‘মিথ্যা প্রোপাগান্ডা’ ছড়ানো থিংকট্যাঙ্কের সঙ্গে যুক্ত টিউলিপের ভাইবোন: দ্য টাইমস
সম্পত্তি-সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে যুক্তরাজ্যের দুর্নীতি দমন মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিকের (৪২) বিরুদ্ধে তদন্তের দাবি ক্রমেই বাড়ছে। বিনামূল্যে পাওয়া একটি ফ্ল্যাট নিয়ে মিথ্যাচারের পর থেকেই চাপে রয়েছেন তিনি। এর মধ্যেই জানা গেছে, টিউলিপের ভাই ও বোন এমন একটি রাজনৈতিক থিংকট্যাঙ্কের সঙ্গে যুক্ত, যাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রোপাগান্ডা চালানোর অভিযোগ উঠেছে।
বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃত্বে থাকা শেখ হাসিনা সম্পর্কে টিউলিপের খালা। হাসিনার বোন শেখ রেহানা তার মা। গত বছরের আগস্টে রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন হাসিনা।
যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির এমপি টিউলিপ সিদ্দিক সেন্ট্রাল লন্ডনের কিংস ক্রসে একটি ৭ লাখ পাউন্ড মূল্যের ফ্ল্যাটের মালিক। শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ এক সহযোগী টিউলিপকে এ ফ্ল্যাট উপহার দিয়েছেন।
এছাড়াও টিউলিপ তার বোন আজমিনার (৩৪) মালিকানাধীন ৬.৫ লাখ পাউন্ড দামের আরেকটি ফ্ল্যাটে বসবাস করেছেন। ওই ফ্ল্যাটও তাদের খালার এক উপদেষ্টার কাছ থেকে পাওয়া।
উত্তর লন্ডনে তাদের মা ১৪ লাখ পাউন্ডের যে পারিবারিক বাড়িতে বাস করেন, তার মালিক বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ একটি শিল্পগোষ্ঠীর একজন কর্মকর্তা। ওই কর্মকর্তার বাবা হাসিনা সরকারের মন্ত্রী ছিলেন।
টিউলিপ সিদ্দিক গত বছরের জুলাইয়ে সিটি মিনিস্টার হিসেবে নিয়োগ পান। তার দায়িত্ব আর্থিক বাজারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। তবে লেবার নেতা কিয়ার স্টার্মার জানিয়েছেন, এখনও টিউল্পের ওপর তার আস্থা রয়েছে।
কিংস ক্রসের ফ্ল্যাট নিয়ে তথ্য প্রকাশের পর টিউলিপের একজন মুখপাত্র বলেন, 'টিউলিপ সিদ্দিকের এই সম্পত্তি বা অন্য কোনো সম্পত্তির মালিকানা আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থনের বিনিময়ে দেওয়া হয়েছে—এমন ধারণা সম্পূর্ণ ভুল।'
সিদ্দিকের ভাই রাদওয়ান (৪৪) এবং বোন আজমিনা দুজনেই কিংস ক্রসের ফ্ল্যাটে বসবাস করেছেন বলে রেকর্ডে দেখা গেছে। তারা সিদ্দিকের হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড হাইগেটের এমপি নির্বাচনের প্রচারণায় অংশ নেন। যুক্তরাজ্যভিত্তিক আওয়ামী লীগের সহযোগীরাও এসব প্রচারণায় উপস্থিত ছিলেন।
টিউলিপের ভাইবোন দুজনেই বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ পরিচালিত থিংকট্যাঙ্ক—সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন-এর (সিআরআই) ট্রাস্টি ছিলেন বলে জানা গেছে। রাদওয়ান একইসঙ্গে সিআরআইয়ের ম্যাগাজিন 'হোয়াইটবোর্ড'-এর সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন।
ফেসবুকের মূল কোম্পানি মেটা গত বছর জানিয়েছিল, তারা একটি ভুয়া অ্যাকাউন্টের নেটওয়ার্ক চিহ্নিত করেছে, যারা সংবাদ ও সাম্প্রতিক ঘটনাবলি নিয়ে নানা ধরনের পোস্ট করে। বিশেষ করে নির্বাচন এবং আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে পোস্ট করত এসব অ্যাকাউন্ট। ইউটিউব, এক্স, টিকটক ও টেলিগ্রামেও সক্রিয় ছিল এসব অ্যাকাউন্ট।
মেটার 'সমন্বিত প্রতারণামূলক আচরণ' নীতিমালা লঙ্ঘন করার জন্য ৫০টি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। মেটার প্রতিবেদনে বলা হয়, 'যদিও সংশ্লিষ্টরা তাদের পরিচয় এবং নিজেদের মধ্যে সমন্বয় থাকার বিষয়টি লুকানোর চেষ্টা করেছিলেন, তবে আমাদের তদন্তে আওয়ামী লীগসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের মধ্যে সংযোগ থাকার প্রমাণ মিলেছে।'
তবে লন্ডন স্কুল অভ ইকোনমিকসের স্নাতক রাদওয়ান কিংবা আগে টনি ব্লেয়ার ইনস্টিটিউট ফর গ্লোবাল চেঞ্জ-এ কর্মরত আজমিনার বিরুদ্ধে কোনো অনিয়মের অভিযোগ আনা হয়নি।
এদিকে টিউলিপ সিদ্দিক বর্তমানে উত্তর লন্ডনের ফিঞ্চলে-তে ১২ লাখ পাউন্ড মূল্যের একটি বাড়িতে ভাড়া নিয়েছেন। এ বাড়ির মালিক যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সদস্য আবদুল করিম নাজিম। পাশাপাশি টিউলিপ ও তার স্বামী ক্রিশ্চিয়ান পার্সি (৪০) উত্তর লন্ডনের ক্রিকলউডে ৯ লাখ পাউন্ড মূল্যের একটি ফ্ল্যাটের মালিক।
বাংলাদেশের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে ৩.৯ বিলিয়ন পাউন্ড আত্মসাতের অভিযোগে তদন্তের মুখে থাকা টিউলিপ সিদ্দিকের ওপর সম্পত্তি-সংক্রান্ত এই বিতর্ক নতুন করে চাপ সৃষ্টি করছে।
বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) জানিয়েছে, তরা টিউলিপ সিদ্দিক, তার মা শেখ রেহানা (৬৯), শেখ হাসিনা এবং আরও দুই আত্মীয়ের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে।
২০১১ সালে হাসিনার জাতিসংঘ সফরে অফিশিয়াল প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন টিউলিপ। ২০১৩ সালে মস্কোতে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে টিউলিপকে তার খালা শেখ হাসিনা ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। তিনি এমপি নির্বাচিত হওয়ার দুই বছর আগের ঘটনা এটি।
টিউলিপ অবশ্য কোনো অনিয়মের জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। সমর্থকরা দাবি করেছেন, এই অভিযোগগুলো তিউলিপের খালার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের ষড়যন্ত্র। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর হাসিনার বিরুদ্ধে 'গণহত্যা, হত্যাকাণ্ড এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের' অভিযোগে মামলা হয়েছে।
এদিকে প্রথমে লেবার পার্টির সূত্র জানিয়েছিল, কিংস ক্রসের ফ্ল্যাটটি টিউলিপের বাবা-মা কিনেছিলেন। কিন্তু গত সপ্তাহে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০০৪ সালে টিউলিপকে ফ্ল্যাটটি উপহার দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আবাসন ব্যবসায়ী আব্দুল মোতালিফ।
লেবার পার্টির অভ্যন্তরীণ একটি সূত্র ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেছে, টিউলিপের বাবা-মা তাদের এক পরিচিতজনকে বিপদের সময় সহায়তা করেছিলেন। পরে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ ওই ব্যক্তি তার মালিকানাধীন একটি সম্পত্তি টিউলিপের মালিকানায় হস্তান্তর করেন।
ফ্ল্যাটটি আগে আইনজীবী মঈন গণির দখলে ছিল, যিনি পরে শেখ হাসিনার সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। সানডে টাইমস জানিয়েছে, গণি ওয়েস্ট হ্যাম্পস্টেডে মঈন গণি আরেকটি ফ্ল্যাট টিউলিপের বোন আজমিনার নামে হস্তান্তর করেন। তখন আজমিনার বয়স ছিল ১৮ বছর। পরে আজমিনা বিনামূল্যে এই ফ্ল্যাটটি টিউলিপকে ব্যবহার করতে দেন। ২০২১ সালে ওই ফ্ল্যাট ৬.৫ লাখ পাউন্ডে বিক্রি করা হয়।
সিদ্দিকের বোন ও মা অল্প কিছুদিন হ্যাম্পস্টেডের একটি ফ্ল্যাটে বসবাস করেছেন বলে রেকর্ড থেকে জানা গেছে। ওই ফ্ল্যাটটি আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সদস্য কাজী জাফরউল্লাহর মালিকানাধীন ছিল। জাফরউল্লাহ ২০০৭ সালে বাংলাদেশে চাঁদাবাজির অভিযোগে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত হন, যদিও পরে মুক্তি পান। হাসিনা ক্ষমতা হারানোর পর তাকে ফের গ্রেপ্তার করা হয়।
কনজারভেটিভ এমপি বব ব্ল্যাকম্যান বলেছেন, 'সম্পত্তি-সংক্রান্ত এই লেনদেন নিয়ে টিউলিপ সিদ্দিককে অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে এবং প্রথমে যা বলা হয়েছিল, তার কারণ ব্যাখ্যা করতে হবে। তা না হলে তার মন্ত্রী থাকা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।'