ফিরে দেখা ২০২১: আবারও ব্যর্থ সড়ক আন্দোলন?
বাসে হাফ পাস (অর্ধেক ভাড়া) ও সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবিতে ২১ নভেম্বর থেকে রাজধানীতে শুরু হয় শিক্ষার্থীদের সড়ক আন্দোলন; চলে প্রায় এক মাস ধরে। রাজধানী ঢাকার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন অংশে সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করে শিক্ষার্থীরা।
ঘটনার সূত্রপাত হয় ২০ নভেম্বর। বাসে অর্ধেক ভাড়া দিতে চাওয়ায় বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের এক ছাত্রীকে ধর্ষণের হুমকি দেয় ওই বাসের হেল্পার। ঐ ছাত্রী তার সহপাঠীদের এ বিষয়ে জানালে ২১ নভেম্বর সকাল থেকেই বিক্ষোভ শুরু করে কলেজের ছাত্রীরা। এসময় কয়েকটি বাসে 'হাফ পাস চলবে' লিখে দেয় শিক্ষার্থীরা।
সম্প্রতি ডিজেলের দাম বাড়ায় বাংলাদেশ সরকার। এরপর থেকেই পরিবহন শ্রমিকদের দাবি রক্ষায় বাস ভাড়া কিলোমিটার প্রতি ১ টাকা ৭০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২ টাকা ১৫ পয়সা করা হয়। ভাড়া বাড়ানোর পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হাফপাস নেওয়াও বন্ধ করে দেয় বাসগুলো।
বদরুন্নেসা কলেজের ছাত্রীরা মূলত হাফপাসের দাবিতে বিক্ষোভ করলেও বাসে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়েও স্লোগান দিতে দেখা যায়। 'নিরাপত্তা কোথায়?' লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে দেখা যায় অনেককে।
এ ঘটনার ৩ দিন পরই, ২৪ নভেম্বর সিটি কর্পোরেশনের ময়লাবাহী গাড়ির ধাক্কায় নিহত হয় রাজধানীর নটরডেম কলেজের এক ছাত্র। মানবিক বিভাগের ছাত্র নাঈম হাসান আগামী বছর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে সেদিনই রাজধানীর গুলিস্তান মোড় অবরোধ করেন কলেজের শিক্ষার্থীরা। এরপর দিন (২৫ নভেম্বর) মতিঝিল শাপলা চত্ত্বর ও পল্টনের মতো ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে অবস্থান নেয় শিক্ষার্থীরা।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে রাজধানীর শান্তিনগর মোড়ে ভিকারুননিসা নূন কলেজের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেন।
এছাড়া নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাজধানীর গুলিস্তান ও ফার্মগেট মোড়ে পাঁচ হাজার শিক্ষার্থী অবস্থান নেন। শিক্ষার্থীদের অবস্থানে সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া রাজধানীর উত্তরাতেও সড়ক অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে রাজধানীতে পরিবহন চলাচল স্থবির হয়ে পড়ে।
তবে এখানেই শেষ নয়। ২৯ নভেম্বর রাতে অনাবিল পরিবহনের একটি বাসের নিচে পিষ্ট হয়ে রামপুরা বাজারের চা দোকানি এবং ছাত্র মাইনুদ্দিন ইসলাম দুর্জয় নিহত হয়। এ বছর রামপুরার একরামুন্নেসা স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষা দেন তিনি। ঘটনার রাতেই বিক্ষুব্ধ জনতা রামপুরা এলাকায় ১৩ টি বাসে অগ্নিসংযোগ করে। এদিকে, নিজের ১৯ তম জন্মদিনেই নিহত হওয়া মাইনুদ্দিনের মৃত্যুতে চলমান এই আন্দোলন আরও জোরদার হয়।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা নিহত শিক্ষার্থী হত্যার বিচার ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে স্লোগান দেয়।
ঢাকা ইম্পেরিয়াল কলেজের শিক্ষার্থী সুমন দাস দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমরা চাই সহপাঠী মাইনুদ্দিন হত্যার বিচার, সকলের জন্য নিরাপদ সড়ক এবং সারাদেশে শিক্ষার্থীদের জন্য হাফপাসের আইন।"
বিএএফ শাহিন কলেজের শিক্ষার্থী মুহাম্মদ আসলাম বলেন, "এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষে আমাদের সহপাঠী হত্যার বিচারের কোন উদ্যোগ দেখিনি। কেউ এসে আমাদের সাথে আশ্বাস পর্যন্ত দেননি, আমরা এই হত্যার সঠিক বিচার না পাওয়া পর্যন্ত অবরোধ চালিয়ে যাবো।"
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থেকে মূলত তাদের এতদিনের ক্ষোভই প্রকাশ পায়। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু দেশে সচরাচর ঘটে থাকে। মৃতের এই তালিকায় শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কম নয়।
শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন যেন ২০১৮ সালের আন্দোলনেরই পুনরাবৃত্তি। সে বছর বাস চাপায় রাজধানীর রমিজউদ্দীন কলেজের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুতে দেশজুড়ে চলে বিক্ষোভ আন্দোলন। ৩ বছর আগের ঐ আন্দোলনে ব্যবহৃত 'উই ওয়ান্ট জাস্টিস' প্ল্যাকার্ড নিয়ে এবারও আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা।
প্ল্যাকার্ডের পাশাপাশি ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন করতেও দেখা যায় তাদেরকে। একটি ব্যঙ্গচিত্রে দেখা যায়, বাসের ছবি মাঝে রেখে পাশ থেকে একজন বলছে, মা আজ রাতে ঘরে ফিরবো না; অন্যপাশে অনাবিল বাস।
আরও দেখা যায়, ব্যঙ্গচিত্রে একজন শিক্ষার্থী ন্যায়বিচারের দাবিতে স্লোগান দিচ্ছেন। আর অন্যপ্রান্ত থেকে পুলিশ বলছে, "আয়রে তোকে জাস্টিস দেই। আমার মাথার ওপর কাহার হাত জানিস?"
পাশাপাশি অন্য একটি চিত্রে দেখা যায়, বাস মালিক এসে সরকারকে ভক্তি করছেন। পাশ থেকে পুলিশ বলছে, "কিছু দেখি নাই, কিছু শুনি নাই, কিছু বুঝি নাই, কিছু বলি নাই।"
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে গত ৫ ডিসেম্বর বাসে হাফ পাসের ঘোষণা দেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ। এই ঘোষণার প্রেক্ষিতে ১১ ডিসেম্বর থেকে দেশের সব মহানগরীর বাসে শিক্ষার্থীদের জন্য ফের হাফ পাস চালু হয়।
নির্দেশনায় বলা হয়, সকাল ৭টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত হাফ ভাড়া কার্যকর হবে। সরকারি, সাপ্তাহিক ছুটি ও শিক্ষার্থীদের মৌসুমী ছুটির সময় হাফভাড়া কার্যকর হবে না।
তবে, হাফ পাসের দাবি মেনে নিলেও গত ৫ ডিসেম্বর শিক্ষার্থীদের করা ১১ দফা আলোচনার বিষয়টি অমীমাংসিতই রয়ে গেছে। এমনকি থামেনি সড়ক দুর্ঘটনাও। এই ঘটনার পর থেকে এখন পর্যন্ত সড়কে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত, গতকাল (৩০ ডিসেম্বর) রাজধানীর গুলশানে বাস চাপায় দুই পথচারি নিহতের খবর পাওয়া গেছে।