শ্রমিক বিক্ষোভে ৪৯ ঘণ্টা ধরে বন্ধ ময়মনসিংহ মহাসড়ক, সাধারণ মানুষের ভোগান্তি চরমে
বকেয়া বেতনের দাবিতে তৃতীয় দিনের মতো টানা ৪৯ ঘণ্টা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন টিএনজেড গ্রুপের শ্রমিকরা। অবরোধের কারণে মহাসড়কে দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়েছে। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন ঢাকা, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় যাতায়াতকারীরা যাত্রীরা। পাশাপাশি ক্ষুব্ধ চালক, এলাকাবাসী ও সাধারণ মানুষ। যাত্রীরা গন্তব্যে যাচ্ছেন পায়ে হেঁটে।
গাজীপুর মহানগরীর মালেকের বাড়ি এলাকায় টিএনজেড গ্রুপের শ্রমিকরা গত শনিবার সকাল ৯টায় মহাসড়ক অবরোধ করেন। আজ সোমবার (১১ নম্ভেম্বর) সকাল ১০ টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত সড়ক অবরোধ অব্যাহত রেখেছেন। টিএনজেডের শ্রমিকদের আন্দোলনের কারনে আশপাশের ১৫-২০টি কারখানা সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে।
বিক্ষোভরত শ্রমিকরা বলছেন, বকেয়া পাওনা না পেলে তারা রাস্তা ছাড়বেন না। রাস্তা ছাড়ার বিষয়ে তাদের কেউ অনুরোধ করতে গেলেই বলছেন, 'তাহলে আপনি টাকা দেন, আমরা রাস্তা ছেড়ে দেই।'
এ সময় চোখে রাতে না ঘুমানোর ছাপ নিয়ে এক যুবক এগিয়ে এসে বলেন, 'আমরা কষ্ট করেছি, কাজ করেছি। আমাদেরকে টাকা দিচ্ছে না। আমরা আমাদের পাওনা চাচ্ছি আমাদের পাওনা দিয়ে দেন, আমরা বাড়ি চলে যাব।'
অবরোধের কারণে দুর্ভোগে পড়েছেন যাত্রীরা। বাচ্চা কোলে নিয়ে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ্যাঁর দিকে যাচ্ছিলেন কলিম উদ্দিন। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'দেশের গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়ক আজ তিন দিন ধরে বন্ধ। অথচ কর্তৃপক্ষ নির্বিকার। এটা কোনোভাবেই মানা যায় না। মানুষ চলাচল করতে পারছে না। দূরপাল্লার কোনো গাড়ি চলছে না।'
কলিম উদ্দিনের কথার সত্যতা রয়েছে। টানা অবরোধের ফলে কার্যত অচল হয়ে গেছে গাজীপুর। মানুষ যানবাহন নিয়ে রাতে বিভিন্ন বিকল্প পথে চলাচল শুরু করায় মহাসড়কের যানজট এখন অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে মহাসড়কের যানজট আস্তে আস্তে কমতে শুরু করেছে। অবরোধের বিষয়টি জানার পর অধিকাংশ যাত্রী ও যানবাহন এ সড়ক এড়িয়ে চলছে।
সোমবার সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, গাজীপুর মহানগরীর মালিকের বাড়ি এলাকায় কলম্বিয়া গার্মেন্টসের সামনে ২০০ মিটার ব্যবধানে ব্যারিকেড দিয়ে যান চলাচল আটকে দেওয়া হয়েছে। মাঝখানে কয়েকশো শ্রমিক ও কিছু যুবককে লাঠি হাতে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। তারা বেতন ছাড়া আর কোনো ব্যাপারে কথা বলতে রাজি হননি।
এ সময় সেখানে দায়িত্বরত শিল্প পুলিশের পুলিশ সুপার সারোয়ার আলম ও গাজীপুর মহানগর পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (অপরাধ-উত্তর) নাজির আহমেদকে কথা বলতেও বাধা দিচ্ছেন তারা। শ্রমিকদের দাবি, 'যা বলার, মাইকে বলেন।'
ময়মনসিংহ থেকে চাঁদপুরগামী ট্রাকচালক হায়দার বলেন, 'দুদিন ধরে সড়কে আটকে আছি। কোথাও যেতে পারছি না, নড়তেও পারছি না। অনেক ট্রাকে পচনশীল পণ্য রয়েছে। যাত্রীবাহী বাস থেকে যাত্রীরা নেমে গেছে দুদিন আগে; কিন্তু বাস আগের স্থানেই রয়েছে।'
পুলিশ ও শ্রমিকদের সূত্রে জানা গেছে, মহানগরীর মালেকের বাড়ি এলাকায় অবস্থিত টিএনজেড অ্যাপারেলস লিমিটেড কারখানার শ্রমিকদের গত দুই মাসের বেতন বকেয়া আছে। শ্রমিকেরা দুই মাস ধরেই বেতন দাবি করলেও কর্তৃপক্ষ কালক্ষেপণ করছে। ২৮ অক্টোবর শ্রমিকেরা আন্দোলন করলে শিল্প পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা শ্রমিকদের বুঝিয়ে শান্ত করেন। তখন পুলিশ জানায়, নভেম্বরের ৩ তারিখ বেতন পরিশোধ করা হবে। কিন্তু সেদিন শ্রমিকদের বেতন না দিয়ে কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর ৭ নভেম্বর আবার শ্রমিকেরা বিক্ষোভ করলে শিল্প পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা এ বিষয়ে সমাধান করার আশ্বাস দিলে তারা ফিরে যান। ৭ তারিখ চলে গেলেও শ্রমিকেরা বেতন পাচ্ছেন না। তাছাড়া কারখানা বেশ কিছুদিন ধরে বন্ধ আছে। এসব কারণে শনিবার সকাল থেকে আবারও মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন শ্রমিকেরা।
শ্রমিক নেতা ও অভ্যুত্থানকারী ছাত্র শ্রমিক জনতার সংগঠক আরমান হোসাইন বলেন, 'আমরা শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের ধৈর্য ধরতে বলেছি। তারা বলেছেন, দুই মাস ধৈর্য ধরেছি, আর না। আমাদের কথা হচ্ছে, মহাসড়ক অবরোধ রাখায় যে ভোগান্তি হচ্ছে, এটি দ্রুত সমাধান করা। আশুলিয়া আর গাজীপুর মিলে ৮-১০ টা কারখানায় মূলত ঝামেলা দেখছি। তাদের পাওনাও খুব বেশি না। প্রয়োজনে ওইসব মালিকের কিছু সম্পদ বিক্রি করে হলেও পাওনা পরিশোধ করুক। আজ আমরা আবারও শ্রমিকদের সঙ্গে বসব।'
গাজীপুর মহানগর পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (অপরাধ-উত্তর) নাজির আহমেদ বলেন, 'শ্রমিকদের বোঝানো হয়েছে, কিন্তু তারা কোনো কথাই শুনছেন না। তারা বেতন না নিয়ে মহাসড়ক ছাড়বেন না। তাদেরকে আজও বুঝানো হচ্ছে।'
গাজীপুর শিল্প পুলিশের পুলিশ সুপার সারোয়ার আলম বলেন, 'শ্রমিকদের দাবি ন্যায্য। মালিকপক্ষ একাধিকবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও তারা রক্ষা করতে পারেনি। তাই শ্রমিকরা গত দুটি রাত রাস্তায় বসে আছে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমি যতদূর জানি, মালিকপক্ষও টাকা সংগ্রহের চেষ্টা করছে।' এ সময় তিনি শ্রমিকদের উদ্দেশে বলেন, 'যদি তোমরা পারো, মানুষের কষ্টের কথা চিন্তা করে রাস্তা ছেড়ে দাও।' জবাবে উপস্থিত শ্রমিকরা বলেন, 'আমাদের টাকা না দিলে আমরা রাস্তা ছাড়ব না।'
এদিকে গাজীপুর মহানগরীর কোনাবাড়ীতে এক মাসের বকেয়া বেতনের দাবিতে আঞ্চলিক সড়ক অবরোধ করে রেখেছেন থানাধীন স্বাধীন গার্মেন্টসের শ্রমিকরা। আজ সকাল ৮টা থেকে কারখানাটির শ্রমিকরা পল্লীবিদ্যুৎ দশতলা আঞ্চলিক সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন।
পুলিশ জানায়, অক্টোবর মাসের বেতন এ মাসের ১০ তারিখে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষ ১০ তারিখে বেতন দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে শ্রমিকরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। গতকাল দুপুরে পর তারা কাজ বন্ধ করে দেয়। আজ সকাল ৮টার সময় এসে কাজে যোগ না দিয়ে পল্লীবিদ্যুৎ সড়ক অবরোধ করে রাখেন তারা। কর্তৃপক্ষ বলছে, ১৪ নভেম্বরের আগে বেতন দেওয়া সম্ভব হবে না। কিন্তু শ্রমিকরা কেউ এ কথা শুনছেন না।
শ্রমিকরা বলেন, প্রতি মাসের ১০ তারিখে বেতন দেওয়ার কথা থাকলেও কর্তৃপক্ষ বেতনের সময় হলে টালবাহানা শুরু করে। বেতন না দিলে কাজে যোগ দেবেন না বলে জানান তারা।
এ বিষয়ে জানতে স্বাধীন গার্মেন্টসের প্রশাসনিক কর্মকর্তা রাজু আহমেকে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
গাজীপুর মহানগর পুলিশের কোনাবাড়ী থানার অফিসার ইনচার্জ মো. নজরুল ইসলাম জানান, বকেয়া বেতনের দাবিতে স্বাধীন গার্মেন্টসের শ্রমিকরা রাস্তা অবরোধ করেছেন। শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে যান চলাচল স্বাভাবিক করার চেষ্টা করা হচ্ছে।