কাপুর পরিবারের প্রথম নায়ক; রাজ-রণবীর কাপুরের চেয়ে বেশি হিট ছবি দিয়েছেন, এখন বিস্মৃত
কাপুর পরিবারকে প্রায়ই বলা হয় 'ভারতীয় সিনেমার প্রথম পরিবার'। ভারতের চলচ্চিত্র শিল্পে অবদান রেখেছে চোপড়া, আক্কিনেনি, মুখার্জি ও কোনিডেলা পরিবারের মতো বেশ কিছু পরিবার। তবে বাকিদের চেয়ে কাপুর পরিবার তুলনামূলক দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার পাশাপাশি অনেক বেশি তারকা উপহার দিয়েছে। আট দশকেরও বেশি সময় ধরে কাপুর পরিবার ভারতের পপ কালচারে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে।
কাপুর পরিবারের বেশিরভাগ তারকা এখনও জনপ্রিয় হলেও প্রথম তারকাকে অনেকেই ভুলে গেছেন। কাপুর পরিবারের হারিয়ে যাওয়া এই নায়ক একসময় ছিলেন ভারতের সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পাওয়া অভিনেতাদের মধ্যে একজন। তবে তার কপালে কখনও সুপারস্টারের খেতাব জোটেনি।
ত্রিলোক কাপুরের সাফল্যের শুরু
কাপুর পরিবারের পথপ্রদর্শক হিসেবে বিবেচিত হন পৃথ্বিরাজ কাপুর। ১৯২০-এর দশকে লাহোরে প্রথম অভিনয় শুরু করেন, পরে ১৯২৮ সালে বোম্বেতে (বর্তমান মুম্বাই) চলে আসেন তিনি। তবে হিন্দি (সেই সময় হিন্দুস্তানি) সিনেমায় তিনি এ পরিবার থেকে প্রথম নায়ক হিসেবে অভিনয় করেননি। এই পরিবারের প্রথম তারকা হিসেবে আবির্ভাব হয় তার ছোট ভাই ত্রিলোক কাপুরের।
ত্রিলোকের জন্ম ১৯১২ সালে। বয়সে পৃথ্বিরাজের চেয়ে ছয় বছরের ছোট। বড় ভাইয়ের পথ ধরেই চলচ্চিত্রে আসেন তিনি।
চলচ্চিত্রে তার যাত্রা শুরু ১৯৩৩ সালে, 'চার দরবেশ' ছবিতে নায়কের ভূমিকায় অভিনয়ের মাধ্যমে। সে সময় তার বয়স মাত্র ২১ বছর। প্রথম ছবির কয়েক মাস পর 'সীতা' চলচ্চিত্র দিয়ে তিনি প্রথম সাফল্যের স্বাদ পান। 'সীতা'য় তার বড় ভাই পৃথ্বীরাজও অভিনয় করেন।
সেই সময় পৃথ্বিরাজও প্রতিষ্ঠিত অভিনেতা ছিলেন। তবে তিনি তখন মূলত খলনায়ক বা সহনায়কের চরিত্রে অভিনয় করতেন।
ভারতের অন্যতম শীর্ষ তারকা হয়ে ওঠা
১৯৩৩ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ত্রিলোক কাপুর হিন্দি সিনেমার অন্যতম প্রধান অভিনেতা হয়ে উঠেন। এ সময় কেএল সায়গল, আশোক কুমার, করণ দেওয়ান ও পৃথ্বিরাজের সঙ্গে তিনিও ছিলেন দেশের সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পাওয়া অভিনেতাদের একজন।
১৯৪৭ সালে নূর জাহানের বিপরীতে 'মির্জা সাহিবান' ছবির মাধ্যমে ইন্ডাস্ট্রির শীর্ষ নায়ক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন তিনি।
নূর জাহান ছাড়াও নলিনী জয়ন্ত, সুশীলা রানী প্যাটেল, মীনা শোরে ও সুলোচনাসহ বহু জনপ্রিয় নায়িকার সঙ্গে কাজ করেছেন ত্রিলোক। তবে তিনি কখনও তার অভিনীত ছবিগুলোতে সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিনেতার স্থান নিতে পারেননি।
সমসাময়িক অভিনেতা আশোক কুমার ও জুনিয়র দিলীপ কুমার দর্শকদের প্রিয় নাম হয়ে ওঠেন। কিন্তু ত্রিলোক তাদের মতো সাধারণ দর্শকের সঙ্গে সেরকম সংযোগ গড়তে পারেননি।
ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় অধ্যায়
পঞ্চাশের দশকে ত্রিলোকের বয়স ৪০ বছরের কোঠায়, তখন প্রধান চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ কমে যায়। এরপর তিনি পৌরাণিক ছবির দিকে ঝুঁকেন। তবে এই সময়ে তিনি বিপুল ব্যবসায়িক সাফল্য পেলেও তার খ্যাতি কমে আসতে থাকে।
১৯৪৮ সালে ত্রিলোক 'শ্রী রাম ভক্ত হনুমান'-এ ভগবান রামের চরিত্রে এবং ১৯৫৪ সালে 'রামায়ণ'-এ ভগবান শিবের চরিত্রে অভিনয় করেন। এই ছবিগুলো সফল হয়। এর সুবাদে তিনি ভগবান শিব ও কৃষ্ণের ভূমিকায় একাধিক ছবিতে অভিনয় করেন।
১৯৫০-এর দশকে নীরুপা রায়ের সাথে পর্দায় সফল জুটি গড়েন ত্রিলোক। তারা দুজনে জুটি বেঁধে কয়েকটি ছবিতে শিব ও পার্বতীর চরিত্রে অভিনয় করেন।
এসব কাজ ত্রিলোককে পৌরাণিক চলচ্চিত্রের জগতে বিশেষ জনপ্রিয় করে তোলে। এই ধারায় দর্শকরা তাকে বেশ পছন্দ করতেন।
'রামায়ণ' ছাড়াও 'হর হর মহাদেব', 'বামন অবতার' ও 'শিব পার্বতী'সহ অনেকগুলো পৌরাণিক ছবিতে অভিনয় করেন তিনি। এই ছবিগুলো ছিল কম বাজেটের, কিন্তু বক্স অফিসে সফল।
অভিষেকের পর থেকে ১৯৬০-এর দশক পর্যন্ত ত্রিলোক কাপুর ৩০টির বেশি হিট ছবিতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন। শাম্মি কাপুর (২৮), রাজ কাপুর (১৭) ও রণবীর কাপুরসহ (১১) অন্যান্য কাপুর তারকাদের চেয়ে তার হিট ছবির সংখ্যা অনেক বেশি।
তবে বেশিরভাগ ছবির বাজেট কম এবং ছোট পরিসরের নির্মিত হওয়ায় ক্যারিয়ারজুড়ে পরিবারের অন্য সদস্যের মতো ত্রিলোকের ভাগ্যে কখনও সুপারস্টারের তকমা জোটেনি।
শেষজীবন ও মৃত্যু
১৯৭০-এর দশক থেকে ত্রিলোক কাপুর বড় বাজেটের ছবিতে পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় শুরু করেন। 'জয় সন্তোষী মা', 'ম্যায় তুলসী তেরে আঙ্গনে কি', 'দোস্তানা', 'সওদাগর', 'দো প্রেমী' ও 'গঙ্গা যমুনা সরস্বতী' ছবিতে তাকে পার্শ্বচরিত্রে দেখা যায়।
১৯৮৫ সালে তিনি ভাইপো রাজ কাপুরের আরকে ফিল্মস প্রযোজিত 'রাম তেরি গঙ্গা মেইলি' ছবিতেও একটি ছোট চরিত্রে অভিনয় করেন।
১৯৮৮ সালে ৭৬ বছর বয়সে মারা যান ত্রিলোক কাপুর। শেষদিকে তিনি ছোট বাজেটের ছবিতে নামহীন চরিত্রে অভিনয় করতেন। তাকে শেষ দেখা যায় ১৯৯০ সালে মুক্তি পাওয়া কম বাজেটের সিনেমা 'ওয়াফা'-তে।