সড়কে মৃত্যুর অন্যতম কারণ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে
বাংলাদেশের সড়কে মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। বিভিন্ন তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বলা যায়, এই দুর্ঘটনার প্রবণতা ক্রমশ বাড়ছে।
গত দশকে দেশে মোটরসাইকেলের সংখ্যা বেড়েছে। আর সেই সঙ্গে দুর্ঘটনায় মৃত্যুহারও বেড়েছে।
গতকাল (৪ জানুয়ারি) বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির (বিজেকেএস) প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালে ২ হাজার ৩২৯টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে মারা গেছেন ২ হাজার ৫৭০ জন এবং আহত হয়েছেন ৩ হাজার ১৫১ জন।
গত বছরের মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৩৬.৬ শতাংশ ছিল মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মোটরসাইকেল এবং ছোট যানবাহনের অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি এবং নিয়ম ভঙ্গই দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ।
আগের বছরের তথ্যও এই প্রবণতাকে সমর্থন করে। বিজেকেএস এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৩২.৪ শতাংশ ছিল মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। সে বছর মোট ২ হাজার ৩১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ২ হাজার ১৫২ জন।
২০২২ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই) থেকে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দেশে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার অনেক বেশি।
গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি ১০ হাজার মোটরসাইকেলে বছরে ২৮.৪ জন মারা যায়। এর মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ ভুক্তভোগীর বয়স ২৪ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে।
এআরআই-এর সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. শিফুন নেওয়াজ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "বাংলাদেশে অর্ধেকের বেশি যানবাহন হলো মোটরসাইকেল। এ কারণে অন্যান্য যানবাহনের তুলনায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার সংখ্যা বেশি।"
তিনি জানান, বেশিরভাগ চালকের লাইসেন্স নেই এবং তারা ট্রাফিক নিয়ম মানে না। অনেকেই অতিরিক্ত গতিতে মোটরসাইকেল চালায় এবং অতিরিক্ত যাত্রী বহন করে।
এই বিশেষজ্ঞ মোটরসাইকেলের সংখ্যা কমানো, কেনার জন্য নির্দেশিকা চালু করা এবং নতুন ক্রেতাদের জন্য লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ করেন।
প্রতিটি মোটরসাইকেলে দুটি হেলমেট বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব দিয়েছেন অধ্যাপক কাজী মো. শিফুন। এতে দুর্ঘটনা কিছুটা কমবে বলে জানান তিনি।
বিশ্বে মোটরসাইকেল ব্যবহারে শীর্ষে থাকা ভিয়েতনামে প্রতি ১ হাজার জনে ৩৫৮টি মোটরসাইকেল রয়েছে। সেখানে প্রতি ১০ হাজার মোটরসাইকেলে মৃত্যুর হার মাত্র ৪.১। অন্যদিকে, বাংলাদেশে প্রতি ১ হাজার জনে মাত্র ৭টি মোটরসাইকেল থাকলেও মৃত্যুর হার অনেক বেশি।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন (আরএসএফ) মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। তাদের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে ২ হাজার ৯৭৩টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ৯১ জন মারা গেছেন। এটি সড়ক দুর্ঘটনায় মোট মৃত্যুর ৪০.০৭ শতাংশ। ২০২১ সালে ২ হাজার ৭৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ২ হাজার ২১৪ জন মারা যায়, যা সড়ক দুর্ঘটনায় মোট মৃত্যুর ৩৫.২৩ শতাংশ।
আরএসএফ জানিয়েছে, ২০২০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ৫০.৪৭ শতাংশ এবং মৃত্যুহারে ৫১.৩৩ শতাংশ বেড়েছে।
গত দশকে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা চার থেকে পাঁচগুণ বেড়েছে। এর মধ্যে মোটরসাইকেল ও ইজিবাইকের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। এই সমস্যার সমাধান এখন অত্যন্ত জরুরি।
ফিডার রোডে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে
যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে ফিডার রোড বা সংযোগ সড়কে, যা মোট দুর্ঘটনার ৩৫.৮১ শতাংশ। ফিডার রোডগুলো বড় সড়ক, রেলপথ বা মহাসড়কের সাথে যুক্ত করতে নির্মিত হয় এবং সেগুলোর মাধ্যমে ট্রাফিক চলাচল করে।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির সেক্রেটারি জেনারেল মো. মজাম্মেল হক চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "দেশে মোটরসাইকেল এবং অটোরিকশার সংখ্যা বেড়েছে, যার কারণে ফিডার রোডগুলোর ওপর চাপ বাড়ছে।"
তিনি আরও বলেন, "বাইকচালকরা ট্রাফিক জ্যাম এড়াতে ফিডার রোড ব্যবহার করে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছাতে চায়। কিন্তু অটোরিকশা এবং রিকশার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ট্রাফিকের গতি কমে যায়, যা দুর্ঘটনা বাড়াচ্ছে।"
তবে তিনি উল্লেখ করেন, ফিডার রোডে দুর্ঘটনার সংখ্যা বেশি হলেও, ক্ষতি এবং প্রাণহানি তুলনামূলকভাবে কম।
বুয়েটের শিফুন নেওয়াজ বলেন, সরকার ফিডার রোড নির্মাণে মহাসড়কের তুলনায় কম নজরদারি করে। এসব কারণে ডিজাইন এবং নির্মাণ ত্রুটি থাকতে পারে। এছাড়া, এসব রোডে বেশি পথচারী থাকায় সেটি দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়ায়।
তিনি বলেন, "অনেক ফিডার রোডে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা নেই এবং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ভালো নয়। এসব রোডে অনেক বাইক ও বাস চলাচল করে। ফলে, দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।"