‘খোদিত পাষাণ’: উত্তরা লেক নিষ্প্রাণ করা হচ্ছে কংক্রিট দিয়ে
মর্নিং ওয়াকে উত্তরা-৭ নম্বর সেক্টরের পাশের লেকপাড়ের রাস্তা ধরে প্রায়ই হাঁটেন ষাটোর্ধ্ব মো. ইয়ামিন। নিজের চোখের সামনেই উত্তরা এলাকায় জনবসতি গড়ে উঠতে দেখেছেন তিনি। একে একে এ এলাকার সকল জলাধার নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়ে টিকে আছে উত্তরা লেক। তবে সে লেকটিও ভালো নেই।
দখল-দূষণে যেমনটা কমেছে লেকের আয়তন, তেমনি গত ১০ বছর ধরে দেখছেন লেকের কাজ চলছে কিন্তু তা শেষ হচ্ছে না। এখন লেকটির সৌন্দর্যবর্ধনের নামে লেকের তলদেশ থেকে পাড় পর্যন্ত কংক্রিটের ব্লক বসানো হচ্ছে।
ইয়ামিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এ বলেন, 'উত্তরা লেকের ১ম অংশের কাজ শুরু হয় ২০১৪–১৫ সালের দিকে। কিছুদিন কাজ চলে, আবার বন্ধ হয়ে যায়। এখন হ্রদের এক-চতুর্থাংশ দুই বছর ধরে শুকিয়ে গেছে।
'লেকের চারিদিকের পাড়ে বসানো হচ্ছে কংক্রিটের ব্লক। দেখে মনে হচ্ছে যেন কোনো সুইমিং পুলের কাজ চলছে। এভাবে লেকের তলদেশে কংক্রিটের ঢালাই দেওয়া জনগণের টাকার অপচয় ব্যতীত কিছুই না।'
তিনি আরও বলেন, 'এর থেকে এই টাকা দিয়ে লেকটি নিয়মিত পরিচর্যা করলে এবং কিছু বসার স্থান করে দিলে লেকটির সুবিধা নগরবাসী পেত।'
এ আক্ষেপ শুধু মো. ইয়ামিনেরই নয়, স্থানীয় বাসিন্দা ও নগর পরিকল্পনাবিদরা মনে করছেন, লেকের উন্নয়নের নামে পানির নিচে পাকা করা স্রেফ টাকা অপচয়।
উত্তরার এই লেকের রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়নের দায়িত্বে আছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। প্রায় ৯১ কোটি টাকা ব্যয়ে এই লেকের উন্নয়ন কাজ বর্তমানে চলমান।
২০১৪ সালের একনেকে পাশ হওয়া এই প্রকল্পের কাজ কয়েক ধাপে বাড়িয়ে এ বছরের জুন পর্যন্ত করা হয়। সর্বশেষ ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত আবার সময়কাল বাড়ানো হয়েছে প্রকল্পটির।
লাভ ছাড়া খরচ বৃদ্ধি
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সহ-সভাপতি স্থপতি ইকবাল হাবিব প্রকল্পের সমালোচনা করে বলেন, 'কোনো প্রকল্পে এসব অপ্রয়োজনীয় কংক্রিটের কাজ থাকা মানেই প্রকল্পের খরচ বাড়ানো।
'কংক্রিটের ব্লক দিয়ে সাধারণত সাগর ও নদীর পাড় বাঁধানো হয়, যাতে প্রবল স্রোত ও ঢেউয়ে পাড় ভেঙে না যায়। উত্তরা লেকে এমনটা অপ্রয়োজনীয়। তাই কংক্রিটের পাড় বাঁধাই করা মানে সরকারের অর্থের অপচয়।'
এ নগর বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, 'প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রিতা প্রকল্পের খরচ বাড়ায়। আর এভাবে মোটা অঙ্কের অর্থের অনৈতিক সুবিধা পাওয়া যায়। তাই এসব প্রকল্প অনুমোদন দেওয়ার আগে সরকারের এসব বিষয় দেখা উচিত। বছরের পর বছর একটি প্রকল্প ঘুরিয়ে অর্থ অপচয় ব্যতীত কিছুই নয়।'
ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা?
রাজউকের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মো. সিদ্দিকুর রহমান সরকার টিবিএসকে বলেন, 'লেকের আশপাশে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদের কারণে প্রকল্প কিছুটা দীর্ঘ হয়েছে। তবে আমরা আশা করছি ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ হয়ে যাবে।
'আমরা বর্ষার আগেই লেক খনন এবং পাড় বাঁধাই অনেকটাই শেষ করেছি। এখন যেটুকু বাকি আছে তা দ্রুতই শেষ হবে। তাছাড়া লেকের পাড়ে গাছ রোপণ ও ওয়াকওয়ের কাজ বৃষ্টির মৌসুমেও করা যাবে।'
পাড়ে কংক্রিটের ব্লক বসানো নিয়ে রাজউক চেয়ারম্যান বলেন, 'আমরা পরামর্শক কোম্পানির পরামর্শ নিয়েই পানির সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত কংক্রিটের ব্লক বসিয়েছি।
'লেকে পানি ভর্তি থাকলে ব্লকগুলো দেখা যাবে না। পাড় ভেঙে যেতে পারে, তাই বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী আমরা কাজ করেছি। লেকের সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ নিয়ে এলাকাবাসীও খুশি।'
প্রকল্পের অর্ধেক কাজ শেষ
'উত্তরা লেক উন্নয়ন প্রকল্প' নামক এই প্রকল্পটির উন্নয়ন অংশীদার উদয়ন বিল্ডার্স এবং পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ডেটা এক্সপার্ট (প্রাইভেট) লিমিটেড।
প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২.১৫ কিলোমিটারের উত্তরা লেকের ৪টি অংশের মধ্যে ২টির কাজ শেষ হয়েছে এবং এখন ৩ নম্বর লেকের কাজ চলমান আছে।
বাকি দুটি লেকেও খনন করে কংক্রিটের ব্লক বসানো হয়েছে পানির নিচে। এখন ৩ নম্বর লেকটি খনন করে পাড় বাঁধাইসহ ওয়াকওয়ের নির্মাণ করা হচ্ছে।
প্রায় ৬৩.৮৪ একরের লেকের পাড়জুড়ে ৪.১৭ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে নির্মাণ, পাড় বাঁধাই, গাছ রোপণ করে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করা হচ্ছে।
প্রকল্পের প্রকৌশলীরা বলছেন, লেকের এ উন্নয়ন কাজে বড় অংশের খরচই হচ্ছে কংক্রিট দিয়ে লেকের তলদেশ থেকে পাড় বাঁধাইয়ে।
সম্প্রতি উত্তরা লেক এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ৩ নম্বর লেকটির চারপাশে কংক্রিটের ব্লক বসানো প্রায় শেষ পর্যায়ে। তবে কাঁচা মাটির উপর এ কংক্রিটের ব্লকগুলো স্থাপন করায় ২–৩টি স্থানে ইতোমধ্যে ধসে পড়েছে। এর একটি অংশে আবার খুঁড়ে পাইপ মেরামতের কাজ করছিলেন দুইজন শ্রমিক।
এক শ্রমিক বলেন, 'প্লাস্টিকের পাইপ দেওয়ায় তা মাটির চাপে টিকছে না। ফলে পাইপ ফেঁটে যাচ্ছে। সাধারণত মাটির ভেতর দিয়ে এভাবে পাইপ নিতে হলে লোহার পাইপ ব্যবহার করা হয়। এ পাইপ টিকবে কি না জানি না।'
সমাপ্ত হওয়া ১ম ও ২য় লেকের পাড়ে এখনও রয়েছে অবৈধ দখল ও দূষণের নানা চিত্র। ১ম লেকটির একটি অংশ দখল করে আছে দুটি নার্সারি। লেকের মধ্যেই গড়ে উঠেছে এসব নার্সারি। লেক খনন ও পাড় বাঁধাইয়ের কাজ হলেও উচ্ছেদ হয়নি সেগুলো।
তিনটি স্থানে আড়াআড়ি রাস্তার মাধ্যমে এটি ৪টি লেকে বিভক্ত হয়েছে। লেকের সংযোগস্থলের এ তিনটি রাস্তার দুই পাশে লেকের জায়গা দখল করে অন্তত ৩০টি অস্থায়ী দোকান বসছে নিয়মিত।
নার্সারি ও অবৈধ দোকানের কারণে এসব জায়গা থেকে লেক দেখাই যায় না। এছাড়া ১, ২ ও ৪ নম্বর লেকে এখনও দেখা যায় ময়লা আবর্জনার স্তূপ।
একটি নার্সারির এক কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, 'মালিক এ জায়গা ভাড়া নিয়ে নার্সারি দিয়েছেন। গত ৫ বছর ধরে আমি এখানে আছি। এ এলাকায় স্থায়ী-অস্থায়ী অনেক দোকানই বসে লেকের পাড়ে।'
বাসিন্দারা শেষ দেখতে চান
উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের বাসিন্দা উম্মে হাবিবা টিবিএসকে বলেন, 'রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাই কিন্তু দুই পাশে যে লেক আছে, সেটাই জানতাম না। কয়েকদিন আগে বাসে বসে জানালা দিয়ে দেখলাম যে, এখানে লেক আছে।
'এমনিতেই আমরা কংক্রিটের জঞ্জালের মধ্যে বসবাস করছি, তার মধ্যে যেটুকু সুযোগ আছে সেগুলোও দখল দূষণে পরিপূর্ণ।'
উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরের বাসিন্দা ইকবাল বলেন, 'প্রায় ১ বছর ধরে দেখছি ৩ নম্বর লেকটি শুকিয়ে কাজ চলছে। এখন বৃষ্টির মধ্যে অধিকাংশ সময়ই দেখছি কাজ বন্ধ। লেকের উন্নয়ন কাজেই যদি বছরের পর বছর সময় চলে যায়, তবে লেকের সুবিধা পাব কবে?'
লেকটির বর্তমান উন্নয়ন কাজ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কনভে গ্রুপ।
এটির অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার সাইফুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'লেকের কাজে সবচেয়ে বেশি খরচ হয়েছে কাদা-মাটি অপসারণ করে গভীর করতে।
'এখন লেকটির গভীরতা ৩৮ ফুট করা হয়েছে এবং ১৬ ফুট কংক্রিটের ব্লক দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে। লেকের সঙ্গে যত বাসাবাড়ি ও ড্রেনের পাইপলাইন ছিল, তা সব বন্ধ করে দিয়েছি,' বলেন তিনি।
রাজউকের উত্তরা লেক উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (প্রকল্প) মো. মোবারক হোসেন টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের এ লেকটি নিয়ে যে পরিকল্পনা ছিল এবং শুরুতে যে বাজেট ধরা হয়েছিল, সেখান থেকে অনেক কমিয়ে এনে শুধুমাত্র লেক খনন ও পাড় বাঁধাইসহ ওয়াকওয়ের কাজ করতে হচ্ছে।'
'লেকের পাড়ে অবৈধ দখল সরানো ও বস্তি উচ্ছেদ করা ছিল অন্যতম চ্যালেঞ্জ। লেক উন্নয়নের প্রায় ৫০% কাজ শেষ হয়েছে,' তিনি জানান।