দালাল যেভাবে স্বপ্নভঙ্গ করল তানভীরের, বিদেশ যাবার আগেই হলেন লাশ
একটু ভালোভাবে বাঁচার আশায় দালালের মাধ্যমে সাড়ে ৬ লাখ টাকা দিয়ে মালয়েশিয়া যেতে চেয়েছিলেন তানভীর মোল্লা (২০)। কিন্তু একাধিকবার তারিখ দিয়েও তাকে মালয়েশিয়া পাঠাতে পারেননি দালাল। সর্বশেষ গত ৩১ মে তানভীরকে মালয়েশিয়ার ফ্লাইটের তারিখ দেওয়া হয়। কিন্তু এবারও যেতে পারলেন না তিনি।
স্বপ্নভঙ্গ হওয়ায় ঢাকা থেকে বাড়ি ফেরার জন্য রওনা হলেও দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়ে গতকাল রোববার (২ জুন) শেষবারের মতো নিথর দেহে বাড়ি ফিরেন এ তরুণ।
রোববার দুপুরে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার মেঘনা নদী থেকে ভাসমান অবস্থায় তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার দেবগ্রাম এলাকার মেরাজ মোল্লার ছেলে।
তানভীরের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তানভীরকে মালয়েশিয়ায় পাঠানোর জন্য আলমগীর হোসেন নামে এক দালালকে সাড়ে ৬ লাখ টাকা দেয় তার পরিবার। এ টাকা জোগাড় করতে বসতবাড়ির পাশে দেড় শতাংশ জমিও বিক্রি করতে হয়েছে তানভীরের পরিবারকে।
দালালের সঙ্গে কথা হয়েছিল, তানভীরকে একটি সুপারশপে ভালো বেতনে চাকরি দেওয়া হবে। এজন্য সাড়ে চার মাস আগে দালাল ফ্লাইটের তারিখ দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে শেষ মুহূর্তে ফ্লাইট বাতিল হওয়ার কথা জানান দালাল।
তবে ওই দালাল কয়েকদিন আগে বেশ কয়েকজনকে মালয়েশিয়ায় পাঠাতে পারায় তানভীরের পরিবারের বিশ্বাস জন্মায়, তাকেও এবার বিদেশে পাঠাতে পারবেন তিনি। দালালের কথামতো গত ৩০ মে তানভীরকে নিয়ে ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওনা হন তার বাবা মেরাজ মোল্লা।
কিন্তু এবারও ঢাকায় পৌঁছার পর ফ্লাইট বাতিল হয়ে গেছে বলে জানান দালাল। পরবর্তী ফ্লাইটের তারিখ ৬ জুন জানানো হয় তানভীর ও তার বাবাকে। তাই বাধ্য হয়ে ৩১ মে বিকেলে ছেলেকে নিয়ে উপকূল এক্সপ্রেস ট্রেনে করে বাড়িতে ফিরে আসছিলেন মেরাজ। পথিমধ্যে ট্রেনটি কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলায় সৈয়দ নজরুল ইসলাম রেলসেতু অতিক্রম করার সময় দরজা থেকে ছিটকে নিচে মেঘনা নদীতে পড়েন তানভীর। ট্রেনের ভেতরে যাত্রীদের ভিড় ও গরম এড়াতে তানভীর তার আসন ছেড়ে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন বলে জানান তানভীরের বাবা।
তানভীর নদীতে পড়ে যাওয়ার পর টানা দুই দিন খোঁজাখুঁজি করেও তার সন্ধান পায়নি নৌ-পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসেরর ডুবুরি দল। এরপর গতকাল রোববার দুপুরে রায়পুরা থেকে নদীতে ভাসমান অবস্থায় তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনার পর থেকে দালাল আলমগীর গা-ঢাকা দিয়েছেন।
মেরাজ মোল্লা ও শারমিন আক্তার দম্পতির দুই সন্তানের মধ্যে তানভীর ছোট। রোববার সন্ধ্যায় তার মরদেহ গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। ছেলের মৃত্যুশোকে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন মা শারমীন আক্তার।
তানভীরের বাবা মেরাজ পেশায় মুদি দোকানি। বাড়ির পাশেই তার দোকান। তবে গত ৩০ মে থেকে দোকানটি বন্ধ রয়েছে। ওই দিনই ছেলেকে ঢাকায় নিয়ে যান মেরাজ।
তানভীরের মামা ইমরান হোসেন জানান, আখাউড়ার নয়াদিল গ্রামের দালাল আলমগীর হোসেনের মাধ্যমে তানভীরকে মালয়েশিয়া পাঠানোর প্রস্তুতি চলছিল। চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি একবার ফ্লাইটের তারিখ দিয়েছিলেন আলমগীর। কিন্তু তখন ফ্লাইট বাতিল হয়। এবারও মালয়েশিয়ায় পাঠানোর কথা বলে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে ফ্লাইট বাতিল হওয়ার কথা জানিয়েছেন। ঘটনার পর থেকে আলমগীরের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না।
তানভীরের মা শারমিন আক্তার বলেন, 'ফ্লাইট বাতিল হয়েছে জানিয়ে তানভীর আমাকে ফোন করে বাড়ি ফিরে আসছে বলে জানায়। আমি ছেলের জন্য বাজার থেকে লিচু কিনে আনি। বাড়িতে ছেলের পছন্দের মুরগি ও গরুর মাংস রান্না করি। এসব ছেলে ভীষণ পছন্দ করত। একমাত্র ছেলের সঙ্গে এমন হবে, কে জানত?'
তানভীরের বাবা মেরাজ মোল্লা বলেন, 'দালাল যদি কথা দিয়ে কথা রাখত, তাহলে তানভীরকে হয়তো লাশ হতে হতো না। সে এখন মালয়েশিয়ায় থাকত। চুক্তির সব টাকা নিয়েও দালাল তানভীরকে বিদেশে পাঠাতে পারেনি।'