এইচএমপিভির প্রাদুর্ভাব: আতঙ্কিত নয়, সতর্ক হওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের
কোভিড-১৯ মহামারির পর নতুন বছরের শুরুতে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস (এইচএমপিভি)। কোভিডের মতো এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে চীনে। চীনের পর মালয়শিয়া এবং এরপর ভারতেও এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে।
তবে এইচএমপিভি যেহেতু নতুন ভাইরাস নয়, তাই এতে আতঙ্কিত না হয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন ভাইরোলজিস্ট ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞরা।
ভাইরোলজিস্টরা জানিয়েছে, এইচএমপিভি ভাইরাসের উপস্থিতি অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশেসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রয়েছে। শীতকালে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হতে দেখা যায়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডাঃ মইনুল আহসান বলেন, "এইচএমপিভি কোনো নতুন ভাইরাস না। ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো এই ভাইরাস। বাংলাদেশে আগেও এ ভাইরাসে আক্রান্ত কেস পাওয়া গেছে। এটি মৃদু ধরনের ভাইরাস, এটি নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই, সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে।"
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের শীতকালীন রোগ মোকাবেলায় হাসপাতালগুলোর যে প্রস্তুতি আছে, তা রাখলেই এটি মোকাবেলা করা সম্ভব বলে জানান তিনি।
এইচএমপিভি কী?
হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস (এইচএমপিভি) মূলত শ্বাসযন্ত্রের ভাইরাস। এতে আক্রান্ত হলে শরীরে ফ্লু বা সর্দি-সদৃশ উপসর্গ যেমন— কাশি, সর্দি, গলা ব্যথা এবং জ্বর দেখা দেয়। ভাইরাসটি মৃদু প্রকৃতির হলেও এটি শিশু, বয়স্ক মানুষ এবং যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পরে; সৃষ্টি করতে পরে ব্রঙ্কাইটিস বা নিউমোনিয়ার মতো গুরুতর জটিলতা।
এটি রেসপাইরেটরি সিনসিটিয়াল ভাইরাস (আরএসভি)- এর পরিবারভুক্ত। ২০০১ সাল এটি প্রথম নেদারল্যান্ডে শনাক্ত হয়। শীতকালে এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বেশি।
এইচএমপিভি-তে আক্রান্ত হলে এর প্রভাব সাধারণত কয়েক দিন থেকে এক সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। তবে গুরুতর ক্ষেত্রে এটি আরও বেশি সময় স্থায়ী হতে পারে।
কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?
ইন্সটিটিউট অফ এপিডেমিওলজি, ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চের (আইইডিসিআর) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এইচএমপিভি নতুন ভাইরাস নয়। এটি ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো এবং বাংলাদেশে এর আগেও এইচএমপিভি সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে।"
তিনি বলেন, "এটি মৃদু ভাইরাস এবং এতে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। প্রাথমিক স্বাস্থ্য নির্দেশিকা অনুসরণ করলেই হবে। শীতকালীন রোগের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে থাকা হাসপাতালগুলোর প্রস্তুতিই এই ভাইরাস মোকাবেলায় যথেষ্ট।"
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান ডাঃ আরিফা আকরাম বলেন, "এইচএমপিভি কোনো মরণব্যাধি নয়। তবে শিশু ও বয়স্ক রোগীদের সতর্ক থাকতে হবে। এ ভাইরাস নিয়ে কোভিডের মত আতঙ্কিত না হয়ে সতর্ক হতে হবে।"
এখন পর্যন্ত এই ভাইরাসের কোনো ভ্যাকসিন তৈরি হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, "কোভিডের সময় আমরা যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেছি, সেগুলো মেনে চললেই এটি মোকাবেলা সম্ভব।"
বর্তমান প্রস্তুতি
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডাঃ মইনুল আহসান বলেন, "এইচএমপিভি ভাইরাস শনাক্ত করার সক্ষমতা আইইডিসিআর এর রয়েছে। কোভিডের মত আরটিপিসিআর টেস্ট করে এ ভাইরাস শনাক্ত করা যায়। আমাদের পর্যাপ্ত আরটিপিসিআর মেশিন আছে। এ টেস্টের জন্য শুধু আলাদা কিট প্রয়োজন। প্রয়োজন হলে কিট আমদানি করা হবে।"
চীনে এখনও কোনো জরুরি অবস্থা জারি হয়নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও কোনো সতর্কতা জারি করেনি জানিয়ে তিনি বলেন, "বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোনো সতর্কতা জারি করলে আমরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবো।"
"বাড়তি সতর্কতা হিসেবে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে স্ক্রিনিংয়ে জোর দিতে বলা হয়েছে। আর দেশের সব সরকারি হাসপাতালকে শীতকালীন রোগের প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় নেবুলাইজার সলুশন, অ্যান্টিবায়োটিক, অক্সিজেনসহ প্রয়োজনীয় ওষুধ পর্যাপ্ত পরিমাণে সরবরাহ নিশ্চিত করাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপে নিতে বলা হয়েছে," যোগ করেন তিনি।
প্রতিরোধ ও যত্ন
এইচএমপিভি মোকাবেলায় ডাঃ আরিফা আকরাম বলেন, "নিয়ম মেনে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, অপরিষ্কার হাতে নাক-মুখ স্পর্শ না করা, আক্রান্ত ব্যক্তিদের থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা এবং মাস্ক ব্যবহার করলে এই ভাইরাস থেকে নিরাপদে থাকা সম্ভব।"
প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এমএইচ চৌধুরী লেলিন টিবিএসকে বলেন, এইচএমপিভি নিয়ে মানুষকে সতর্ক করতে হবে যাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে।
তিনি বলেন– শিশু, ৬৫ বছরের বেশি বয়সী মানুষ ও ক্যান্সার, কিডনিসহ জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীদের সাবধানে রাখতে হবে। বেশি অসুস্থ হলে হাসপাতালে যেতে হবে।
এ রোগে আক্রান্তদের সিমটোমেটিক ট্রিটমেন্ট দিতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, "জ্বর হলে জ্বরের বা ঠান্ডা কাশি যেটার লক্ষণ দেখা দেবে, সেটার চিকিৎসা দিতে হবে।"
সাধারণ শীতকালীন রোগ মোকাবেলায় হাসপাতালেরে যে প্রস্ততি থাকে, এ রোগের চিকিৎসায়ও তেমন প্রস্তুতি রাখতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।