শীতকাল ছিল দীর্ঘ, তারপর তাপদাহ— রাজশাহীতে আমের ফলন কম, তাই দামও চড়া
রাজশাহীর বাজারে এখন পাওয়া যাচ্ছে গোপালভোগ, লখনা, খিরসাপাত, গুটিসহ নানান জাতের আম। ম্যাঙ্গো ক্যালেন্ডার অনুযায়ী সময়মতো আম উঠলেও বাজার ঘুরে দেখা গেলো, দামে তা অন্যান্য বছরের তুলনায় কিছুটা চড়া। আমচাষী ও বাগান মালিকরা বলছেন, এবার গাছে আম না থাকায় দাম আগের বছরগুলোর তুলনায় কিছুটা বেশি।
আমের পাইকারি বাজারের মোকাম রাজশাহীর বানেশ্বর বাজার ঘুরে দেখা যায়, বাজারে প্রতিমণ গোপালভোগ আম ২ হাজার ৮০০ থেকে ৩ হাজার ৪০০ টাকা; খিরসাপাত ২ হাজার ৮০০ থেকে ৩ হাজার ২০০ টাকা; লখনা ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা এবং গুটি আম ১ হজার ২০০ থেকে ২ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
আম ব্যবসায়ী আকতার জানান, বাজারে আম কম থাকায় আমদানির কারণে দাম এবার বেশি।
বাজারে গোপালভোগ ও গুটি আম বিক্রি করতে এসেছেন আমচাষী রজব আলী। গোপালভোগ ৩ হাজার ৪০০ টাকা এবং ভালো জাতের গুটি আম ২ হাজার টাকা মণ বিক্রি করছেন তিনি।
রজব আলী জানান, চারঘাটে তার ৬০ বিঘার মতো আমের বাগান আছে। গতবারের চেয়ে এবার আমের ফলন অর্ধেক হয়েছে। তবে অন্যান্যদের তুলনায় তার বাগানে আম ভালো আছে।
"আমের প্রচুর যত্ন নেওয়ায় এবার বাগানে পর্যাপ্ত আম আছে। পর্যাপ্ত সেচ ও কীটনাশক দেওয়ায় আম সাইজেও বড় হয়েছে। এইজন্য দাম ভালো পাচ্ছি," বললেন রজব আলী। গত শুক্রবার ১২ মণ ও শনিবার ৮ মণ গোপালভোগ আম বিক্রি করেছেন তিনি।
রাজশাহীর বাঘার আমচাষী শফিকুল ইসলাম সানা গতবছর প্রায় এক কোটি টাকার আম বিক্রি করেছিলেন। তারমধ্যে ২৬ মেট্রিক টন আম বিদেশেই রপ্তানি করেছিলেন তিনি।
এ বছরও শফিকুল ৩০০ বিঘা জমিতে আমের চাষ করছেন। তবে এবার গাছে অর্ধেকেরও কম ফলন হয়েছে।
তারপরেও বাঘার অন্য চাষীদের তুলনায় তার অবস্থা কিছুটা ভালো। পরিচর্যা বেশি নেওয়ায় আমের সাইজও ভালো হয়েছে জানিয়ে শফিকুল বলেন, "ঘূর্ণিঝড় রিমালে ৫ শতাংশের মতো আম পড়ে গেছে। তারপরও আমার বাগানে ৪০ শতাংশের মতো আম আছে। তবে অন্য চাষীদের অবস্থা খারাপ। ২০ শতাংশের কম আম এসেছে তাদের বাগানে।"
বৃহস্পতিবার তিনি ৩০০ কেজি এবং শুক্রবারে ৫০০ কেজি গোপালভোগ বিক্রি করেছেন জানিয়ে শফিকুল বলেন, "এক্সপোর্ট সাইজের গোপালভোগ ৪ হাজার টাকা মণ বিক্রি করেছি। এগুলোর প্রতিটির ওজন ২০০ গ্রামের ওপরে। তবে স্থানীয় বাজারে গোপালভোগ ২ হাজার ৮০০ থেকে ৩ হাজার ২০০ টাকা মণে বিক্রি হচ্ছে। হিমসাগর জাতের আমের দামও একই।"
তিনি বলেন, "ভালো জাতের গুটি আমও ১০০ টাকা কেজিতে বিক্রি করেছি। তবে স্থানীয় বাজারে গুটিজাতের আম ৩০ থেকে ৪০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়, যেগুলো আচারের জন্য ব্যবহার করা হয়। বাঘায় সবচেয়ে বেশি আম হয় লক্ষণভোগ, এটি বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ২০০ টাকা মণ হিসেবে।"
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলে এ বছর গাছে দেরিতে মুকুল আসে। মুকুলও কম এসেছিল। এর কিছুদিন পর শিলাবৃষ্টিতে কিছু মুকুল আবার ঝরেও যায়। অনেক মুকুলে ধরে পচন। এরপর এপ্রিলের তীব্র তাপদাহে গুটি ঝরে পড়ে আমের। সবশেষে ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণেও রাজশাহীর আম এবার বেশ ক্ষতির শিকার হয়েছে।
চারঘাটের আমচাষী ডাবলু ২০ বিঘা জমিতে আম চাষ করেছেন। তিনি জানান, "প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করেই আমাকে টিকে থাকতে হয়েছে। যারা আমের পরিচর্যা নিয়েছেন, তাদের গাছে আম ভালো আছে।"
রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের অবসরপ্রাপ্ত সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলীম উদ্দীন বলেন, আবহাওয়াগত কারণে আমের ফলনে অনেকটা তারতম্য ঘটে। আবার এক বছর আমের ফলন ভালো হলে, পরের বছর স্বাভাবিকভাবেই গাছে কম আম আসে।
তিনি বলেন, "এবার শীতকাল দীর্ঘ সময় থাকায় গাছে মুকুল কম এসেছে। আবার তাপদাহের কারণেও আমের ফলনে তারতম্য হয়েছে। সব মিলিয়ে এবার আমের অফসিজন চলছে।"
"তারপরও এখন যেহেতু নানা জাতের আমের চাষ হয়, তাই এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে। একটা আমের ফলন ভালো না, হলে অন্য আমের ফলন ভালো হচ্ছে। এবার গোপালভোগ, খিরসাপাত, হিমসাগর ও লখনা আমের ফলন কম হলেও বারি আম-৩, বারি আম-৪ ও বারি আম-১১ এর ফলন ভালো হয়েছে। এই আম বিক্রি করে সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে," যোগ করেন তিনি।
আলীম উদ্দীন আরও বলেন, "কৃষক ও কৃষি বিভাগ এখন আম ম্যানেজমেন্টের বিষয়ে অনেক দক্ষ। ১০ বছর আগেও এইরকম চরম বৈরী আবহাওয়া থাকলে গাছে আম টেকানোই মুশকিল ছিল। কিন্তু এখন সবাই ম্যানেজমেন্টে দক্ষ হওয়ায় প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও গাছে আম পাওয়া সম্ভব হচ্ছে।"
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে— এবার রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৯৩ হাজার ২২৪ হেক্টর জমিতে আমের আবাদ হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১২,১৯,৯১০ হেক্টর জমির। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ২৪,০১১ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে বারি আম-৩ বা আম্রপালি। এরপর রয়েছে যথাক্রমে— আশ্বিনা (১৩,৭৩০ হেক্টর); ফজলি (১১,৯৭৭ হেক্টর); লক্ষ্মভোগ (৯,৬৬৯ হেক্টর) খিরসাপাত (৯,০২১ হেক্টর); ল্যাংড়া (৬,৭১৫ হেক্টর) এবং বারি আম-৪ (৩,৬৬২ হেক্টর)।
রাজশাহীর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রাজশাহী অঞ্চলের উপ-পরিচালক ড. মো. মোতালেব হোসেন বলেন, "চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল ও গোমস্তাপুর এবং নওগাঁর নিয়ামতপুর, পোরশা, সাপাহার ও পত্মীতলার উঁচু বরেন্দ্রভূমিতে কৃষি উদ্যোক্তারা নতুন বাগান করেছেন। এসব বাগানে বারি আম-৩ বা আম্রপালি, বারি আম-৪, কাটিমন, গৌড়মতিসহ নতুন নতুন জাতের আমগুলো এখন আর 'অফইয়ার', 'অনএয়ার' মেইনটেইন করছে না। এসব জাতের গাছে প্রতিবছরই আম ধরে এবং ভালো আম ধরে।"
"অন্যদিকে গোপালভোগ, ল্যাংড়া, খিরসাপাত জাতের আমের ফলন একবছর বেশি হলে সাধারণত পরের বছর কিছুটা কম হয়। এই আমগুলো রাজশাহীর চারঘাট ও বাঘা এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে বেশি হয়। এসব গাছে এবার কম আম এসেছে। এছাড়া, দীর্ঘ তাপপ্রবাহের কারণেও আমের ফলন কম হয়েছে। দাম ও ফলন মিলিয়ে কিছু চাষী লাভবান হবেন এবং কিছু চাষী লোকসানে পড়বেন বলে মনে করা হচ্ছে," যোগ করেন তিনি।