আরও ৪ লাখ মানুষ আসবেন সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায়, মাসিক বরাদ্দ বাড়ছে না
আগামী (২০২৪-২৫) অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় সুবিধাভোগীর সংখ্যা আরও ৪ লাখ বাড়াবে সরকার। তবে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি সত্ত্বেও মাসিক ভাতা বাড়বে না বিষয়টি সম্পর্কে অবগত কর্মকর্তারা টিবিএসকে জানিয়েছেন।
প্রায় ১.১৪ কোটি বয়স্ক মানুষ, বিধবা বা স্বামী-নিগৃহীতা নারী এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বর্তমানে মাসে ৫৫০ টাকা থেকে ৮৫০ টাকা পর্যন্ত সরকারি ভাতা পান।
এক বছরেরও বেশি সময় ধরে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছাকাছি। মোটা চাল, আলু, ডিম থেকে শুরু করে ওষুধ পর্যন্ত সবকিছুর দাম বেড়েছে। কিন্তু সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্পের আওতায় বয়স্ক এবং দুস্থ মানুষের ভাতার পরিমাণ বাড়বে না। অবশ্য ২০২৪-২৫ অর্থবছরের নতুন বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীর উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ানো হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার যদি মাসিক ভাতার পরিমাণ না বাড়ালে মূল্যস্ফীতির মধ্যে হিমশিম খেতে থাকা উপকারভোগীদের জন্য জীবন চালানো খুব কঠিন হয়ে পড়বে।
সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর জন্য চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ রয়েছে ১.২৬ লাখ কোটি টাকার বেশি। আগামী অর্থবছরে এর পরিমাণ প্রায় ১.৩ লাখ কোটি টাকা হতে পারে বলে জানিয়েছেন অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা।
চলতি অর্থবছর ৫৮.০১ লাখ বয়স্ক নাগরিক ভাতার আওতায় রয়েছেন। এ খাতে বরাদ্দ রয়েছে ৪ হাজার ২০৫.৯৬ কোটি টাকা। ৯০ বছর বা তার অধিক বয়স্কদের ভাতা বৃদ্ধির পাশাপাশি উপকারভোগীর সংখ্যা আরও দুই লাখ বাড়ানোর লক্ষ্য থাকায় ব্যয়ের পরিমাণ প্রায় ২২০ কোটি টাকা বাড়তে পারে। এজন্য আগামী অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে ৪ হাজার ৪২৫.৩৫ কোটি টাকা রাখা হচ্ছে।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (বয়স্ক ভাতা) ফরিদ আহমেদ মোল্লা টিবিএসকে বলেন, '৯০ বছর বা তার অধিক বয়সি প্রায় দুই লাখের মতো বয়স্ক নাগরিক বর্তমানে বয়স্ক ভাতার আওতায় রয়েছেন। তাদের ভাতা বাড়ানোর কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে বয়স্ক ভাতা প্রকল্পে দুই লাখ নতুন উপকারভোগী যুক্ত হতে পারেন।'
চলতি অর্থবছরে ২৫.৭৫ লাখ বিধবা ও স্বামী-নিগৃহীতা নারীর ভাতার জন্য ১ হাজার ৭১১.৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। বর্তমানে তারা প্রতি মাসে ৫৫০ টাকা ভাতা পাচ্ছেন। আগামী অর্থবছর বিধবা ও স্বামী-নিগৃহীতাদের ভাতা বাবদ বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ১ হাজার ৯৩০.৭৭ কোটি টাকা। আরও এক লাখ নারী এ ভাতার আওতায় আসবেন বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
বর্তমানে ২৯.৮৭ লাখ অস্বচ্ছল প্রতিবন্ধী মাসে ৮৫০ টাকা করে ভাতা পাচ্ছেন। চলতি অর্থবছরে এজন্য বরাদ্দ রয়েছে ২ হাজার ৯৭৮.৭১ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে আরও এক লাখ প্রতিবন্ধী ভাতার আওতায় আসবেন। তবে ভাতার পরিমাণ অপরিবর্তিত থাকবে। নতুন উপকারভোগী যুক্ত হওয়ায় এ খাতে বরাদ্দ বেড়ে ৩ হাজার ১৯৮.০৮ কোটি টাকায় উন্নীত হতে পারে বলে জানান কর্মকর্তারা।
অর্থ বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ টিবিএসকে বলেন, 'আগামী বাজেটে যে পাঁচটি খাতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া উচিত, তার মধ্যে রয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, দক্ষতা উন্নয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তা।'
তিনি আরও বলেন, 'উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়ে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের আওতায় বিভিন্ন ভাতার পরিমাণ বাড়ানো দরকার। এতে যে বাড়তি টাকা লাগবে, রাজস্ব আদায়ে বাড়তি মনোযোগ দিলে তা আহরণ করা সম্ভব হবে।'
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য মাসিক সম্মানী ৩০ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। বর্তমানে বীর মুক্তিযোদ্ধারা মাসে ২০ হাজার টাকা করে সম্মানী পান।
এছাড়া আগামী অর্থবছর থেকে ৯০ বছর বা তার বেশি বয়সি ব্যক্তিদের জন্য ভাতার পরিমাণ বাড়াতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও পরিকল্পনা বিভাগ থেকে অর্থমন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করা হয়েছে বলে। তার পরিপ্রেক্ষিতে আগামী অর্থবছরে তাদের মাসিক ভাতার পরিমাণ ৬০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০০ টাকা নির্ধারণ করা হচ্ছে বলে অর্থবিভাগের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে জানিয়েছেন।
তবে আগামী অর্থবছরে ভাতার পরিমাণ বাড়ানো হবে না বলে জানিয়েছেন অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা।
৬০ বছরের বেশি বয়সি সবাই আসবেন সামাজিক নিরাপত্তার প্রকল্পের আওতায়
মাসে ১০ হাজার টাকার কম আয় করেন এমন ৬৫ বছরের অধিক বয়সি পুরুষ ও ৬২ বছরের অধিক বয়সি নারীরা বয়স্ক ভাতার আওতায় রয়েছেন। বর্তমানে তারা মাসে ৬০০ টাকা করে ভাতা পাচ্ছেন।
চলতি অর্থবছর দেশের ২৬২ উপজেলায় সব যোগ্য প্রবীণ নাগরিক এ সুবিধা পাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা। বাকি ২৩৩ উপজেলার সব যোগ্য ব্যক্তিকে বয়স্ক ভাতার আওতায় আনলে উপকারভোগীর সংখ্যা আরও আট লাখ বাড়াতে হবে বলে জানান তারা।
অবশ্য সর্বজনীন পেনশনের আওতায় যখন বয়স্করা মাসিক পেনশন পাওয়া শুরু করবেন, তখন পর্যায়ক্রমে বয়স্ক ভাতায় উপকারভোগীর সংখ্যা আবার কমতে থাকবে বলে জানান কর্মকর্তারা।
পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের তৈরি করা 'সামাজিক সুরক্ষা সেক্টর অ্যাকশন প্ল্যান' প্রতিবেদনে দেশের ৬০ বছরের বেশি বয়সি সব নাগরিককে বয়স্ক ভাতার আওতায় আনার সুপারিশ করা হয়েছে।
এছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর উপকারভোগীদের তালিকা যাচাই করে প্রকৃত দরিদ্রদের সুবিধা দেওয়া এবং এ খাতে বরাদ্দের হার বাড়িয়ে জিডিপির ৩ শতাংশে উন্নীত করার সুপারিশ করা হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তাখাতে চলতি অর্থবছরে জিডিপির ২.৫২ শতাংশ বরাদ্দ রয়েছে।
অর্থ বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, 'সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সরকার নাগরিকদের সুবিধা দিয়ে থাকে। আগামী অর্থবছরে এ ধরনের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে বরাদ্দ বাড়ছে। ফলে সামগ্রিকভাবে আগামী অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তায় সরকারের খরচ বাড়বে।'
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে নতুন অর্থবছরে বরাদ্দ বাড়ছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। এর মধ্যে শারীরিক প্রতিবন্ধী কল্যাণ ট্রাস্ট, নিউরো ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট, ৭৪টি বুদ্ধি প্রতিবন্ধী স্কুল, ১৩টি শেখ রাসেল শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনবার্সন কেন্দ্র এবং ১০৩টি প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রের অনুকূলে চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরে বাজেট বরাদ্দ বাড়ছে বলে অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
এছাড়া ছোটমণি নিবাস, সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো, সরকারি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়, সরকারি শিশু পরিবার কার্যালয় এবং মহিলা ও শিশু-কিশোরী হেফাজতীদের নিরাপদ আবাসন কেন্দ্রগুলোর বরাদ্দও নতুন অর্থবছরে বাড়ানো হচ্ছে বলে জানান কর্মকর্তারা।