জর্ডানের পোশাকখাতে শ্রম নিয়োগ বৃদ্ধিতে রেকর্ড মুনাফা অর্জন করেছে বোয়েসেল
শ্রমশক্তি রপ্তানি থেকে গত বছর রেকর্ড মুনাফা অর্জন করেছে রাষ্ট্র মালিকানাধীন জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেড (বোয়েসেল)।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ জর্ডানের তৈরি পোশাকখাতে শ্রমশক্তি রপ্তানি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় এ মুনাফা অর্জন সম্ভব হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। ২০১১ সাল থেকেই জর্ডান রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বোয়েসেলের শীর্ষ বাজার।
গত সপ্তাহে প্রকাশিত প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, আলোচ্য সময়ে বোয়েসেলের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজার, দক্ষিণ কোরিয়ায় শ্রম নিয়োগের পরিমাণ ৫০ শতাংশ কমেছে। এরপরেও রেকর্ড মুনাফা অর্জন করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
২০২৪ অর্থবছরে বোয়েসেলের আয় ১৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৭৮.৮৭ কোটি টাকায় পৌঁছেছে; এ সময় মুনাফার পরিমাণ ১২.৭ শতাংশ বেড়ে ৪৮.৬৫ কোটি টাকা হয়েছে।
যদিও এ সময়ে বোয়েসেলের মাধ্যমে বিদেশে পাড়ি জমানোদের সংখ্যা প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে। আগের বছর প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে ১৫,২৯৪ জন কর্মী বিদেশে গিয়েছিলেন, আর ২০২৪ অর্থবছরে গিয়েছেন ১৫,৫৫৮ জন।
গত অর্থবছরে, বোয়েসেল ১১,৫০২ জন সেমি-স্কিল্ড বা স্বল্পদক্ষ পোশাক শ্রমিক জর্ডানে পাঠিয়েছে— যা আগের বছরের তুলনায় ৯৩ শতাংশ বেশি।
জর্ডানের পোশাক কারখানাগুলোতে আকর্ষণীয় বেতনে হাজার হাজার দক্ষ শ্রমিক নিয়োগ পাচ্ছে। বর্তমানে, দেশটির ৪২টি পোশাক কোম্পানি বোয়েসেলের মাধ্যমে ৩০,০০০-৩৫,০০০ টাকা মাসিক বেতনে শ্রমিক নিয়োগ দিচ্ছে।
এমনকি, ফ্লাইটসহ অন্যান্য খরচও নিয়োগকারী কোম্পানিই বহন করছে।
এদিকে, ২০২৪ অর্থবছরে দক্ষিণ কোরিয়ায় ৩,০১৯ জন কর্মী নিয়োগ করেছে বোয়েসেল; এর আগের বছর করেছিল ৬,৭৪৯ জন।
দক্ষিণ কোরিয়া যেতে ইচ্ছুক প্রত্যেক শ্রমিককে বোয়েসেলকে ৩৪,০০০ টাকা করে সার্ভিস চার্জ দিতে হয়েছে।
অন্যদিকে, নারী কর্মী জর্ডানে পাঠাতে জনপ্রতি মাত্র ২০০ ডলার করে চার্জ নিয়েছে বোয়েসেল; বাকি খরচ বহন করেছে নিয়োগকর্তা কোম্পানি।
দক্ষিণ কোরিয়ার শ্রমশক্তি রপ্তানি কেন কমেছে?
নিয়োগকর্তাদের কাছ থেকে চাহিদা কমে যাওয়ায় ২০২৪ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় বরাদ্দ পাওয়া চাকরির কোটার প্রায় তিন-চতুর্থাংশই পূরণে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ। আলোচ্য বছরে দক্ষিণ কোরিয়ায় বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য ১১,৫০০ চাকরির কোটা বরাদ্দ থাকলেও, ডিসেম্বর পর্যন্ত যেতে পেরেছেন মাত্র ৩,০৩৮ জন।
বোয়েসেল কর্মকর্তারা বলছেন, বার বার চাকরি পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশি কর্মীদের ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার নিয়োগকর্তাদের। এছাড়া, বাংলাদেশে কোরিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে প্রচারের ঘাটতি, ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা এবং সাংস্কৃতিক ভিন্নতাও নিয়োগ কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ।
২০২৩ সালে দক্ষিণ কোরিয়া বাংলাদেশিদের জন্য ১০,০০০ কোটা বরাদ্দ দিয়েছিল। এর বিপরীতে, সে বছরও মাত্র ৪,৯৯৬ জন যেতে পেরেছিল দেশটিতে।
কোরিয়া বিভিন্ন খাতে সেমি-দক্ষ থেকে দক্ষ বিদেশি কর্মী নিয়োগ করে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে দক্ষ কর্মীর অভাব থাকায় চাকরির জন্য বরাদ্দকৃত কোটা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
এছাড়া, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কোরিয়ার রপ্তানিমুখী শিল্পে চাহিদা কমে গেছে; এটিও এই ঘাটতিতে অবদান রেখেছে।
কোরিয়াগামী কর্মীদের একটি রোস্টার বা তালিকা মেইনন্টেন করে বোয়েসেল— যেখান থেকে নিয়োগকর্তারা তাদের চাহিদা ও পছন্দমতো প্রার্থী বাছাই করেন। প্রক্রিয়াটির সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা টিবিএসকে জানান, প্রয়োজনীয় সংখ্যক কর্মী তালিকায় থাকা সত্ত্বেও নিয়োগকর্তারা কম চাহিদার কথা জানাচ্ছেন।
বোয়েসেলের সদ্য সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মল্লিক আনোয়ার হোসেন টিবিএসকে জানান, গত বছরে বরাদ্দকৃত চাকরির কোটার চেয়ে কম চাহিদা পেয়েছেন তারা। এছাড়া, বাংলাদেশের কর্মীরা ভাষাগত দিক থেকে, বিশেষ করে কথোপকথনের ক্ষেত্রে সাবলীলতায় অন্যদের তুলনায় অনেক পিছিয়ে। তারা ভাষার দক্ষতা পরীক্ষায় ভাল নম্বর পেলেও, কথা বলার সময় সাবলীলতা হারিয়ে ফেলেন।
আনোয়ার হোসেন বলেন, "শ্রমিকরা সাধারণত প্রশিক্ষণের পর ভাষা চর্চা করেন না। আমরা বেসরকারি ভাষা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোকে এ বিষয়ে কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করার পরামর্শ দেব।"
বেসকারি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোকে আর উন্নত করার লক্ষ্যে জানুয়ারিতেই নির্দেশনা দেওয়ার কথা ভাবছে বোয়েসেল। প্রাথমিকভাবে 'এমপ্লয়মেন্ট পারমিট সিস্টেম' এর আওতায় দক্ষিণ কোরিয়ায় আধা বা স্বল্পদক্ষ কর্মী পাঠিয়ে থাকে বাংলাদেশ।
বোয়েসেলের ভূমিকা কম
বৈদেশিক কর্মসংস্থানের জন্য কম টাকা নিলেও, প্রতিষ্ঠার পর থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কর্মী বিদেশে পাঠাতে পারেনি বোয়েসেল।
১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাষ্ট্র পরিচালিত সংস্থাটি মাত্র ১.৬১ লাখ শ্রমিককে বিদেশে পাঠিয়েছে— যেখানে একই সময়ে বেসরকারি সংস্থাগুলো পাঠিয়েছে প্রায় ১.৬ কোটি।
বোয়েসেলের মহাব্যবস্থাপক এবিএম আব্দুল হালিম বলেন, সংস্থাটি দক্ষ ও সেমি-দক্ষ কর্মী নিয়োগে প্রাধান্য দেয় বেশি। অন্যদিকে, বেসরকারি সংস্থাগুলো মধ্যপ্রাচ্যে মূলত কম দক্ষ কর্মী পাঠিয়ে থাকে।
তিনি বলেন, "দুই হাজারের বেশি বেসরকারি সংস্থা মিলে যদি এক মিলিয়ন কর্মী বিদেশে পাঠায়, সেখানে বোয়েসেলের অবদানকে ছোট করে দেখার কিছু নেই। আমরা ক্রমাগত আমাদের পরিধি বাড়িয়ে বিদেশে আরও বেশি কর্মী পাঠানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।"
কম খরচে সুশৃঙ্খল, নিরাপদ ও পদ্ধতিগতভাবে কর্মী পাঠানোর মাধ্যমে বিদেশ গমনেচ্ছুদের যে আস্থা বোয়েসেল অর্জন করেছে, তার প্রশংসা করেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞ এবং স্টেকহোল্ডাররা। একইসঙ্গে, তারা রাষ্ট্রমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানটির কিছু সীমাবদ্ধতার কথাও উল্লেখ করেন। অকার্যকর মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতাসহ নানান কারণে বোয়েসেলের মাধ্যমে নতুন কাজের সুযোগ অনুসন্ধান বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে মত তাদের।
অন্যদিকে, বেসরকারি নিয়োগকারী সংস্থাগুলোকে প্রায়ই মধ্যস্বত্বভোগী মারফৎ অবৈধ ভিসা ব্যবসায়ের মাধ্যমে বিদেশে কর্মী পাঠাতে দেখা যায়। যে কারণে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে বিদেশে কর্মী নিয়োগের সংখ্যা অনেক বেশি।
এর বিপরীতে, বোয়েসেল সম্পূর্ণ নিয়মনীতি মেনে অভিবাসন প্রতিক্রিয়া পরিচালনা করে।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, বোয়েসেলকে আরও সক্রিয় করার প্রচেষ্টা চলছে। আর এটি বাস্তবায়ন হলে, বেসরকারি সংস্থাগুলো তাদের চার্জ কমাতে বাধ্য হবে।