তীব্র হচ্ছে কোটাবিরোধী আন্দোলন, ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ডাক
সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহাল বাতিলসহ আরও তিন দাবিতে তুমুল জনসংযোগ ও প্রচারণা করছে 'বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন'।
শুক্রবার (৫ জুলাই) বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ কর্মসূচি পালন করেছেন শিক্ষার্থীরা। শনিবারও (৬ জুলাই) সারা দেশে স্ব স্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ ও বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দিয়েছেন তারা। এছাড়া রোববার (৭ জুলাই) রোববার ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হবে।
শুক্রবার দিনের বিভিন্ন সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুরের হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ এবং মহাসড়কে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন শিক্ষার্থীরা।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা কোটা ব্যবস্থার কড়া প্রতিবাদ জানিয়ে দাবি করেন, 'কোটা এখন মেধাবীদের জন্য গলার কাঁটা।'
শুধু পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধী কোটা ছাড়া আর কোনো কোটা না রাখার দাবি জানান তারা। এছাড়া তারা ভর্তি প্রক্রিয়ারও সংস্কার দাবি করেন।
আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র নাহিদ ইসলাম বলেন, 'সরকার একটি আদেশ দিচ্ছে, বিচার বিভাগ সেটি বাতিল করে দিচ্ছে। শিক্ষার্থীরা এই প্রহসন মেনে নেবে না। আমাদের এই আন্দোলন চলমান থাকবে। সরকার থেকে আমাদের সাথে কোনো ধরনের যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়নি। আমরা এর নিন্দা জানাই।'
এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক প্রায় ৮০ হাজার সদস্যের 'কোটা পুনর্বহাল করা চলবে না' শীর্ষক গ্রুপে রোববারের ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন কর্মসূচি নিয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হচ্ছে।
এ প্রতিবেদন লেখার সময় থেকে বিগত ১৫ ঘণ্টায় গ্রুপটিতে প্রায় ২ হাজার পোস্ট প্রচার করেন আন্দোলনকরীরা।
শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৫০টি বিভাগের শিক্ষার্থীরা ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দেন। এছাড়া একই সময়ের মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ ও ব্যাচ ক্লাস পরীক্ষা বর্জনের অংশগ্রহণের কথা জানায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র খবিরুল আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'কোটা বাতিলের লড়াইয়ে আমাদের বিভাগের সব ব্যাচের শিক্ষার্থীরা রোববার ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করেছে। যতদূর জেনেছি, অন্যান্য বিভাগেও আন্দোলনকারীরা প্রচারণা চালাচ্ছেন। আশা করছি রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সবাই ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের মাধ্যমে আমাদের যৌক্তিক দাবি বাস্তবায়নের পথ সহজ করবেন।'
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীকে হল থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ
এদিকে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অমর একুশে হলের ছাত্র সারজিস আলমকে হল থেকে বের করার অভিযোগ ওঠে হল ইউনিট ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে।
এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করলে সারজিস আলমকে হলে ফেরায় প্রশাসন।
এ বিষয়ে সারজিস আলম টিবিএসকে বলেন, 'আমার রুমমেটকে ডেকে নিয়ে বলা হয়েছিল, ছাত্রলীগের হাই-কমান্ড থেকে বলা হয়েছে আমাকে হল থেকে বের করে দেওয়ার জন্য। আমি তখন ছাত্রলীগের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বললে তারাও একই কথা বলেন। পরবর্তীতে আমি কোনো ঝামেলায় না গিয়ে হল ছেড়ে বের হয়ে যেতে গেলে বাইরে শিক্ষার্থীদের দেখতে পাই। কোনো না কোনোভাবে তারা সব জেনে গিয়েছিল।'
তিনি জানান, পরে ছাত্রদের বিক্ষোভের মুখে ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক ওয়ালি আসিফ ইনান তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
'তারা প্রতিনিধি পাঠিয়ে জানান যে তারা আমাকে হল থেকে বের করে দেওয়ার জন্য কোনো নির্দেশনা দেননি,' বলেন সারজিস।
আন্দোলন নিয়ে কথা বলছেন শিক্ষকরাও
শুধু শিক্ষার্থী নয়, কোটাবিরোধী আন্দোলন আলোড়ন তুলেছে শিক্ষকদের মধ্যেও।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি নিজামুল হক ভূইয়া বলেন, 'মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরাও আমাদের শিক্ষার্থী, কোটা নিয়ে যারা আন্দোলন করছে তারাও আমাদের শিক্ষার্থী। সবার প্রতিই আমাদের সহানুভূতি আছে। সবাই আমাদের সন্তান, তাই আদালত যখন রায় দেবে তখন তাদের আন্দোলন নিয়ে আমি কথা বলব।'
অন্যদিকে আন্দোলনকারীদের পক্ষে এক বিবৃতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সাদা দল জানিয়েছে, 'মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের স্বীকৃতি এবং সম্মান জানানোর অন্য আরও অনেক বিকল্প আছে। সে বিকল্পগুলো বংশপরম্পরায়ও চলতে পারে। কিন্তু তা না করে চাকরিতে বংশপরম্পরায় ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল রাখা অযৌক্তিক বলে আমরা মনে করি।'
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, 'এ ব্যবস্থার ফলে বেকার সমস্যা যেমন প্রবল হবে, তেমনি তুলনামুলকভাবে যোগ্য ও মেধাবীরা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন। এটি এক ধরনের বৈষম্যও বটে। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের সঙ্গেও তা সঙ্গতিপূর্ণ নয়।'
শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মাদ টিবিএসকে বলেন, 'দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষক ও শিক্ষার্থী নিজেদের দাবি আদায়ে আন্দোলন করছেন, অথচ সরকার আলোচনায় কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এই অচলাবস্থা দীর্ঘায়িত হলে দেশের যে ক্ষতি হবে, তা বোঝার মতো দায়িত্বশীল সরকার নেই। অবহেলা ও অবজ্ঞার ফলে পাঁচ দিন অতিক্রম হলেও সংকট সমাধান হয়নি। অথচ একদিন বসে আলোচনা করলেই শিক্ষার এই বিশাল ক্ষতি হতো না।'
ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের
ঢাকা-টাঙ্গাইল বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়ক অবরোধ করে সরকারি চাকরিতে কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা।
শনিবার সকাল ১১টা হতে ১২ টা পর্যন্ত মহাসড়কের নগর জলপাই বাইপাস অবরোধ করে এই আন্দোলন করেন তারা। এতে মহাসড়কের উভয় প্রান্তে প্রায় ২০ কিলোমিটার জুড়ে যানজট সৃষ্টি হয়।
শিক্ষার্থীরা এসময় ২০১৮ সালে ঘোষিত সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল ও মেধাভিত্তিক নিয়োগের পরিপত্র বহাল রাখার দাবিতে স্লোগান দেন।
'১৮-এর পরিপত্র বহাল সাপেক্ষে কমিশন গঠন করে দ্রুত সময়ের মধ্যে সরকারি চাকরিতে (সকল গ্রেডে) অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাদ দিতে এবং কোটাকে ন্যূনতম পর্যায়ে নিয়ে আসার দাবিও জানান তারা। সেক্ষেত্রে সংবিধান অনুযায়ী কেবল অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনা করা যেতে পারে।
শিক্ষার্থীরা বলেন, সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় কোটা সুবিধা একাধিকবার ব্যবহার করা যাবে না এবং কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে শূন্য পদগুলোতে মেধা অনুযায়ী নিয়োগ দিতে হবে। দুর্নীতিমুক্ত, নিরপেক্ষ ও মেধাভিত্তিক আমলাতন্ত্র নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
তারা আরো বলেন, "আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া বৈষম্যমূলক কোটা পদ্ধতির কবর রচনা করতে আমরা একত্রিত হয়েছি। যেকোনো বাধাকে উপেক্ষা করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাবে। আমাদের দাবি একটাই, ২০১৮ সালের পরিপত্র পুনর্বহাল করতে হবে।"
কয়েকজন যাত্রী ও বাস চালক বলেন, কোটা আন্দোলনের কারণে তারা মহাসড়কে দুই থেকে আড়াই ঘন্টা যাবত অবস্থান করছেন, এতে তাদের ভোগান্তি হলেও, তাঁরা এই আন্দোলনের সাথে সহমত পোষণ করেছেন।