আম্পানের মতো একই পথে আঘাত হানতে পারে ঘূর্ণিঝড় ‘ডানা’
এক সপ্তাহের মধ্যে পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন উত্তর আন্দামান সাগরে আরেকটি লঘুচাপ সৃষ্টি হয়েছে। লঘুচাপটি ২৩-২৪ অক্টোবরের মধ্যে ঘূর্ণিঝড় 'ডানা'য় পরিণত হবে। এই ঘূর্ণিঝড় উড়িষ্যা, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় প্রভাব ফেলবে।
আবহাওয়াবিদ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ঘূর্ণিঝড় ডানা বাংলাদেশের খুলনা ও বরিশাল বিভাগের উপকূলীয় অংশে প্রভাব ফেলবে। এটি আগের ঘূর্ণিঝড় আম্পানের মতো একই পথে আঘাত হানতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
২০২০ সালের ২০ মে ঘূর্ণিঝড় আম্পান বিধ্বংসী শক্তি নিয়ে সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানে। ঘূর্ণিঝড়টির সর্বোচ্চ গতি ছিল ঘণ্টায় ২০৪ কিলোমিটার।
আম্পানে খুলনা অঞ্চলে ৮ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছিল। সে সময় দুর্যোগের কারণে নদীর বাঁধ ভেঙে যায়, যার ফলে অনেকে গৃহহীন ও বেকার হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর (বিএমডি) জানিয়েছে, লঘুচাপটি তীব্র হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ভারতীয় আবহাওয়া বিভাগ (আইএমডি) বলেছে, ১৯ অক্টোবর আন্দামান সাগরের কেন্দ্রে একটি চক্রাকার ঘূর্ণাবর্ত তৈরি হয়। ২০ অক্টোবর সকালে এটি উত্তর আন্দামান সাগরের দিকে চলে যায় এবং একই এলাকায় অবস্থান করে। এর প্রভাবে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগর এবং উত্তর আন্দামান সাগরসংলগ্ন এলাকায় একটি লঘুচাপ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
আইএমডি আরও জানিয়েছে, এটি পশ্চিম-উত্তরপশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে ২২ অক্টোবর সকালে লঘুচাপ ও ২৩ অক্টোবরের মধ্যে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হবে। এরপর এটি উত্তরপশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে ২৪ অক্টোবর সকালে উড়িষ্যা ও পশ্চিমবঙ্গ উপকূলের কাছে উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগরে পৌঁছাবে।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. বজলু রশীদ টিবিএসকে বলেন, 'লঘুচাপটি ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এবং এর গতিপথ বলছে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আঘাত হানার সম্ভাবনা রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে আঘাত হানলে বাংলাদেশের খুলনার দিকে আঘাত হানারও সম্ভাবনা রয়েছে। ২৫ তারিখের দিকে উপকূলে আঘাতের সম্ভাবনা রয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'লঘুচাপটি ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হতে সময় কম পাচ্ছে। তাই এর গতিবেগ খুব বেশি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। খুব বেশি শক্তিশালী হবে না ঘূর্ণিঝড়টি।'
কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক আবহাওয়াবিদ মোস্তফা কামাল পলাশ টিবিএসকে বলেন, 'লঘুচাপটি মঙ্গলবার নিম্নচাপ, বুধবার দুপুরের মধ্যে গভীর নিম্নচাপ ও একই দিনে সন্ধ্যার মধ্যে পূর্ণাঙ্গ ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হওয়ার প্রবল আশঙ্কা করা যাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হওয়ার পরে এর নাম হবে ডানা। এই নামটি মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারের দেওয়া। ইউরোপীয় ইউনিয়নের আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেল থেকে প্রাপ্ত সর্বশেষ পূর্বাভাস অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড় ডানা সৃষ্টির আশঙ্কা ৯০ থেকে ১০০ শতাংশ।'
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও কানাডার আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেল বিশ্লেষণ করে পলাশ বলেন, 'ঘূর্ণিঝড় ডানা আগামী ২৩ অক্টোবর রাত ১২টার পর থেকে ২৪ অক্টোবর সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের খুলনা বিভাগের ওপর দিয়ে সরাসরি তীব্র ঘূর্ণিঝড় বা সিভিয়ার সাইক্লোনিক স্টর্ম (৮৯–১১৭ কিমি/ঘণ্টা) হিসাবে স্থলভাগে আঘাত করার প্রবল আশঙ্কা করা যাচ্ছে।'
'ঘূর্ণিঝড় আম্পান যে পথে স্থলভাগে আঘাত করে অগ্রসর হয়েছিল, এই ঘূর্ণিঝড়টিও প্রায় একই পথে অগ্রসর হওয়ার আশঙ্কা করা যাচ্ছে। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের মেদিনিপুর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলা এবং বাংলাদেশের সাতক্ষীরা ও খুলনা জেলার উপকূলে আঘাত করার আশঙ্কা করা যাচ্ছে,' যোগ করেন তিনি।
এই আবহাওয়াবিদ বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট জেলায় স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ৭-৮ ফুট বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলায় স্বাভাবিকের চেয়ে ৫-৬ ফুট বেশি উচ্চতার পানি হতে পারে। ঘূর্ণিঝড়ের সময় উপকূলের জেলাগুলোতে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক ১৩৩ বছরের অক্টোবরের তথ্য বিশ্লেষণ করে বলেন, ১৮৯১ সাল থেকে বঙ্গোপসাগরে মোট ৫১টি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়েছে, যার মধ্যে ৪৩টি অত্যন্ত শক্তিশালী হিসেবে ক্যাটাগরিভুক্ত। এর মধ্যে ১১টি তীব্র ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হেনেছে, যা অক্টোবরকে এ অঞ্চলের ঘূর্ণিঝড়ের জন্য ঐতিহাসিকভাবে সক্রিয় মাসে পরিণত করেছে।
সবচেয়ে ভয়ংকরগুলোর একটি ছিল ১৯৬০ সালের ৩১ অক্টোবরের ঘূর্ণিঝড়। এ ঘূর্ণিঝড়ে ৫ লাখেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারায়। সাম্প্রতিককালে ২০২২ সালের ২৫ অক্টোবর ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং বাংলাদেশে আঘাত হানে, যার ফলে ১০ ঘরবাড়ি ও ৬ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়।