রাজেশ খান্না, দিলীপ কুমার, অমিতাভ নন; ভারতের প্রথম সুপারস্টার ছিলেন কাপুর পরিবারের এ সদস্য
১৯২৮ সাল। বোম্বের (বর্তমান মুম্বাই) শীর্ষস্থানীয় চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠান ইম্পেরিয়াল ফিল্মস কোম্পানির অফিস। প্রবেশপথে কড়া পাহারাদার পাঠান প্রহরী। একসময় এক দৃঢ়চেতা চেহারার তরুণ হাজির হলেন অফিসে। পাঠান পাহারাদারের মাতৃভাষা পশতুতে কথা বলে তাকে ভজিয়ে ফেললেন। তার মাধ্যমে পেয়ে গেলেন বিনা পারিশ্রমিকে 'এক্সট্রা'র কাজ।
এক্সট্রা হিসেবে মাত্র ১০ দিন কাজ করেন সেই তরুণ। এগারোতম দিনেই ওই সিনেমা কোম্পানির পরের ছবিতে তাকে নায়ক হিসেবে চুক্তিবদ্ধ করা হয়।
নিজের ওপর অবিচল আস্থা এবং দুর্দমনীয় আকর্ষণ শক্তিতেই নায়ক হিসেবে অভিনয়ের সুযোগ পান এই যুবক। সেইসঙ্গে ছিল খানিকটা ভাগ্যের সহায়তাও। একটি নতুন ছবির শুটিং শুরু কথা ছিল, কিন্তু নায়ক কাউকে কিছু না জানিয়েই দিনের পর দিন শুটিংয়ে আসছিলেন না।
ত্যক্তবিরক্ত পরিচালক তখন নায়িকাকে নিয়ে গেলেন এক্সট্রাদের কাছে। বললেন, তাদের মধ্য থেকে যেন একজনকে নায়ক হিসেবে বাছাই করেন। নায়িকা সরাসরি ওই যুবককে দেখিয়ে দিলেন। এ তরুণের নাম পৃথ্বীরাজ কাপুর।
এভাবেই মঞ্চ, রুপালি পর্দা ও ব্যক্তিগত জীবনে এক অভূতপূর্ব যাত্রা শুরু করেন পৃথ্বীরাজ কাপুর। এ সফরে তিনি হয়ে ওঠেন হিন্দি চলচ্চিত্র শিল্পের প্রথম পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা। চার প্রজন্ম ধরে একের পর এক তারকা উপহার দিয়ে বলিউডে আজও নিজেদের দাপট ধরে রেখেছে এ পরিবার। দিয়ে যাচ্ছে দারুণ সব অভিনেতা।
পৃথ্বীরাজ কাপুরই সম্ভবত একমাত্র ভারতীয় অভিনেতা যিনি একটি পরিবারের তিন প্রজন্মের সঙ্গে দুটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। বাবা বশেশ্বরনাথ কাপুর এবং ছেলে রাজ কাপুর ও শশী কাপুরের সঙ্গে 'আওয়ারা' ছবিতে; আর ছেলে রাজ কাপুর ও নাতি রণধীর কাপুরের সঙ্গে 'কাল আজ অউর কাল' ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি।
পৃথ্বীরাজ কাপুরের জন্ম এক পাঞ্জাবি ক্ষত্রী পরিবারে, ১৯০৬ সালে। তার পরিবার দীর্ঘদিন সরকারি চাকরি করেছে। পৃথ্বীরাজের জন্ম লায়ালপুরে (বর্তমানে পাকিস্তানের ফয়সালাবাদ)। পড়াশোনার পেশোয়ারে। বিখ্যাত এডওয়ার্ডস কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করার পর এক বছর আইন নিয়ে পড়াশোনা করেন।
তবে কিছুদিন পরই পৃথ্বীরাজ বুঝতে পারেন, আইন তাকে টানছে না। লায়ালপুরে থিয়েটারে কাজ করতেন। তাই পড়ালেখার পাট চুকিয়ে চলচ্চিত্র জগতে পা রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন।
১৯২৮ সালে তিনি ফুপুর কাছ থেকে টাকা ধার করে বোম্বেতে চলে আসেন। তার কদিন পরই নির্বাক চলচ্চিত্র যুগের অন্যতম প্রধান অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যান।
চলচ্চিত্র ও মঞ্চ উভয় ক্ষেত্রেই পৃথ্বীরাজ কাপুর অভিনয়দক্ষতার ছাপ রেখেছেন। প্রথমদিকে ছোটখাটো চরিত্রে কাজ করলেও ১৯৩০ সালে 'সিনেমা গার্ল' ছবিতে প্রধান চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পেয়ে যান।
তবে পৃথ্বীরাজ প্রথম আলোতে আসেন ১৯৩১ সালে ভারতের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র 'আলম আরা'তে খলনায়কের ভূমিকায় অভিনয় করে। তবে তিনি তারকাখ্যাতি পান ১৯৩৩ সালের 'রাজরানি মীরা' ছবি দিয়ে। পরে অভিনয় করেন 'বিদ্যাপতি' ও 'সিকান্দর'-এর মতো বড় ছবিতে।
এছাড়া মঞ্চেও সমানতালে কাজ করেছিলেন পৃথ্বীরাজ। মঞ্চে 'পাঠান'-এর নাম ভূমিকায় ও শেক্সপিয়ারের 'দ্য মারচেন্ট অভ ভেনিস' নাটকে শাইলকের চরিত্রে অভিনয় করে নিজের প্রতিভার জানান দেন। ১৯৪১ সালে সোহরাব মোদির 'সিকান্দার' ছবিতে গ্রিক বীর আলেকজান্ডারের চরিত্রে অভিনয় করেন পৃথ্বীরাজ। এ ছবিতে পৃথ্বীরাজের উপযুক্ত চেহারা ও অভিনয় দক্ষতা রাজার ভূমিকায় থাকা মোদির পাশে তাকে সমানভাবে আলোচনায় নিয়ে আসে। কাকতালীয়ভাবে এর প্রায় ২৫ বছর পর, ১৯৬৫ সালে মুক্তি পাওয়া 'সিকান্দার-এ-আজম' ছবিতে পৃথ্বীরাজই রাজা পোরাসের চরিত্রে অভিনয় করেন।
১৯৪৪ সালে তিনি পৃথ্বী থিয়েটার্স প্রতিষ্ঠা করেন এবং ধীরে ধীরে চলচ্চিত্র থেকে সরে আসেন। সে সময় পৃথ্বী থিয়েটার্স ছিল ভ্রাম্যমাণ কোম্পানি; দেশজুড়ে ঘুরে ঘুরে নাটক করত। প্রতিষ্ঠার পরের ১৬ বছরে পৃথ্বী থিয়েটার্স ভারতজুড়ে ২৬০০টিরও বেশি প্রদর্শনী করে। এই সময়ে তিনি 'আওয়ারা'র মত অল্প কিছু চলচ্চিত্রে পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেন।
তবে ১৯৫০-এর দশকের শেষের দিকে পৃথ্বীরাজ পুরোদমে চলচ্চিত্রে ফিরে আসেন। 'মোগল-এ-আজম' ছবিতে সম্রাট আকবরের চরিত্রে অভিনয় করে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান। এ ছবিটি ওই সময়ে সবচেয়ে বেশি আয় করা চলচ্চিত্রের মর্যাদা পায়। এছাড়া পৃথ্বীরাজ 'হরিশচন্দ্র তরমতি', 'মহারথী কর্ণ', 'বিদ্যাপতি', 'আনন্দ মঠ'-এর মতো জনপ্রিয় ছবিতেও অভিনয় করেন।
পৃথ্বীরাজ কাপুর ও অমিতাভ বচ্চনের বাবা লেখক হরিবংশ রায় বচ্চন ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পৃথ্বীরাজ তার নাট্যদল নিয়ে এলাহাবাদে গেলে প্রায়ই লেখকের বাড়িতে যেতেন। পৃথ্বীরাজ ও হরিবংশ একই শহরে থাকতলেই অভিনেতা প্রতিটি পারফরম্যান্সের পর লেখককে ডাকতেন কবিতা আবৃত্তি করার জন্য।
১৯৫০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে পৃথ্বীরাজের তিন সন্তান রাজ, শাম্মী ও শশী কাপুর অভিনয়ে আসার পর তিনি চলচ্চিত্রে কাজ কমিয়ে দেন।
হিন্দি সিনেমার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা পুরুষ হিসেবে বিবেচিত পৃথ্বীরাজ কাপুর ১৯৬৯ সালে পদ্মভূষণ ও ১৯৭১ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৫২ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত তিনি রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন।
পৃথ্বীরাজ কাপুর ১৯৭২ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তার নাতি-নাতনি ও পরবর্তী প্রজন্মের অনেকেই আজ সফল অভিনেতা, যাদের মধ্যে রয়েছেন রণবীর কাপুর, কারিনা কাপুর ও কারিশমা কাপুর। তবে তাদের কেউই পৃথ্বীরাজ বা রাজ কাপুরের মতো ৫০টিরও বেশি হিট চলচ্চিত্র উপহার দেওয়ার রেকর্ড ভাঙতে পারেনি।