ঘূর্ণিঝড় রিমাল: বরিশাল বিভাগে নিহত অন্তত ১০, ঘর ভেঙেছে প্রায় ৮০ হাজার
বরগুনা জেলার বিষখালী নদীতীরবর্তী বড়ইতলার বাসিন্দা আয়নাল মুন্সী। নদীপাড়ের ঘাটে ছোট্ট পুঁজির ব্যবসা তার। ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে দোকানের কোনো মালামাল রক্ষা করতে পারেননি তিনি।
'সিডরের বৎসর দোহানের [দোকান] মইদ্যে ছেলাম। ওইবার মোর দোহান ভাংছে। কিন্তু সব শ্যাষ হয় নাই। রেমেল মোর দোকানটা ধ্বংস কইরা দি গ্যাছে,' আক্ষেপ করে বলেন আয়নাল।
নিজের ৬০ বছরের জীবনে কখনো এত বিধ্বংসী ঝড় দেখেননি বলে জানা বৃদ্ধ আয়নাল। তিনি বলেন 'ফিবার ঝড়-বইন্যা মোকাবেলা কইরা বাঁচি। রেমেলের মতন খারাপ ঝড় ষাইট [৬০] বৎসরের লাইফে দেহি নাই। এক-দুই ঘোণ্টা নয় ১৬–১৭ ঘোণ্টা হামলা চলাইছে।'
দোকানের ভেঙে যাওয়া অংশ মেরামত করতে করতে বিমর্ষ আয়নাল বলেন, এফির [এবার] সিগনালডা সোময় মতন লাগছে, তাই মানুষ কম মরছে। তয় এফির সম্পদের ক্ষতি বেমালা। জানে না মালে খাইছে এফির।'
প্রতি বছরই কোনো না কোনো ঝড় মোকাবিলা করেন বরিশাল বিভাগের উপকূলীয় জেলা বরগুনা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর ও ভোলার বাসিন্দারা।
দুই সন্তান নিয়ে পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার কুয়াকাটা পৌর শহরের আশি ঘর কলোনীতে থাকেন রেহানা বেগম। তিনি বলেন, 'সিডরের পর এইহানে সেনাবাহিনী আমাগো ঘর তুইল্লা দিছিল। রিমাল আইসা পুরা কলোনীর ঘর ধ্বংস কইরা দিয়া গ্যালো। আমাগো খাওয়ার কিছু নাই। কোনো সাহায্য নাই। এহন খোলা আসমানের তলে আছি।'
উড়ে যাওয়া ঘরের চালা অনেক খোঁজাখুঁজি করেও পাননি কলোনির আরেক বাসিন্দা নূরুন্নহার বেগম। গত তিনদিন তার চুলায় আগুন জ্বলেনি। 'আমাদের খাবার নেই, খাবার পানি নেই। ঘুমানোর মতো কোনো ব্যবস্থা নেই। রিমাল আমাদের নিঃস্ব করে দিয়ে গেছে,' বলেন তিনি।
শুধু তারাই নন, বরিশাল বিভাগের ছয় জেলায় কমপক্ষে ৮০ হাজার ঘর প্রবল ঘূর্ণিঝড় রিমালে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রোববার (২৬ মে) দেশের উপকূলে আঘাত হানা এ ঝড়ে বিভাগে অন্তত ১০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। কমপক্ষে ৪০০ স্থানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেড়িবাঁধ। পাশাপাশি মৎস ও কৃষিখাতের প্রচুর ক্ষতির আশঙ্কা করছে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো।
অন্তত ১০ জনের প্রাণহানি
রোববার সন্ধ্যার পর থেকে উপকূলে আঘাত হানতে শুরু করার পর সোমবারও দেশের বিভিন্ন জেলায় তাণ্ডব চালিয়েছে ঘূর্ণিঝড় রিমাল। দীর্ঘ তাণ্ডবে বরিশাল বিভাগের চার জেলায় অন্তত ১০ জন নিহতের খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে বরিশালে তিনজন, ভোলায় তিনজন, বরগুনায় একজন ও পটুয়াখালীতে তিনজন প্রাণ হারিয়েছেন।
নিহতদের মধ্যে শুধু একজন প্লাবনের পানিতে ডুবে আর বাকি নয়জন গাছ ও ঘর চাপায় নিহত হয়েছেন।
ঝড়ের রাতে বরিশাল সিটি করপোরেশনের ২৫ নং ওয়ার্ডের রুপাতলিতে দেয়াল ধসে টিনশেড ঘরে পড়লে লোকমান হোসেন ও মোকছেদুর রহমান নামক দুই ব্যক্তি নিহত হন। আর বাকেরগঞ্জ উপজেলার চর দাড়িয়ালের বাসিন্দা জালাল সিকদারের (৫৫) ওপর গাছের ডাল পড়লে তিনি মারা যান।
ঝড়ে ভোলার তিন উপজেলায় শিশুসহ তিনজন নিহত হয়েছে। এরমধ্যে লালমোহন উপজেলার পশ্চিম উমেদপুরে ঘরচাপা পড়ে আব্দুল কাদেরের স্ত্রী মনেজা খাতুন (৫৫), দৌলতখান পৌরসভার মনির হোসেনের চার বছরের মেয়ে মাইশা নিহত হয়েছে। বোরহানউদ্দিন উপজেলার সাজড়া ইউনিয়নে গাছের ডাল পড়ে জাহাঙ্গীর হোসেন (৫০) নামক এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়।
পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার কাউয়ারচরে ঢেউয়ে ভেসে গিয়ে শরীফ (২৪) নামক এক যুবক, দুমকি উপজেলার নলদোনিয়া গ্রামে গাছচাপায় জয়নাল আবেদিন (৭০) এবং বাউফলের নাজিরপুর ইউনিয়নের আব্দুল করিম (৬৫) ঘরচাপায় নিহত হয়েছেন।
স্থানীয়রা জানান, পানিবন্দি বোন আর ফুফুকে আনতে রোববার দুপুরে সাঁতরে কাউয়ারচর এলাকায় যাচ্ছিলেন শরীফ। এ সময় ঢেউয়ের ধাক্কায় ডুবে যান তিনি। দুপুর ২টার দিকে তার লাশ ভেসে ওঠে।
বরগুনা জেলার সদর উপজেলায় ঘরের ওপর পড়া গাছ সরাতে গিয়ে চাপা পড়ে আব্দুর রহমান বয়াতি (৫৬) নিহত হয়েছেন।
প্রায় ৮০ হাজার ঘর ক্ষতিগ্রস্ত
ঘূর্ণিঝড় রিমাল রোববার রাতে আঘাত হানলেও সোমবার রাত ৯টা পর্যন্ত এর প্রভাব ছিল। প্রবল বাতাস আর বৃষ্টিতে বিভাগের ছয় জেলায় কমপক্ষে ৮০ হাজার ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে প্রাথমিক পর্যালোচনায় উঠে এসেছে।
পিরোজপুর জেলা প্রশাসন থেকে জানানো হয়েছে, সোমবার রাত পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব থাকায় প্রকৃতপক্ষে মঙ্গলবার ক্ষয়ক্ষতির পরিসংখ্যান শুরু করা হয়। ফলে বুধবারের আগে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া সম্ভব নয়।
বরিশাল জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, প্রাথমিকভাবে জেলায় চার হাজারের মতো ঘর ক্ষতিগ্রস্তের কথা জানা গেছে। এর মধ্যে পুরোপুরি বিধ্বস্ত ঘরের সংখ্যা তিন থেকে সাড়ে তিনশ।
দ্বীপজেলা ভোলায় দশ হাজারের বেশি ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এরমধ্যে পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে সাড়ে তিন হাজার ঘর। জেলা প্রশাসন আরিফুজ্জামান বলেন, 'ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী ক্ষতি নিরুপণে কাজ চলছে। সব তথ্য হাতে এলে সঠিক পরিসংখ্যান বলা যাবে।'
বরগুনা জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, জেলায় প্রায় ১৭ হাজার ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্যদিকে পটুয়াখালীতে ক্ষতিগ্রস্ত ঘরের সংখ্যা কমপক্ষে ৩০ হাজারের কাছাকাছি হবে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।
১০০ কোটি টাকার মৎস্য সম্পদের ক্ষতি
পটুয়াখালী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম বলেন, 'প্রাথমিক পর্যায়ে জেলায় ২৯ কোটি ৬৯ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণ করেছি। এটি আরও বেশি হতে পারে।'
পটুয়াখালীর পাশাপাশি ভোলা ও বরগুনাতেও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। নির্দিষ্ট তথ্য না পাওয়া গেলেও মৎস্য অধিদপ্তরের বিভাগীয় অফিস থেকে জানা গেছে, কমপক্ষে ১০০ কোটি টাকার মৎস্য সম্পদের ক্ষতি হয়েছে।
তবে সমুদ্রে মা ইলিশ রক্ষায় ৬৫ দিনের অভিযান চলায় বিভাগের সকল জেলেরা স্থলে অবস্থান করছিলেন। তাদের নৌকাগুলোও নোঙর করা ছিল। ফলে প্রাণহানি ও জেলেদের ক্ষতি হয়নি বলে জানিয়েছেন মৎস অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় পরিচালক নৃপেন্দ্রনাথ বিশ্বাস।
'জেলেদের ক্ষতি না হলেও মাছচাষীরা পথে বসেছেন। এখন পর্যন্ত যে তথ্য এসেছে, তাতে ৫০ শতাংশ মৎস্যচাষী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এ সংখ্যা আরও বাড়বে।'
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক কৃষিবিদ শওকত ওসমান বলেন, প্রবল বাতাস আর প্লাবনে কৃষিতেও ব্যাপক ক্ষতির ধারণা করা হচ্ছে।
৪০০ স্থানে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত
বরিশাল পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানিয়েছে, বিভাগের মোট বেড়িবাঁধের ১৫৮টি দুর্বল স্থানসহ কমপক্ষে ৪০০ স্থানে বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড দক্ষিণাঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল হান্নান বলেন, 'আমরা ক্ষতিগ্রস্ত স্থান শনাক্তে কাজ করছি। যেসব স্থানে ভেঙেছে তা দ্রুত মেরামতে কাজ চলছে।'
পাউবো উপ সহকারি প্রকৌশলী তাজুল ইসলাম বলেন, বিভাগরর গুরুত্বপূর্ণ ১১টি নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড়ের রাতে বেশ কয়েকটি নদীর পানি ৬-৭ ফুট উঁচুতে প্রবাহিত হয়েছে।
বরিশাল আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ বশির আহমেদ জানিয়েছেন, ঘূর্ণিঝড়ের পরবর্তী ২৪ ঘন্টায় ১৪৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।