উপকূলের পর স্থলভাগও রিমালের তাণ্ডবে লন্ডভন্ড, রাজধানীতেও দমকা হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টি
ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডব দেখেছে বরিশালের উপকূল। এতে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে কলাপাড়া, খেপুপাড়া, রাঙ্গাবালি, বরগুনা, পাথরঘাটা, মনপুরা, বোরহানউদ্দিন, দৌলতখানসহ বেশ কয়েকটি উপজেলা। স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৪ থেকে ৫ ফুট, কোথাও কোথাও ৬ থেকে ৭ ফুট ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাটের ওপর দিয়েও প্রচণ্ড বেগে ঝড় বয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
আবহাওয়া অফিস, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে রাজধানী ঢাকায়ও শুরু হয়েছে দমকা হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টিপাত। আজ সোমবার (২৭ মে) ভোর থেকে আরম্ভ হয় বৃষ্টি।
ঘূর্ণিঝড়ের কারণে রোববার বিকেল ও সন্ধ্যা থেকে বাগেরহাট, ভোলা, পটুয়াখালীসহ উপকূলীয় বিভিন্ন এলাকা বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার আন্ধারমানিক নদীতীরের বাসিন্দা শামীম সিকদার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'খুব ভয়ংকর পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছি। ঘরের চালা নিয়ে গেছে। নদীর পানি প্লাবিত হয়ে চারদিকে তলিয়ে গেছে। গাছপালা ভেঙে তছনছ করে দিচ্ছে। কত-শত ঘর ভেঙেছে, ধারণাও করা যাচ্ছে না।'
রাঙ্গাবালী উপজেলার সাবেক ইউপি মেম্বার এমাদুল বেপারী গত রাতে জানান, পুরো উপজেলা বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে। পানি ক্রমেই বাড়ছে।
ভোলা জেলার মনপুরা উপজেলার দক্ষিণ সাঁকুচিয়ার বাসিন্দা সেকেন্দার সিকদার বলেন, 'অনেক মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে আসেনি। তাদের কী হাল হচ্ছে জানি না। আশ্রয় কেন্দ্রে থেকেই আতঙ্কে আছি।'
বরগুনার নিশানবাড়িয় এলাকার শহিদুল বলেন, 'আশ্রয় কেন্দ্রে এসেও নিরাপদ লাগছে না। নদীর পানি সবখানে তলিয়ে ফেলেছে। প্রকাণ্ড ঢেউ, গাছ ভেঙে ফেলছে কঞ্চির মতো। রাস্তা ভেঙে গেছে। বরগুনা লন্ডভন্ড হয়ে গেছে।'
বরিশাল বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, বিভাগের ছয় জেলায় ৩ লাখের মতো মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। আশ্রয় কেন্দ্রে আসা ব্যাক্তিদের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলে সার্বিক চিত্র জানা গেছে।
জানা গেছে, কলাপাড়া উপজেলার লালুয়া ইউনিয়নের মুন্সিপাড়া, মঞ্জুপাড়া, চর চান্দুপাড়া, হাসনাপাড়া, চন্দপাড়া, পশুরিবুনিয়া, ছোট পাঁচ নম্বর, বড় পাঁচ নম্বর ও বানাতিসহ নয়টি গ্রামের বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে তলিয়ে গেছে ২৪টি গ্রামের ঘরবাড়ি।
ভোলা জেলার ধনিয়া, নাছির মাঝি, রাজাপুর, শিবপুর, চটকিমারার চর, চরফ্যাশন উপজেলার ঢালচর, কুকরী-মুকরি ও চর পাতিলা, দৌলুতখানের সৈয়দপর, মনপুরার পুরো উপজেলাসহ কমপক্ষে ১৫০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
বরগুনা, আমতলী, তালতলী ও পাথরঘাটা উপজেলার ১০০টির বেশি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বেশ কয়েকটি জায়গায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেড়িবাঁধ।
এদিকে বরিশাল জেলার হিজলা, মেহেন্দীগঞ্জ, মুলাদী, বাকেরগঞ্জ এলাকায় প্লাবনের পরিমাণ বেশি। জেলার কমপক্ষে ৮০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
পিরোজপুরেও অর্ধশত গ্রাম প্লাবিত হয়েছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।
কলাপাড়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রবিউল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের ১৫৫টি আশ্রয়কেন্দ্র এবং ২০টি মুজিব কিল্লাতে এখন পর্যন্ত ১৩ হাজার মানুষকে আশ্রয় দিতে পেরেছি। যেসব এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ রয়েছে, সেসব এলাকার সবাইকে আমরা আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে বাধ্য করেছি। প্রতিটি আশ্রয়কেন্দ্রে পর্যাপ্ত শুকনো খাবার ও সুপেয় পানি নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে বর্তমানে কলাপাড়ার উপকূলবর্তী এলাকাগুলো অতিক্রম করছে ঘূর্ণিঝড় রিমাল। এখানকার পরিস্থিতি অত্যান্ত উদ্বেগজনক।'
বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন উপজেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৪২টি উপজেলা বর্তমানে বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন। প্রবল বর্ষণ আর বাতাসের বেগে ক্যাবল ছিড়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন রাখা হয়েছে।
পটুয়াখালীর খেপুপাড়া রাডার স্টেশনের ইনচার্জ আব্দুল জব্বার শরীফ বলেন, ইতিমধ্যে ঘূর্ণিঝড়টি উপকূল হয়ে স্থলভাগের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ৫-৬ ঘণ্টা উপকূলে থাকতে পারে।
বরিশাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী তাজুল ইসলাম বলেন, বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ ১১টি নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গতকাল সন্ধ্যা ৬টার প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে তিনি জানান, বরিশালের বুড়িশ্বর নদীর পানি বিপৎসীমার ১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে, ঝালকাঠির বিশখালী ২৬ সেন্টিমিটার, ভোলা জেলার দৌলতখান উপজেলার সুরা-মেঘনা নদীর পানি ৬৪ সেন্টিমিটার, তজুমদ্দিনের মেঘনা ১ মিটার ১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে, ভোলার তেঁতুলিয়া ১৪ সেন্টিমিটার, পটুয়াখালী জেলার মির্জাগঞ্জ উপজেলার বুড়িশ্বর ৩৫ সেন্টিমিটার, বরগুনা জেলার আমতলী উপজেলার বুড়িশ্বর নদীর পানি ৩৩ সেন্টিমিটার, বরগুনা সদরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত বিশখালী ৬৭ সেন্টিমিটার, পাথরঘাটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত বিশখালী ৭২ সেন্টিমিটার, পিরোজপুর জেলার বলেশ্বর নদী ৩৩ সেন্টিমিটার ও পিরোজপুরের কঁচা নদী ৩১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।
তাজুল ইসলাম বলেন, 'পরবর্তী কয়েক ঘণ্টায় পানির উচ্চতা আরও বেড়েছে।'
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া প্রবল ঘূর্ণিঝড় রিমাল রোববার রাতে উপকূলে আঘাত হেনেছে। রাত ৮টার দিকে ঘূর্ণিঝড়টির কেন্দ্র মোংলার দক্ষিণ-পশ্চিম দিক দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ উপকূল ও বাংলাদেশের খেপুপাড়া উপকূল অতিক্রম করতে আরম্ভ করে। এ ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী, বরগুনাসহ উপকূলের বিভিন্ন জেলায় ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যায়। বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৯০ থেকে ১২০ কিলোমিটার। এর প্রভাবে বিভিন্ন এলাকায় সৃষ্টি হয় জলোচ্ছ্বাসের।