মতিউরের বদলির আদেশ প্রত্যাহারে ‘তদবির’ করেন জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ
পুত্র ইফাতের ১৫ লাখ টাকায় কোরবানির ছাগল কেনার ঘটনায় আলোচনায় আসা রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তা মতিউর রহমান গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদে থেকে বিপুল বিত্তের মালিক হয়েছেন– এমন তথ্য সামনে আসছে। কিন্তু, মতিউরের এ প্রতিপত্তি দীর্ঘদিনের।
আজ থেকে ১৭ বছর আগে যখন তিনি রাজস্ব প্রশাসনের একজন মধ্যম স্তরের কর্মকর্তা ছিলেন, তখনও ছিলেন ব্যাপক প্রভাবশালী। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান বদিউর রহমানের লেখাতেই উঠে এসেছে এমন ঘটনা। সেনা-সমর্থিত সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে– তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদ খোদ তৎপর হয়েছিলেন মতিউরের বদলি ঠেকাতে।
২০০৭ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এনবিআরের চেয়ারম্যান ছিলেন বদিউর রহমান। তখন সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল। এসময়ে চট্টগ্রামে কাস্টমসের যুগ্ম কমিশনার হিসেবে কর্মরত ছিলেন মতিউর।
রাজস্ব প্রশাসনে গতি আনার উদ্দেশ্যে মতিউরসহ কিছু কর্মকর্তাকে বদলির সিদ্ধান্ত নেন বদিউর রহমান। এ সিদ্ধান্ত নেয়ার সঙ্গেসঙ্গেই মতিউরের পক্ষে তদবির-সুপারিশের পাল্টা চাপ আসতে থাকে। প্রথমে তা আসে রাজস্ব বোর্ডের ভেতর থেকেই।
'সরকারি চাকুরিতে আমার অনুভূতি সমগ্র' বইয়ের 'কোদালকে কোদাল বলি' শীর্ষক ষষ্ঠ অংশে বদিউর রহমান লিখেছেন, যাদের বদলি করা হবে এমন কর্মকর্তাদের তালিকা তৈরি করে কাস্টমস ক্যাডারের সংশ্লিষ্ট চার সদস্যের সঙ্গে আলোচনা করি। সেখানে মতিউরকে চট্টগ্রাম থেকে রাজশাহীতে বদলি করার সিদ্ধান্ত জানাই।
বদিউর রহমান লেখেন, 'আমি তাজ্জব হয়ে যাই, তার চট্টগ্রাম থেকে রাজশাহীতে বদলির কথা বলতেই কাস্টমসের চার সদস্য একসাথে তাদের একটা অভিমত ব্যক্ত করলেন যে মতিউরকে যেন না নাড়াই। কারণ জিজ্ঞেস করে আমি আরও তাজ্জব বনে যাই। তাঁরা আমাকে জানালেন যে এই কর্মকর্তা বড়ই প্রভাবশালী।'
তাঁকে জানানো হয়, অর্থমন্ত্রীসহ ক্ষমতাধর অনেকের সঙ্গে মতিউর রহমানের দহরম-মহরম আছে। তাঁকে বদলি করে ওই আদেশ বহাল রাখা সম্ভব হবে না।
এনবিআরের তৎকালীন চেয়ারম্যানকে আরও লিখেছেন, 'তাঁরা তার ক্ষমতার ইঙ্গিত দিয়ে এ-ও বললেন যে অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া সাহেবের বেডরুম পর্যন্ত যেমন তিনি (মতিউর) যেতে পেরেছেন, তেমনি অর্থমন্ত্রী সাইফুরের বেডরুমেও তিনি অবাধে প্রবেশ করতে পারতেন। এমনকি সাইফুরের স্ত্রী-বিয়োগে কবরস্থানে এ কর্মকর্তা কান্নাকাটিও করেছেন। সত্য-মিথ্যা জানি না, তবে চার সদস্যের একই সুরে আমি হতভম্ব হয়ে পড়ি।'
এনবিআর সদস্যরা তাঁকে পরামর্শ দেন যে, মতিউরকে ঘাঁটানো ঠিক হবে না এবং বদলির আদেশ বাতিল করতে হবে। তবু নিজ সিদ্ধান্তে অটল থাকেন চেয়ারম্যান এবং বদলির আদেশ জারি করেন। এরপরেই মতিউর রহমানের প্রভাব কতদূর তাঁর প্রমাণ পান তিনি।
বদিউর রহমান জানান, মতিউরের বদলির আদেশ বাতিলের জন্য তাঁকে অনুরোধ করে টেলিফোন করেন চট্টগ্রামের ব্রিগেডিয়ার পদমর্যাদার এক সেনা কর্মকর্তা। তাঁকে এবং চট্টগ্রাম কাস্টমসের কমিশনার ফরিদকে (পুরো নাম বইয়ে উল্লেখ করা হয়নি) – তাঁদের সিদ্ধান্ত ছাড়া রিলিজ না করার লিখিত আদেশও স্থানীয় পর্যায়ে সেনা কর্মকর্তারা জারি করেছিলেন।
বইয়ে তিনি লেখেন, 'ভিন্ন এক চাকরি থেকে কাস্টমস ক্যাডারে এসেও এ মতিউর যে কত করিৎকর্মা হয়ে উঠেছে, এর জ্বলন্ত প্রমাণ দেখলাম তার রাজশাহীতে বদলি বাতিলের তদবিরের চাপ দেখে। সেনা-নির্দেশিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওই মেয়াদে সেনা-তদবির উপেক্ষা করা তো অনেকের জন্য রীতিমতো নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলার শামিল।'
সেনা কর্মকর্তারা অবশ্য পরে কাস্টমস কমিশনারকে ছাড়তে রাজী হন, কিন্তু মতিউর রহমানের বদলি বাতিল করতেই হবে বলে 'আরও বেশি গোঁ ধরেন' তাঁরা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে, এনবিআর চেয়ারম্যান বদিউর দুর্নীতি দমন কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলেন । পরে ওই সেনা কর্মকর্তা বদিউর রহমানে সঙ্গে দেখা করে তাঁদের জারি করা আদেশের জন্য ক্ষমা চান, তবে মতিউর রহমানকে চট্টগ্রামে রাখতে আবারও অনুরোধ করেন। পরে আর্মড ফোর্সেস ডিভিশন থেকেও অনুরোধপত্র পাঠানো হয়।
বদিউর রহমান এরপর লেখেন, 'আমার অবাক হওয়া শেষ হয় না। তৎকালীন সিজিএস মেজর জেনারেল সিনা ইবনে জামালীও টেলিফোন করেন, আমি রাজি না হলে সেনাপ্রধানের সঙ্গে আমাকে কথা বলতে বলেন। আমি আরও অবাক হলাম, সেনাপ্রধান মইন উদ্দীনও দেখি মতিউরকে চট্টগ্রামে রাখার অনুরোধ করলেন।'
বইয়ে লেখা হয়েছে, এনবিআর চেয়ারম্যান বদলির আদেশ প্রত্যাহার করতে রাজি না হলে সেনাপ্রধান আলোচনার শেষ পর্যায়ে বলেন, 'আমার একটামাত্র অনুরোধ কি রাখবেন না?' 'মতিউরের বদলির আদেশ আমি বাতিল করিনি'—জানান বদিউর রহমান।
'মতিউরের তদবিরের ধার ছিল, তার তদবিরের চাপ প্রচণ্ড ছিল। তখনকার তিন উদ্দীনের রাজত্বের মধ্যে এক নম্বর এবং বাস্তবে একমাত্র ক্ষমতাশালী উদ্দীন মইন উদ্দীন আমার চেয়ারম্যানের মেয়াদে আমার কাছে বদলির একটিমাত্র তদবির করেছিলেন। আর সেই তদবির ছিল মতিউরের রাজশাহীর বদলি আদেশ বাতিল করা।'
বদিউর রহমান এনবিআর থেকে চলে যাওয়ার পর মতিউর রহমানকে আবার চট্টগ্রামে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছিল বলেও তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেছেন এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান।