একজন কাউছ মিয়ার গল্প
'১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাকে একটি রিভলবার দিয়েছিলেন। আমার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য।' জীবনের স্মরণীয় একটি ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে এই কথাগুলো বললেন হাকিমপুরী জর্দার স্বত্বাধিকারী কাউছ মিয়া।
২০০৮ সাল থেকে তিনি ব্যবসায়ী শ্রেণিতে সর্বোচ্চ করদাতার একজন। এদিকে মুজিববর্ষে ব্যবসায়ী শ্রেণিতে সেরা করদাতার সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। শুক্রবার সকালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কতৃর্পক্ষ অনাড়ম্বর এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তার হাতে সম্মাননা ও স্মারক তুলে দেয়।
১৯৬৭ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এক নম্বর করদাতা হয়েছিলেন কাউছ মিয়া। তার বক্তব্য অনুযায়ী, এখন তার বিভিন্ন ব্যবসা আর জায়গাজমি মিলিয়ে মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় দশ হাজার কোটি টাকা।
কাউছ মিয়া ১৯৩১ সালের ২৬ আগস্ট চাঁদপুর শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পূর্বপুরুষগণ তৎকালীন ত্রিপুরা রাজ্যের অধিবাসী ছিলেন।
১৯৪৫ সালে অষ্টম শ্রেণি পাস করে নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হলে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের দামামায় আর পড়াশোনা এগোয়নি। কিশোর বয়সেই চাঁদপুর শহরে ব্যবসায়ী হিসেবে পেশাজীবন শুরু করেন।
তার বাবা চাইতেন না তিনি ব্যবসা-বাণিজ্যে নামেন। কিন্তু কাউছ মিয়া চাইতেন তিনি পড়াশোনা চালিয়ে যান। বাবার অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ১৯৫০ সালে চাঁদপুরের পুরান বাজারে মুদিদোকান দেন।
এরপর ধীরে ধীরে ১৮টি ব্র্যান্ডের সিগারেট, বিস্কুট ও সাবানের এজেন্ট হন। পরের ২০ বছর তিনি চাঁদপুরেই ব্যবসা করেন।
১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জে চলে আসেন এবং তামাকের ব্যবসা শুরু করেন। বর্তমানে ৪০-৪৫ ধরনের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তিনি। তবে তাঁর মূল ব্যবসা তামাক বেচাকেনা। রংপুরে তামাক কিনে সেখানেই বিক্রি করেন। একবার তিনি আমদানির ব্যবসায় নামতে লাইসেন্স নিয়েছিলেন।
কাউছ মিয়ার ভাষ্যমতে, এ ব্যবসায় কারসাজি না করলে টিকে থাকা মুশকিল—এটা চিন্তা করে আমদানির ব্যবসা ছাড়েন তিনি।
বর্তমানে নদীপথে পণ্য পরিবহনের জন্য ১৮টি কার্গো জাহাজ আছে কাউছ মিয়ার। এই ব্যবসা তার ছেলেরা দেখাশোনা করছেন।
মায়ের দেয়া আড়াই হাজার টাকার পুঁজিতে ১৯৫০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত সফলভাবে ব্যবসা করে আজ বিপুল নগদ অর্থ-বিত্তের মালিক কাউছ মিয়া। ১৯৫৮ সালে প্রথম কর দেন তিনি।
এদিকে তামাকের ব্যবসা থেকেই তার মাথায় আসে জর্দা উৎপাদনের কথা। প্রথমে একটা ছোট কারখানা দিয়ে বাজারে ছাড়লেন 'শান্তিপুরী জর্দা', পরে সেটা নকল হতে থাকায় নতুন করে চালু করলেন 'হাকিমপুরী জর্দা' এই নাম দিয়ে, ১৯৯৬ সাল থেকে।
কাউছ মিয়া জানান, 'শান্তিপুর' বা 'হাকিমপুর' এসব নামকরণের পেছনে বিশেষ কোন কারণ নেই। তবে হাকিমপুর নামটা লোকের মুখে সহজে আসে, সহজে বলতে পারে-এ জন্যই এই নাম রাখা।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি জানান, তামাক ও জর্দার ব্যবসা থেকেই লাভ করেছেন চার-পাঁচশ কোটি টাকা। আর এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, কাউছ মিয়া প্রতিবছর ৪৫ থেকে ৫০ কোটি টাকা কর দেন।
টিবিএস: দেখতে দেখতে জীবনের অনেকটা সময় পার করে ফেললেন। কী মনে হয় এই সময়ে এসে?
কাউছ মিয়া: আমার বয়স এখন ৯১ বছর। তবে সুস্থ আছি। কোনো বড় রোগে আক্রান্ত হইনি। সুন্দরভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছি। সবার সঙ্গে উঠা-বসা করতে পারছি। সৃষ্টিকর্তার প্রতি সেজন্য আমি কৃতজ্ঞ। জীবনের বাকিটা সময়, আমি যেন এভাবেই কাটিয়ে দিতে পারি। এক জীবনে দেশের মানুষ আমাকে যে ভালোবাসা দিয়েছেন, সেজন্য তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। ব্যবসা তো অনেকেই করেন, কিন্তু মানুষের কাছ থেকে সম্মান পান কজন?
আমার জীবনে কোনো দুঃখবোধ নেই। আমার জীবন সুখের সমুদ্র। আল্লাহ আমাকে ছেলে-মেয়ে দিয়েছে। ধন-সম্পদ দিয়েছে। দিন শেষে আমার মনে হয়, আমি আমার দায়িত্বটা পালন করেছি মাত্র। সেজন্যই তারা আমায় এতো ভালোবেসেছেন। কাউকে কোনো দিন আমি ঠকাইনি।
বিষয়টা প্রাসঙ্গিক কি না, জানি না। তবে জীবনের প্রসঙ্গ যেহেতু আসল, তাই বলে রাখি। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাকে একটি রিভলবার দিয়েছিলেন। আমার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য। এটা আমার জীবনে সবচেয়ে মনে পড়ার মত একটি ঘটনা। যা আজও আমার ভীষণ ভালো লাগে।
টিবিএস: আচ্ছা, এখন তো আগের মত পেশাগত ব্যস্ততা নেই, সময় কাটে কিভাবে?
কাউছ মিয়া: বয়স যাই হোক, আমি এখনো কাজ করে আনন্দ পাই। বরং কাজ করতে না পারলে, আমার ভালো লাগে না। আমি এখনো আমার ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করি। সকালে উঠে শুরু করি, রাত দেড়টা-দুটোর আগে ঘুমাতে যেতে পারি না। যৌবনে ব্যবসায় যেমন সময় দিতাম ব্যবসায়, এখনো তেমনটাই দিই।
যখন আমার বয়স ৮৭, একদিন ডাক্তার আমাকে বলেছেন, আপনি এই বয়সে এসেও যদি সেই যৌবনের মত করে চলাফেরা করতে চান, সেটা কি হয় নাকি? চিকিৎসক আমাকে কথা কম বলতে বলেছেন। কিন্তু আমার কি এসব নিয়ম মানতে ভালো লাগে!
টিবিএস: টানা ১৪ বছর ধরে আপনি ব্যবসায়ী শ্রেণিতে সর্বোচ্চ করদাতার একজন। অবশ্য অন্য শ্রেণির সর্বোচ্চ করদাতারা প্রতিবছর কর হিসেবে যত টাকা কর দেন, তারা কেউ আপনা ধারে–কাছেও নেই…
কাউছ মিয়া: দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ থেকেই কিন্তু আমি সেরা করদাতার পুরুস্কার পাই। একটা কথা কি, দেশ ও দেশের মানুষ আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। তাই আমিও মনে করি, দেশকে আমার কিছু দেওয়া প্রয়োজন। দেশের জন্য কিছু করা, আমার দায়িত্ব। আর যতটুকু করতে পেরেছি, তার জন্য আমি আনন্দিত। কিছুটা গর্বিত। আমি সরকারকে কর দিয়ে কি পরিমান আনন্দ পাই, তা যদি আপনাকে বুঝাতে পারতাম।
টিবিএস: আপনি তো আপনার ব্যবসা শুরু করেছিলেন মাত্র আড়াই হাজার টাকা নিয়ে, পঞ্চাশের দশকে। এখন বিভিন্ন ব্যবসা আর জায়গাজমি মিলিয়ে মোট সম্পদের পরিমাণ কত?
কাউছ মিয়া: আমার আগে আমার সাত পুরুষও জমিদার ছিলেন। আমার বাপ-দাদার ৫০০-৬০০ বিঘা জমি ছিল। এখন আমার ছেলে-সন্তানদের নামে জায়গা-জমি আছে। বহু টাকা-পয়সা আছে। তবে এতোসব কিছু দিয়েছেন, ওপরওয়ালা। আল্লাহ আমাকে এতো সম্পদ দিয়েছে, সেটা অনেকেরই অনুমানের বাইরে।
টিবিএস: দেশের অন্য ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করে। কিন্তু আপনি তা কখনো করেননি…
কাউছ মিয়া: ব্যাংক থেকে আমার পূর্ব পুরুষরাও কখনো ঋণ নেননি। আমারও প্রয়োজন হয়নি। আমার পূর্ব পুরুষ রাজনীতি করেনি, আমিও করিনি। আর ছেলেদেরও করতে দেই না। ছেলেদের বলেছি-তোমরাও ব্যবসা করবা। আমার বাবার কথা হলো-রাজনীতির কাছেও যাবা না। নিজের পরিশ্রম করবা, গরিব মানুষকে সহযোগিতা করবা।
টিবিএস: একটা বিষয়, ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় আপনার ৩০টিরও বেশি ফাঁকা বাড়ি পড়ে আছে। সেখানে কেউ থাকেনও না। বেশ কৌতূহল এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে….
কাউছ মিয়া: ৩০ নয়, সংখ্যা আরও বেশি। কত বেশি, খোঁজ নিয়ে তা বের করাটাও বেশ কঠিন। আমি বিভিন্ন জায়গায় বাড়ি করে রেখেছি। ছেলে-মেয়ে আছে। আবার আমাদের আত্মীয়-স্বজন আছে। তারা থাকবে। আবার যখন যে বাড়িটা পছন্দ হইছে, সেটাই কিনে ফেলেছি। এখন হয়তো কেউ থাকছে না। তবে আমি জানি এমন সময় আসবে, আমার পরিবারের সদস্যরা কেউ কেউ থাকার জায়গা ভাগেও পাবে না।
টিবিএস: আপনি বর্তমানে ৪০-৪৫ ধরনের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তবে আপনি সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিতি বেশি পেয়েছেন, তামাক ব্যবসায়ী হিসেবে। তামাকের নেতিবাচক দিক নিয়ে তো অনেক সমালোচনা হয়…
কাউছ মিয়া: আমি ১৯৫০ সাল থেকে বিভিন্ন ব্যবসায় জড়িত। তামাক ব্যবসায় নেমেছি বহু পরে। আর ব্যবসা তো ব্যবসাই। আর এই ব্যবসা করতে তো বাধা নেই। অনেকে বলে-তামাকজাত পণ্যে ক্যানসারের জন্য দায়ী ক্ষতিকর উপাদানের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। আরও বহু কথা।
যে কোনো জিনিস পরিমিত পরিমানে খেলে সমস্যা নাই। আপনি যদি অতিরিক্ত পরিমানে ভাত খান, সেটাও কিন্তু আপনার জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। আমার নিজের কথাই বলি-আমি তো নিয়মিত জর্দা খাই, এখনো।
কই আমার তো এখন পর্যন্ত কোনো সমস্যা হয়নি। ছোটবেলা থেকেই জানি পীর-আউলিয়া পানের সঙ্গে জর্দা সাদাপাতা খেতো। আমরা কিন্তু আগে তামাকের জীবাণুগুলো নষ্ট করি। তারপর বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে তৈরি করি।
টিবিএস: আপনি এতো বড় একজন ব্যবসায়ী, গুলশান-বনানী বা মতিঝিলে অফিস না নিয়ে কেন পুরান ঢাকার ঘুপচি একটি গলির ভেতরে ব্যাবসায়িক অফিস, কেন?
কাউছ মিয়া: এর পেছনে বিশেষ কোনো কারণ নেই। সৃষ্টিকর্তা আমাকে যেখানে রাখবেন, আমি সেখানেই থাকব। আমি নিজের ইচ্ছাতে কিছুই করতে পারি না। তার ইচ্ছেতেই আমার সব।