র্যাব পরিচয়ে তুলে নেওয়ার ১৬ মাস পর ভারত থেকে ফিরলেন যুবক
এক মধ্যরাতে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) পরিচয়ে তুলে নেওয়ার প্রায় ১৬ মাস পর পরিবারের কাছে ফিরেছেন ঢাকার ধামরাইয়ের গাঙ্গুটিয়া ইউনিয়নের বড়নালাই গ্রামের যুবক মো. রহমত উল্লাহ (২১)।
গত রোববার (২২ ডিসেম্বর) দুপুরের দিকে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ধামরাইয়ের নিজ বাড়িতে ফেরেন তিনি।
এর আগে, ২০২৩ সালের ২৯ আগস্ট রাত ১২টার দিকে জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলে র্যাব পরিচয়ে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় রহমত উল্লাহকে। এরপর থেকেই নিখোঁজ ছিলেন তিনি। তাকে যখন তুলে নিয়ে যাওয়া হয় তখন বিদেশে যাওয়ার জন্য বড় ভাইয়ের পরামর্শে ইলেকট্রিশিয়ানের কাজ শিখছিলেন তিনি।
রহমত উল্লাহর পরিবারের সদস্যরা জানান, র্যাব পরিচয়ে তুলে নেওয়ার পর থেকেই নিখোঁজ ছিলেন রহমত উল্লাহ। দীর্ঘদিন নিখোঁজ থাকার পর, গত অক্টোবর হঠাৎ একদিন ভারতের দমদম জেল থেকে গোপনে বড় ভাই মো. ওবায়দুল্লাহর ফোনে একটি ভয়েস মেসেজ পাঠান রহমত। ভয়েস মেসেজের কণ্ঠ শুনেই বড় ভাই রহমতকে চিনতে পারেন। এরপর বড় ভাইকে নিজের অবস্থানের কথা জানান। কিন্তু কয়েকদিন পরই রহমতের সঙ্গে আবার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় পরিবারের। অনেক চেষ্টা করেও আর তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি তারা।
রহমত উল্লাহর বড় ভাই ওবায়দুল্লাহ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে (টিবিএস)- বলেন, 'গত অক্টোবরে বিদেশে থাকাকালীন হঠাৎ একদিন আমার ইমো নম্বরে একটি ভয়েস মেসেজ আসে। ভয়েস মেসেজের কণ্ঠ শুনেই বুঝতে পারি এটা রহমতের গলা। এরপর ওর সঙ্গে যোগাযোগ হয়। তখনই তার সর্বশেষ অবস্থানের কথা জানতে পারি। এরপর ওই মাসেই দেশে ফিরে আসি। কিন্তু কয়েকদিন পরই আবার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় রহমতের সঙ্গে। যেই নম্বরে যোগাযোগ হতো, অনেক চেষ্টা করেও সেই নম্বরে আর যোগাযোগ করতে পারিনি। চেষ্টা করেছিলাম ভারতে যাওয়ার, কিন্তু ভিসা না পাওয়ায় সেটি আর সম্ভব হয়নি।'
এদিকে দীর্ঘদিন পর রহমতকে ফিরে পেয়ে তার পরিবার যেমন খুশি, তেমনি তার নিরাপত্তা নিয়েও শঙ্কিত।
পরিবারের সদস্যরা জানান, রহমত বাড়ি ফেরার পর ধামরাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মনিরুল ইসলাম তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।
রহমত উল্লাহর মা মমতাজ বেগম গণমাধ্যমকে বলেন, 'রহমতকে যখন ধরে নিয়ে যায়, তখন অসুস্থ ছিলেন। সেই অবস্থাতেই তাকে জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু এরপর র্যাব অফিস, ডিবি অফিসসহ বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরেও রহমতের কোনো খবর পাইনি। সেই থেকে নিখোঁজ ছিল সে।'
তিনি আরও বলেন, 'ছেলেরে আমি ফিরে পাইছি, আমি শান্তি পাইছি। আল্লায় আমার ছেলেরে আমার বুকে আনছে।'
যেভাবে পরিবারের কাছে ফিরেছেন রহমত
রহমতের পরিবারের সদস্যরা জানান, শনিবার (২১ ডিসেম্বর) দুপুরে একটি অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন পান রহমত উল্লাহর বড় ভাই মো. ওবায়দুল্লাহ।
ফোনের অপর প্রান্ত থেকে এক ব্যক্তি নিজেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর থানার রহনপুর পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. ফজলে বারী পরিচয় দিয়ে রহমত উল্লাহকে পাওয়ার কথা জানান। এরপর রহমতের পরিবারের চার সদস্য চাঁপাইনবাবগঞ্জে যান।
রহমত উল্লাহর বড় ভাই মো. ওবায়দুল্লাহ বলেন, 'এসআই মো. ফজলে বারীর কল পেয়ে আমরা চাঁপাইনবাবগঞ্জে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে রহমত উল্লাহকে নিয়ে বাসায় আসি।'
কেমন আছেন রহমত উল্লাহ
রহমত উল্লাহর পরিবারের সদস্যরা জানান, দীর্ঘদিন পর পরিবারের কাছে ফিরলেও খুব বেশি কথা বলছেন না তিনি। এছাড়া একেক সময় একেক রকম কথা বলছেন। তবে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে তার সঙ্গে কী ঘটেছিল, সে বিষয়ে তিনি কোনো কথা বলছেন না।
রহমত উল্লাহর এমন আচরণে বেশ চিন্তিত তার পরিবার। দু-এক দিনের মধ্যেই তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথাও ভাবছেন তারা।
পুলিশ যা বলছে
পুলিশ জানিয়েছে, গত শুক্রবার রাতে বিএসএফ সদস্যরা চাঁপাইনবাবগঞ্জের কোনো একটি সীমান্ত দিয়ে রহমত উল্লাহকে ভারত থেকে বাংলাদেশে পুশব্যাক করার পর, তিনি পায়ে হেঁটে গোমস্তাপুর থানায় পৌঁছান। সীমান্ত থেকে থানার দূরত্ব প্রায় ১৪-১৫ কিলোমিটার।
রহমতের বক্তব্য উদ্ধৃত করে চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর থানা পুলিশ জানায়, 'রহমত তাদের জানিয়েছেন যে র্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে ৯ মাস তিনি ঢাকায় দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে ছিলেন।হেফাজতে থাকাকালীন ওই ৯ মাসে তার চোখ, হাত ও পা বাঁধা অবস্থায় আটকে রাখা হতো। রহমত জানান, যে স্থানে তিনি ছিলেন, সেখান থেকে আশেপাশে বিমান ওঠানামার শব্দ শুনতে পেতেন। শুধু খাওয়ার সময় তার চোখ খোলা রাখা হতো এবং খাওয়া শেষ হলে আবার চোখ বাঁধা হতো।'
'৯ মাস পর গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা একটি হায়েস গাড়িতে করে তাকে যশোরের বেনাপোল সীমান্তে নিয়ে যান। সীমান্ত পার করে তাকে ভারতের সীমানায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। ভারতে ঢোকার পর দুই-তিন দিন ঘোরাঘুরি করার সময় ভারতের পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে।'
রহমত পুলিশকে আরও জানান, 'অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে ভারতে তাকে একটি জেলে রাখা হয়। সেখানে তার ৬ মাসের কারাদণ্ড এবং ১ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ২ মাসের জেল হয়। ৭ মাস জেল খাটার পর, সর্বশেষ তাকে দমদম জেলখানা থেকে গাড়িতে করে সীমান্তে আনা হয় এবং গত শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে তাকে বাংলাদেশে পুশব্যাক করা হয়।'
সাজা শেষে বিভিন্ন ব্যক্তিকে যেভাবে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে বাংলাদেশে পুশব্যাক করা হচ্ছে
রহমত উল্লাহর বরাত দিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর থানার রহনপুর পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ফজলে বারী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে (টিবিএস)- বলেন, 'রহমত আমাদের জানিয়েছে, ভারতে বাংলাদেশের সীমান্তঘেঁষা যেসব জেলখানা আছে, সেসব জেলখানায় যাদের সাজার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়, তাদের নিয়ে এসে দমদম জেলখানায় জমা করা হয়। এরপর সপ্তাহে একদিন তাদের দমদম জেলখানা থেকে গাড়িতে করে বর্ডারে নিয়ে এসে বিএসএফের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বিএসএফ সুবিধামতো সময়ে তাদের বাংলাদেশ বর্ডারে ঢুকিয়ে দেয়। রহমত উল্লাহকেও একইভাবে বিএসএফ রাতে একটি নৌকায় করে বাংলাদেশে পুশব্যাক করেছে বলে তিনি আমাদের জানিয়েছেন।'
পুলিশের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, 'প্রথমে রহমত উল্লাহ সন্দেহ করছিলেন যে পুলিশ তাকে মেরে ফেলতে পারে। তবে পরে কিছুটা স্বাভাবিক হলে তার কাছ থেকে পরিবারের তথ্য নিয়ে ধামরাই থানা-পুলিশের সহযোগিতায় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। পরে পরিবারের সদস্যরা থানায় পৌঁছালে নিশ্চিত হতে শনাক্তকরণ মহড়া হিসেবে ভিন্ন ভিন্ন পাঁচজন লোককে তার সামনে রেখে ভাইকে শনাক্ত করতে বলা হয়। তিনি তখন তার ভাইকে শনাক্ত করেন।'
মো. ফজলে বারী বলেন, 'তাকে (রহমত উল্লাহকে) জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমাকে ধরল কেন? সে উত্তরে বলেছিল, তারা (র্যাব) বলেছে আমি নাকি জঙ্গি। তখন সিডিএমএস (সফটওয়্যার ক্রাইম ডেটাবেজ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম) সার্চ করে তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা পাইনি।'
এ বিষয়ে ধামরাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মনিরুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে (টিবিএস)- বলেন, 'আমি নিজে রহমত উল্লাহর বাড়িতে গিয়ে তার ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়েছি। পাশাপাশি পুলিশের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতার প্রয়োজন হলে তাকে সব ধরনের সহযোগিতা করারও আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। একইসাথে তারা যদি মনে করে কোনো অভিযোগ দেবে, আমরা সেটিও গ্রহণ করব।'