেন, "খাতুনগঞ্জে দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ ডিও ব্যবসা চলছে, যার ফলে বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। এর অবসানে প্রশাসনকেই পদক্ষেপ নিতে হবে। "