স্বল্প মজুরি, আবাসন সংকট: নানান সমস্যায় জর্জরিত বরগুনার শুঁটকি পল্লীর ভবিষ্যৎ
যতদূর চোখ যায় শুঁটকির মাঠ। বিশেষ কায়দায় মাছ শুকানোর জন্য তৈরি চাতালে কর্মব্যস্ত শ্রমিকরা।
এইসব চাতালে নারী ও তুলনামূলক কম বয়সীদের কদর বেশি। কারণ তাদের পারিশ্রমিক বয়স্ক পুরুষের চেয়ে কম। তেমনি এক কিশোর হাসান পাটিতে স্তূপাকৃত মাছ পরিস্কার করছিলেন। কথাবার্তা এগিয়ে নেওয়ার পরই কষ্টের কথা জানাই সে।
হাসান বলে, "আড়াই মাস হয়েছে কাজ শুরু করেছি। এখন পল্লীতে মাছ খুবই কম আসছে। মাছ কম, কাজও কম। এজন্য আড়াই মাস কাজ করেও এক টাকাও মাইনে পাইনি।"
শুটকি বিক্রি শুরু না হওয়া পর্যন্ত টাকা পাওয়া যাবে না বলেও জানায় সে।
শ্রমিক হাসান শুঁটকির মৌসুমে এখানে কাজ করলেও বর্ষায় মাছ ধরার ট্রলারে সাগরে যায়। তার সাথে কথা হয় বরগুনার তালতলী উপজেলার পায়রা নদী তীরের ফকিরহাট সংলগ্ন শুঁটকি পল্লীতে।
এই শুঁটকি পল্লীটি দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে অন্যতম শুঁটকি উৎপাদনের স্থান। কয়েক যুগ ধরে এখানে শুকনো মৌসুমে অস্থায়ীভাবে গড়ে তোলা হয় শুঁটকি তৈরির ফিল্ড। ফকিরহাটের পাশাপাশি আশারচর, সোনাকাটা, জয়ালভাঙ্গা, মরানিদ্রায় ৬৫ জন শুটকি ফিল্ডের মহাজন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এনেছেন।
১২ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের উপায়
নদী তীরের খাস জমিতে গড়ে ওঠা এসব ফিল্ড মিলে এক-একটি পল্লী গড়ে ওঠে। অন্যান্য সময়ে ভিন্ন পেশায় যুক্ত থাকলেও অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে শুরু হয় ফিল্ড তৈরির কাজ।
আশারচরের শুঁটকি ব্যবসায়ী বেল্লাল হোসেন জানান, "নভেম্বরের শুরুতেই পল্লীতে কাজ আরম্ভ হয়। ওই সময়ে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ৩/৪ হাজার পরীযায়ী শ্রমিক আমাদের এলাকায় চলে আসেন। এসব শ্রমিকদের পাশাপাশি জেলে, আড়ৎদার, মহাজন, পরিবহন শ্রমিক মিলিয়ে ১২ থেকে ১৫ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয় উপজেলার শুঁটকি পল্লীগুলোতে।"
জামালপুর থেকে আসা শ্রমিক মনির হোসেন বলেন, "অনেকে পুরো পরিবার নিয়ে এসে চরে খুপড়ি ঘর করে থাকেন, আর শুঁটকি ফিল্ডে কাজ করেন। আমি একাই এসেছি। এখানে কয়েকজন মিলে একটি ছাপড়া ঘর বানিয়ে থাকি।"
"আমাদের মজুরি দরকষাকষি করে ঠিক করা হয়। শুকনা মৌসুম এলেই এখান থেকে (তালতলী) মহাজনরা মোবাইল করে জানায় তার কতজন শ্রমিক দরকার। আমরা সেভাবে মিলমিশ করে চলে আসি। সাধারণত নারী আর কিশোর— মানে যারা তুলনামূলক কম পরিশ্রম করতে পারে— দিনে ৩০০ টাকা, আর পুরুষ শ্রমিকরা ৫০০ টাকা মজুরি পান," যোগ করেন তিনি।
তালতলীর শুঁটকির চাহিদা দেশের বাইরেও
"দেশের অন্যান্য অঞ্চলে শুঁটকি দীর্ঘদিন ভালো রাখতে ওষুধ ব্যবহার করে। কিন্তু বরিশাল বিভাগের কয়েকটি শুঁটকি পল্লীতে যেমন— তালতলী, পাথরঘাটা আর পটুয়াখালী জেলার কুয়াকাটার পল্লীতে আমার কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। এসব শুঁটকিতে এক ফোঁটা ওষুধও দেওয়া হয় না," বলছিলেন ফকিরহাটের শুঁটকি পল্লীর শ্রমিক কামাল হোসেন।
তিনি আরও বলেন, "দেশের মধ্যে দক্ষিণাঞ্চলেই বিষমুক্ত শুঁটকি উৎপাদন হয়। এজন্য এই অঞ্চলের শুঁটকির চাহিদা এবং স্বাদ অন্য অঞ্চলের শুঁটকির চেয়ে ভালো। শুঁটকি হয়ে গেলে প্যাকেট করে আমরাই তো গাড়িতে তুলে দেই। তখন জেনেছি চট্টগ্রাম, ঢাকা, খুলনা, সৈয়দপুর, জামালপুর, মুন্সীগঞ্জে সরাসরি নেওয়া হয় শুঁটকি। আর বরিশাল বিভাগের সবস্থানে তো যায়ই।"
তালতলী উপজেলা মৎস কর্মকর্তা ভিক্টর বাইন বলেন, "তালতলীর শুঁটকি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বড় একটি খাত। এখানে 'ভূলা চিংড়ি' অর্থাৎ ছোট চিংড়ির শুঁটকি বেশি হয়। এসব শুঁটকি একদিনেই খাবার উপযোগী হয়। এছাড়া বড় মাছের শুঁটকি হতে একটু সময় নেয়। তালতলীতে উৎপাদিত শুঁটকি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানি হয়। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কাতার, বাহরাইন ও দুবাইতে চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে।"
শুঁটকি ব্যবসায়ী আমির হোসেন জানান, "আমরা এখান থেকে চট্টগ্রামের বড় ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করি। তারা সেখান থেকে বিদেশে রপ্তানি করেন। আগে হিমায়িত চিংড়ির রপ্তানি বেশি হতো বিধায় এদিকে চাহিদাও বেশি ছিল। এখন শুঁটকির চাহিদা বহুগুণে বেড়েছে।"
চারমাসে একলাখ মণ শুঁটকি উৎপাদন
তালতলীর শুঁটকি পল্লীগুলোতে নভেম্বর থেকে কর্মব্যস্ততা বেড়ে মার্চ মাসের শেষ পর্যন্ত অর্থাৎ চারমাস চালু থাকে। এই সময়ে এক একটি ফিল্ড থেকে প্রতি সপ্তাহে দেড়শ থেকে দুইশ মণ শুঁটকি উৎপাদিত হয়। স্থানীয়রা বলছে, আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে প্রতি সপ্তাহে দেড়শ মণ এক ফিল্ড থেকে উৎপাদন হলে চারমাসে একলাখ থেকে একলাখ ২০ হাজার মণ শুঁটকি উৎপাদন সম্ভব। কিন্তু তা প্রতি বছর হয় না।"
শুঁটকি ব্যবসায়ী দুলাল হাওলাদার বলেন, "আমি ৩০ বছর ধরে তালতলীতে শুঁটকির ব্যবসা করি। এখানে শুঁটকি উৎপাদনের বিরাট সম্ভাবনা আছে। অর্থনৈতিক সঞ্চালনায় তালতলীর শুঁটকি পল্লী গুরুত্বপূর্ণ হলেও অনেক প্রতিবন্ধকতা আমাদের মোকাবেলা করতে হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আমরা অনেক সময়ে লোকসানে থাকি।"
"তাছাড়া, তালতলী উপজেলা সদর থেকে দূরে পায়রা নদীর তীরে পল্লী গড়ে ওঠায় এদিকে যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারে নাজুক। অনেক সময়ে মালামাল পরিবহনের ট্রাক অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে আনতে হয়," বলেন তিনি।
নানান সমস্যায় শ্রমিকরা
শুঁটকি মৌসুম শুরু হলে পল্লীগুলো জমজমাট হলেও কাজের সন্ধানে আসা এখানকার শ্রমিকরা বিভিন্ন ধরণের সমস্যার মুখোমুখি হন। এরমধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে থাকার ঘর, সুপেয় পানি ও স্বস্থ্যসম্মত স্যানিটেশনের ব্যবস্থা না থাকা।
শুঁটকি পল্লীতে প্রায় ২৫ বছর ধরে কাজ করেন পিয়ারা বেগম।
তিনি বলেন, "নারী-পুরুষ এখানে সমানভাবে কাজ করলেও নারীদের জন্য কোনো টয়লেটের ব্যবস্থা নেই। পুরুষরা তাদের প্রয়োজনে যে কোনো যায়গায় যেতে পারে, কিন্ত আমরা নারীরা তা পারিনা। খাবার পানির জন্য যদি টিউবওয়েল বসানো থাকতো তাহলে আমাদের এত কষ্ট করতে হতো না।"
শহিদুল ইসলাম বলেন, "শুঁটকি পল্লীতে কাজ শুরু হলে আমরা নারী-পুরুষ মিলে অসংখ্য শ্রমিক একত্রে কাজ করি। আমাদের কেউ যদি অসুস্থ হয় রাস্তাঘাট খারাপ থাকায় দ্রুত তাকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়া সম্ভব হয়না। কাছাকাছি দোকন থেকে ওষুধ আনতে গেলেও প্রায় ২০০ টাকা ভাড়া দিয়ে যেতে হয়।"
শুঁটকির বাজারদর কেমন
তালতলীতে প্রায় ২৫ প্রজাতির মাছ দিয়ে শুঁটকি প্রস্তুত করা হয়। এরমধ্যে অন্যতম রূপচাঁদা, ছুরি, কোরাল, সুরমা, লইট্টা, পোপা, ভূলা ইত্যাদি। স্থানীয় বাজারে প্রতিকেজি ছুরি মাছের শুঁটকি ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা, রূপচাঁদা ১ হাজার, লইট্টা ৯০০ থেকে ১০০০, চিংড়ি ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা এবং অন্যান্য ছোট মাছের শুঁটকি ৩০০ থেকে ৫৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
যা বলছে সংশ্লিষ্ট দপ্তর
তালতলী উপজেলার শুঁটকি পল্লীগুলোর সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে কথা হয় তালতলী উপজেলা নির্বাহী অফিসার উম্মে সালমার সাথে।
তিনি বলেন, "বর্তমানে তালতলী থেকে যে পরিমাণ শুঁটকি সরবরাহ হয়, আমরা চাই আরও বেশি পরিমাণ শুঁটকি এখান থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ হোক।"
তিনি বলেন, "শুঁটকি পল্লীতে আমি গিয়েছি এবং সেখানে কর্মরত নারীদের ফ্রি মেডিকেল সেবার ব্যবস্থা করেছি। এছাড়াও কথা বলে শুঁটকি পল্লীতে যারা কাজ করেন তাদের বিভিন্ন সমস্যার বিষয়ে জেনেছি। তাদের সুবিধার্থে শুঁটকি পল্লীতে পাবলিক টয়লেট নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ এবং সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের মাধ্যমে টিউবওয়েল স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। এছাড়া, যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করতে গ্রামীণ অবকাঠামো অথবা এলজিইডির মাধ্যমে উদ্যোগ নেওয়া হবে।"
বরগুনা জেলা মৎস কর্মকর্তা মো. মহসিন জানান, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সারাদেশ থেকে শুঁটকি রপ্তানি হয়েছে ৩ হাজার ৩৮ টন— যার মধ্যে সাধারণ শুঁটকি ২ হাজার ৯৬২ টন এবং লবণাক্ত শুঁটকি সাড়ে ৭৬ টন। এসব শুঁটকির রপ্তানি মূল্য ছিল ৭৬ কোটি ৫৬ লাখ ৩১ হাজার ৫০৩ টাকা।
বরগুনার তালতলীতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণের শুটকি উৎপাদন হয়। এরমাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসছে। তালতলী উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে এসব পল্লী হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না। তাছাড়া, প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধাও গড়ে ওঠেনি।
"আমি চেষ্টা করবো সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সাথে কথা বলে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলে অবকাঠামোগত উন্নয়নের চেষ্টা," যোগ করেন তিনি।