মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে যশোর সীমান্ত দিয়ে দেশ ছেড়েছেন আ.লীগের অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী
বাংলাদেশ থেকে সহজে বৈধ ও অবৈধপথে ভারতের বৃহৎ প্রবেশদ্বার যশোরের শার্শা সীমান্ত। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতাকর্মী এ সীমান্ত দিয়ে দেশ ছেড়েছেন বলে জানা গেছে।
সীমান্তপথে অবৈধভাবে যাওয়ার পাশাপাশি বেনাপোল ইমিগ্রেশনের প্রভাবশালী ও অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে অর্ধশতাধিক পদধারী নেতাকর্মী ভারতে প্রবেশ করেছেন।
এছাড়া, স্থানীয় অবৈধ ঘাট নিয়ন্ত্রণকারীদের মাধ্যমে অসংখ্য শীর্ষ নেতাকর্মী ছাড়াও বিভিন্ন মামলার আসামিরাও দেশ ছেড়েছেন।
এর মধ্যে সর্বাধিক ভিড় লক্ষ্য করা গেছে শার্শার বহুল আলোচিত পুটখালি ও ঘিবা রুটে। যশোরে বনজঙ্গল পরিপূর্ণ প্রায় ৩০ কিলোমিটার অরক্ষিত সীমান্ত রয়েছে।
এ নেতাদের সীমান্ত পাড়ি দিতে সহায়তা করছে স্থানীয় সিন্ডিকেট। কৌশলে এমপি-মন্ত্রীসহ মামলার আসামিদের পার করতে চক্রটি দুই থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত নিচ্ছে।
স্থানীয় বাসিন্দা ও চক্রটির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানতে পেরেছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।
তবে সংশ্লিষ্ট সীমান্ত এলাকাগুলোর বিজিবি ও পুলিশ দাবি করেছে, মানব পাচারের কোনো ঘটনা ঘটছে না এবং বিজিবির টহল জোরদার করা হয়েছে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতা হস্তান্তর করে ভারতে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর থেকে নানান অনিয়ম, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের সঙ্গে জড়িত রাজনৈতিক নেতা এবং সরকারি ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়।
জারি করা হয় বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা। এতে সীমান্তের বৈধ ও অবৈধ উভয় পথেই সর্বোচ্চ নিরাপত্তা জোরদার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে তাদের চোখ এড়িয়ে সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার এসব ঘটনা ঘটছে।
যে পথে পাড়ি
বৈধপথে বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে ভারতে ঢোকার সময় সাম্প্রতি ছাত্রলীগ নেতা ও বিজিবি সদস্যসহ তিনজন আটক হয়েছেন। তবে অবৈধ সীমান্তপথে এখন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাউকে আটক করতে পারেনি।
দীর্ঘকাল থেকেই বেনাপোল বন্দর থানার পুটখালি সীমান্ত মানব পাচার ও অবৈধ পথে ভারতে যাওয়ার নিরাপদ রুট হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। চোরাচালানের আরেকটি ব্যস্ত রুট হচ্ছে শার্শার ঘিবা রুট।
তবে এ দুই পথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি বাড়লে বিকল্প রুট হয়ে ওঠে পেট্রাপোলঘেঁষা সাদিপুর রুট।
এ তিনটি পথেই সীমান্তকে আলাদা করেছে নদী। নদী পার হয়ে কম জনবসতির এলাকা দিয়ে ভারতে যাওয়া যায়। মোবাইল নেটওয়ার্ক দুর্বল থাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও হুট করে অভিযান চালাতে পারে না।
তবে এ তিনটি রুটের মধ্যে পুটখালি ও ঘিবা রুটে সিন্ডিকেটের সদস্যরাই বর্তমানে আওয়ামী লীগ নেতাদের সীমান্ত পার করতে সহায়তা করছেন। সম্পর্কের কারণে প্রথমদিকে দু-একজনকে পারাপারে সহায়তা করলেও পরে এটিকে পরিণত করা হয়েছে মোটা অঙ্কের অর্থ আয়ের মাধ্যমে।
২ থেকে ১০ লাখ
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের আগে স্থানীয় এ সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ ছিল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হাতে। কিন্তু ৫ আগস্টের পর এটির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে বিপরীতধারার রাজনৈতিক কর্মীরা।
তবে তা-ই বলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সীমান্ত পার হতে খুব বেশি কাঠখড় পোড়াতে হচ্ছে না। চক্রটিকে দুই থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত দিয়ে কৌশলে সীমান্ত পার হচ্ছেন সাবেক এমপি-মন্ত্রীসহ বিভিন্ন মামলার আসামিরা।
ঘিবা সীমান্ত দিয়ে মানবপাচারের কাজে যুক্ত দুই সিন্ডিকেট সদস্যের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।
নাম না প্রকাশের শর্তে তারা জানান, 'এমপি-মন্ত্রীদের পাঠাতে ১০ লাখ টাকা এবং অন্যদের দুই থেকে পাঁচ লাখ টাকা করে নেওয়া হচ্ছে।'
ভারতে পৌঁছানোর পর এসব ব্যক্তি কলকাতাসহ বিভিন্ন এলাকায় হোটেল ও ফ্ল্যাট ভাড়া করে অবস্থান করছেন বলেও উল্লেখ করেন ওই দুই সদস্য।
সীমান্ত পাড়ি দিয়েছেন আ.লীগসংশ্লিষ্ট যারা
৫ আগস্ট থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত বেনাপোল ইমিগ্রেশনের প্রভাবশালী ও দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের 'ম্যানেজ করে' আওয়ামী লীগের অর্ধশতাধিক পদধারী নেতাকর্মী ও সাবেক সরকারের বিভিন্ন কর্মকর্তারা ভারতে গেছেন বলে জানা গেছে।
তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক যুগ্ম-কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার। ইমিগ্রেশন পুলিশের এক কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, 'এ সীমান্ত পথ দিয়ে অবৈধভাবে ভারতে গেছেন তিনি।'
টানা চারবার শার্শার সংসদ সদস্য ছিলেন শেখ আফিল উদ্দিন। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় শার্শার সীমান্তে চোরাচালান তার অনুসারীরাই নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
বেনাপোল পৌরসভার সাবেক মেয়র আশরাফুল আলম লিটন টিবিএসকে বলেন, তাদের জানামতে শেখ আফিল উদ্দিন সীমান্তপথে ঘাট মালিকদের সহযোগিতায় ভারতে চলে গেছেন।
অন্যদিকে শেখ আফিলের সহযোগিতায় ভারতে গেছেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা এবং খুলনার সাবেক সংসদ সদস্য এস এম কামাল।
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামালের ঘনিষ্ঠ এবং 'ফার্মগেটের রাজা' নামে পরিচিত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর ফরিদুর রহমান খান ওরফে ইরানও এ পথে ভারতে গেছেন। তাকে সহযোগিতা করার অভিযোগ রয়েছে জেলা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা মিলনের বিরুদ্ধে।
পুটখালি সীমান্ত দিয়ে যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার ভারতে গেছেন। শহরের একটি পাঁচ তারকা হোটেলের ম্যানেজার কলকাতার বাসিন্দা হওয়ায় তার মাধ্যমে তিনি কলকাতায় পাড়ি জমিয়েছেন বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।
শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর ঘিবা সীমান্ত দিয়ে ভারতে যাওয়া অন্যদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক এমপি (মনিরামপুর-৫) ও প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য, রণজিৎ রায় (যশোর-৪); সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বিপুল, নরেন্দ্রপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাজু আহমেদ, যশোর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাইফুজ্জামান পিকুল ও শার্শার স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা আকুল হোসাইন।
দু'দেশের ইমিগ্রেশন সিল-সই নকল
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, যে-সব নেতাকর্মী ও অপরাধী সীমান্তপথে ভারতে পালাচ্ছেন, তাদের অধিকাংশের পাসপোর্ট ও ভিসা রয়েছে। তবে ইমিগ্রেশনে পাসপোর্ট জমা দিলে ধরা পড়ার ভয়ে তারা অবৈধপথে সীমান্ত পার হচ্ছেন।
স্থানীয় সিন্ডিকেটের ওই দুই সদস্যও টিবিএসকে বলেন, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও বিভিন্ন মামলার আসামিদের সঙ্গে পাসপোর্ট রয়েছে।
ইমিগ্রেশনে কড়াকড়ি থাকায় দালালচক্র পাসপোর্টে দুই দেশের ইমিগ্রেশন সিল ও সই নকল করে তাদের পাঠাচ্ছে বলে জানান ওই দুই ব্যক্তি।
বিশ্বস্ত প্রেস থেকে এ নকল সিল তৈরি করে দেওয়া হয় বলে জানা গেছে। এর ফলে অপরাধীরা নিরাপদে ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে।
অন্যদিকে যাদের পাসপোর্ট-ভিসা নেই, তারা কলকাতা ও আশপাশের বিভিন্ন বাসাবাড়ি ও ফ্ল্যাটে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে।
কর্তৃপক্ষ যা বলছে
বেনাপোল ইমিগ্রেশন ঘুরে দেখা যায়, পুলিশ, এনএসআই (জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা) ও ডিজিএফআই (প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর) সদস্যরা সন্দেহভাজন পাসপোর্টধারীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে ভারতে ঢোকার অনুমতি দিচ্ছেন।
তবে সম্প্রতি সরেজমিনে সীমান্ত এলাকায় গিয়ে পুলিশের তেমন টহল চোখে পড়েনি।
গত ২৩ আগস্ট কাস্টমসের একটি বন্ধ গেট খুলে যশোর জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানজিদ নওশাদ পল্লবকে ভারতে পালাতে সহযোগিতা করেন কাস্টমসের সুপার শিবলী নোমান ও কামরুন্নাহার। এ সময় বিজিবির সন্দেহ হলে জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে তাকে আটক করা হয়।
অবৈধভাবে গেট খুলে প্রবেশের ঘটনাটি ধরা পড়ে সিসি ক্যামেরায়। তবে এত বড় ঘটনায় কারও বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
বেনাপোল চেকপোস্ট কাস্টমস হাউসের সুপারিনটেনডেন্ট মোকলেছুর রহমান জানান, ছাত্রলীগ নেতা বন্ধ থাকা গেট দিয়ে কৌশলে ঢুকে পড়েছিলেন।
'কাস্টমসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ বিষয়ে খতিয়ে দেখছেন। এ ঘটনার পর থেকে ওই গেটটি সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে,' তিনি আরও বলেন।
বেনাপোল বিজিবি অধিনায়ক সাইফুল্লা সিদ্দিকী বলেন, অপরাধীরা যাতে ভারতে পালাতে না পারে, সে বিষয়ে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। 'সীমান্ত পথ বা ইমিগ্রেশন ব্যবহার করে কোনো অপরাধী যাতে পালাতে না পারে, সেজন্য বিজিবিকে সতর্ক রাখা হয়েছে।'
দুর্নীতি দমন প্রতিরোধ কমিটি শার্শা উপজেলা শাখার সদস্য রুবেল হোসেন বলেন, 'কাস্টমসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও সীমান্তের প্রভাবশালীরা অপরাধীদের ভারতে পালাতে সহযোগিতা করে বড় অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন। তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।'
সম্পাদনা: সুজন সেন গুপ্ত