৫,৭৯১ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প যেভাবে ভোগাচ্ছে মানুষকে
![](https://tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2024/10/14/highway_pic_2.jpg)
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ নদীবন্দর থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত বিদ্যমান সড়কটি ৪ লেনের জাতীয় মহাসড়কে উন্নীতকরণে ৫,৭৯১ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্প কাজ স্থবির হয়ে পড়েছে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কাজ ফেলে চলে গেছেন ভারতীয় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
এ অবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কটির অন্তত ৪ কিলোমিটার অংশে পিচ উঠে সৃষ্টি হয়েছে ছোট-বড় অসংখ্য গর্ত। ফলে উন্নয়ন প্রকল্পটি এখন মানুষের চরম দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে প্রকল্পের অধীনে থাকায় সড়কটিতে নিয়মিত সংস্কার কাজও করতে পারেনি সড়ক ও জনপথ বিভাগ।
এ মহাসড়ক দিয়েই ব্রাহ্মণবাড়িয়া-ঢাকা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও সিলেট-চট্টগ্রাম-সিলেট রুটের যাত্রীবাহী ও পণ্যবাহী গাড়িগুলো চলাচল করে।
এ অবস্থায় সড়কটি যানবাহন চলাচলের উপযোগী করতে স্থানীয় প্রশাসন সাময়িকভাবে ইট দিয়ে গর্ত ভরাট করার ব্যবস্থা নিয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দিদারুল আলম সম্প্রতি টিবিএসকে বলেন, "আশা করছি, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা শীঘ্রই ফিরে আসবেন, এবং প্রকল্পটি আবারও শুরু হবে। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে একটি চিঠি পাঠিয়েছে, এবং এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।"
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আশুগঞ্জ-আখাউড়া ৪ লেন জাতীয় মহাসড়ক প্রকল্পের ব্যবস্থাপক মো. শামীম আহমেদ বলেন, "ঠিকাদার না থাকায় মহাসড়কের বেহাল অংশ সংস্কার করা যাচ্ছে না। তবে যেহেতু যান চলাচলে সমস্যা হচ্ছে, সেজন্য এটি সংস্কারে আপাতত সরকারের রাজস্ব খাত থেকে অর্থ বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় রয়েছে।"
তিনি আরও বলেন, "ভারতীয় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে এখনও হাইকমিশন থেকে অনাপত্তিপত্র দেওয়া হয়নি। ফলে প্রকল্পের কাজ শুরু করা যাচ্ছে না। যেহেতু কাজ বিলম্বিত হয়েছে, সেজন্য প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হতে পারে।"
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এম ফাওজুল কবির খান গতকাল টিবিএসকে বলেন, "আমরা প্রকল্পটি সম্পর্কে অবগত। আইনশৃঙ্খলার অবনতি নিয়ে উদ্বেগের কারণে ভারতীয় নির্মাণ কোম্পানির কর্মকর্তারা বাংলাদেশ ছেড়েছেন। তবে, আমাদের সাথে তাদের যোগাযোগ আছে এবং আমরা তাদের নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছি। পূজার ছুটিতে এখন তারা ভারতে অবস্থান করছেন; ছুটির পরে প্রকল্পের কাজ শুরু হবে।"
সময়সীমার মধ্যে কাজ শেষ করার সম্ভাবনার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "আমরা এ বিষয়টি পরে দেখবো। আপাতত আমাদের অগ্রাধিকার হলো, ফের কাজ শুরু।"
![](https://tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2024/10/14/highway_pic_1.jpg)
সময়সীমা বেড়েছে ৩ বার, কাজ শেষ হয়েছে ৫৫ শতাংশ
জানা গেছে, স্থলপথে উত্তরপূর্ব ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন এবং আন্তঃদেশীয় বাণিজ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যে আশুগঞ্জ নদীবন্দর থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত প্রায় ৫১ কিলোমিটার সড়ক ৪ লেনের জাতীয় মহাসড়কে উন্নীতকরণে ২০১৭ সালে ৫,৭৯১ কোটি টাকার প্রকল্পটির অনুমোদন দেয় সরকার।
এই প্রকল্পে বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নের পাশাপাশি ভারতের ঋণ সহায়তাও রয়েছে।
দরপত্র আহ্বান ও ভূমি অধিগ্রহণ শেষে প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০২০ সালে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে তিনটি প্যাকেজে। সবকটি প্যাকেজের কাজই দেওয়া হয়েছে ভারতীয় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এফকন্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডকে।
৩ দফায় মেয়াদ বাড়ানোর পর প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৫৫ শতাংশের মতো। তবে এখনও পর্যন্ত তৃতীয় প্যাকেজের কাজ শুরুই করতে পারেনি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি।
এ অবস্থায় গত ৫ আগস্ট থেকে ধাপে ধাপে ভারত চলে যান ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৩০০ কর্মকর্তা-কর্মচারী। এতে বন্ধ হয়ে যায় প্রকল্পের কাজ।
তবে, নির্মাণ কাজ শুরুর পর থেকেই মহাসড়কের এক অংশে যান চলাচল বন্ধ এবং খোঁড়াখুঁড়ির কারণে সরু মহাসড়কে যানজটে পড়ে দুর্ভোগ পোহাতে থাকেন ব্যবহারকারীরা।
এছাড়া, ধুলাবালির কারণে মহাসড়কে চলাচল করাটাই অনেকটা দায় হয়ে পড়ে। মূলত কাজে ধীরগতির কারণে মানুষের দুর্ভোগও বাড়তে থাকে।
মহাসড়কের পার্শ্ববর্তী এলাকার বাসিন্দাদের অনেকেই ধুলার কারণে শ্বাসকষ্টজনিত রোগে ভুগছেন। এরমধ্যে মহাসড়কের সরাইল-বিশ্বরোড়, ঘাটুরা, পুনিয়াউট, রাধিকা ও সুলতানপুরসহ বিভিন্ন এলাকার অন্তত ৪ কিলোমিটার অংশে পিচ উঠে সৃষ্টি হয়েছে ছোট-বড় অসংখ্য গর্ত।
গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়ক হওয়া সত্ত্বেও ভাঙাচোরা অংশ সংস্কারে বিলম্বের কারণে এটি এখন যান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। বৃষ্টির সময় গর্তগুলোতে পানি জমে কার্দমাক্ত হয়ে পড়ে মহাসড়ক। প্রায়ই যানবাহন উল্টে ঘটে দুর্ঘটনা। যানবাহন বিকল হয়ে আর্থিক লোকসানে পড়ছেন পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা। ফলে সড়কটিতে মানুষের দুর্ভোগ চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে।
সবচেয়ে বেশি দূরাবস্থা সদর উপজেলার পুনিয়াউট এবং ঘাটুরা অংশে। এ দুই অংশে যানবাহনে ধীরগতির কারণে প্রতিনিয়ত যানজট লেগে মানুষের কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে।
বিশেষ করে, ঘাটুরা এলাকায় মহাসড়কের পাশে অবস্থিত ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিতে যাওয়া রোগী ও স্বজনদের বেশি দুর্ভোগে পড়তে হয়।
![](https://tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2024/10/14/pix_highway_3.jpg)
সরেজমিন ৪ লেন মহাসড়ক প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, মহাসড়কের বিভিন্ন অংশে সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ অসম্পূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে নির্মাণ সামগ্রী ও দামী যন্ত্রাংশ।
শামীম মিয়া নামে এক যাত্রী জানান, ঘাটুরা এলাকার গ্যাসফিল্ড মোড় থেকে মেডিকেল কলেজ পর্যন্ত অংশটি দেখে বোঝার উপায় নেই এটি একটি জাতীয় মহাসড়ক। এ অংশের কাজ এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। অথচ মাত্র ২ মিনিটের এই পথটুকু পাড়ি দিতে গাড়িতে বসে থাকতে হয় আধা ঘণ্টা থেকে একঘণ্টা।
ঘাটুরা এলাকার আরেক বাসিন্দা জুয়েল মিয়া জানান, সরাইল-বিশ্বরোড থেকে রামরাইল পর্যন্ত অংশের কাজ শুরুর পর থেকেই স্থানীয়দের দুর্ভোগ শুরু।
"ধুলা উড়ে পুরো সড়ক সাদা হয়ে যেতো। মনে হতো কুয়াশা পড়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেই ধুলার কারণে এখন শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। ঢিমেতালে কাজ করার কারণে এই উন্নয়ন প্রকল্প সবাইকে চরম ভোগান্তিতে ফেলেছে," জানান তিনি।
সেলিম মিয়া নামে একজন সিএনজি-চালিত অটোরিকশাচালক বলেন, "মহাসড়কের ভাঙাচোরা অংশে প্রায়ই গাড়ি বিকল হয়ে পড়ে। যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। তাছাড়া, যানজটের কারণে সময়ও লাগে বেশি। এজন্য যাত্রীদের কাছ থেকে নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি ভাড়া নিয়ে ক্ষতি পোষাতে হয়।"
সড়ক ও জনপথ বিভাগ জানিয়েছে, কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের সরাইল-বিশ্বরোড মোড় থেকে আখাউড়ার ধরখার পর্যন্ত অংশ ৪ লেন জাতীয় মহাসড়ক প্রকল্পের আওতায় পড়েছে। ফলে এ অংশে সড়ক ও জনপথ বিভাগের নিয়মিত সংস্কার কাজ করা যায়নি। মূলত প্রকল্পের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানেরই আওতাভুক্ত সড়ক রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব।
এদিকে, ভারতীয় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কবে নাগাদ বাংলাদেশে এসে প্রকল্পের কাজ শুরু করবেন— সেটি এখনও নিশ্চিত নন সংশ্লিষ্টরা।