ভ্যাকসিন নিয়ে জাতীয়তাবাদের বছর হতে পারে ২০২১
যে দেশ যতো তাড়াতাড়ি, যতো বেশি পরিমাণে কোভিড ১৯ এর ভ্যাকসিন দিতে পারবে তার নিজের জনগণকে, সেই দেশের অর্থনীতি ততো তাড়াতাড়ি করোনাভাইরাস থেকে, উদ্ভূত অর্থনৈতিক মন্দা থেকে মুক্তি পাবে। এটা হচ্ছে একটা অর্থনৈতিক বাস্তবতা। এবং এই বাস্তবতার আলোকে, ২০২১ সাল হতে পারে ভ্যাকসিন কেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদের বছর।
অর্থাৎ ২০২১ সালে মানবতা কিংবা বিশ্ব স্বাস্থ্যের চাইতেও নিজের দেশের মানুষের স্বার্থের প্রতি মনোযোগ দিতে বাধ্য হবে বিশ্বের সেই গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলো- যাদের হাতেই রয়েছে ভ্যাকসিন তৈরী এবং বিতরণের দায়িত্ব।
করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরি করা হয়েছে অতীতের সকল রেকর্ড ব্রেক করা দ্রুততার সাথে। ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাব শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই চীনা বিজ্ঞানীরা এই ভাইরাসটির জেনেটিক সিকোয়েন্স বের করে ইন্টারনেটে প্রকাশ করেছিল। এটা ছিল করোনা ভ্যাকসিন আবিষ্কার কিংবা উপযুক্ত চিকিৎসার প্রথম ধাপ। যা হয়েছিল রেকর্ড ব্রেকিং দ্রুততার সঙ্গে প্রথম করোনা কেইস ধরা পড়ার মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই।
ভাইরাসটির জেনেটিক সিকোয়েন্স পাবার পরই বড় বড় ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোর কাছে ভ্যাকসিন তৈরির জন্যে পশ্চিমা বিশ্বের কয়েকটি দেশ বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অনুদান এবং প্রি-অর্ডার দেওয়া শুরু করেছিল । একই কাজে, একই সঙ্গে যোগ হয়েছিল একাধিক আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা এবং ফাউন্ডেশন। যেমন বিল গেইটসের ফাউন্ডেশন ২০২০ এর শুরুতেই কয়েক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছিল ভ্যাকসিন তৈরির কাজে।
আমেরিকান সরকার চালু করেছিল 'অপারেশন ওয়ার্প স্পিড' যার মূল লক্ষ্য ছিল রেকর্ড ব্রেকিং সময়ের মধ্যে ভ্যাকসিন তৈরি, অনুমোদন, এবং বিতরণ করা। এর পেছনে আমেরিকান সরকার পাঁচ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে একাধিক ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিকে। যাদের অনেকে এখন পর্যন্ত ভ্যাকসিন তৈরিই করতে পারে নাই, আবার কেউ কেউ পেরেছে।
প্রোডাক্ট বের হবার আগেই এধরনের টাকা বিনিয়োগের ব্যাপারটাকে বলা হচ্ছে রিস্ক টেকিং বা ঝুঁকি নেয়া- যা কিনা সাধারণত প্রাইভেট সেক্টরে বিনিয়োগকারীরা নিয়ে থাকেন। এদেরকে বলা হয় ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট। করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে একাধিক দেশের সরকার এই ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট এর ভূমিকায় নেমেছিল। শুধু আমেরিকান সরকার না, বিল গেটস ফাউন্ডেশনও এই একই কাজ করেছে। তারা এমনভাবে টাকা বিনিয়োগ করেছে যে তারা নিশ্চিত জানতো যে বিনিয়োগকৃত টাকার একটা বড় অংশ ফল নিয়ে আসতে পারবে না।
ঝুঁকিপূর্ণ বেসরকারি বিনিয়োগের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ দেশ গুলো প্রি-অর্ডার দিয়ে রেখেছে সম্ভাব্য ভ্যাকসিনের, যাতে করে নিজ দেশের জনগণ সবার আগে ভ্যাকসিন পায়। যেমন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন শুধু ফাইজার কোম্পানির বানানো ভ্যাকসিনের অর্ডার দিয়েছে ২০০ মিলিয়ন। আমেরিকা একই ভ্যাকসিনের প্রি-অর্ডার দিয়েছে ১০০ মিলিয়ন ডোজের, যা তারা বাড়িয়ে ৫০০ মিলিওন করে নিতে পারবে ইচ্ছে করলে। জাপান এবং যুক্তরাজ্য দিয়েছে ১২০ মিলিয়ন এবং ৩০ মিলিয়ন ডোজের প্রি-অর্ডার এই একই ভ্যাকসিনের।
গত পরশু যুক্তরাজ্যে ফাইজার ভ্যাকসিনের জরুরীভিত্তিক ব্যবহারের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। কিছু দিনের মধ্যেই আমেরিকাসহ অন্যান্য দেশেও এই ভ্যাকসিনের অনুমোদন হয়ে যাবে বলে ধারণা করা যায়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যে, রেকর্ড ব্রেকিং দ্রুততার সাথে অনুমোদনের ঝামেলা পার করতে পারলেও, ফাইজার কোম্পানি ইতোমধ্যে যতগুলো প্রি-অর্ডার পেয়েছে ততগুলো ভ্যাকসিন তারা সাপ্লাই দিতে সক্ষম নাও হতে পারে ২০২১ সালে।
মডার্না, অক্সফোর্ড - অ্যাস্ট্রাজেনেকা সহ অন্যান্য ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো যারা স্বচ্ছ তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে ভ্যাকসিন বাজারে আনছে তারা সবাই এই একই সমস্যার সম্মুখীন হবে। কেননা তারা সবাই প্রচুর প্রি-অর্ডার পেয়ে বসে আছে।
এক হিসেবে দেখা গেছে ২০২১ সালে ভ্যাকসিন বাজারে আসতে পারে দুই বিলিয়ন। অন্যদিকে পৃথিবীর জনসংখ্যা হচ্ছে সাত বিলিয়ন।
এক আমেরিকাই দাবি করে বসেছে যে তারা ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসের মধ্যেই ৩০০ মিলিয়ন ভ্যাকসিন নিজের দেশে বিতরণ করবে। নিশ্চিত ভাবে ধরে নিতে পারেন অন্যান্য ধনী রাষ্ট্রগুলোও যুক্তরাষ্ট্রের পথ ধরেই আগাবে। কেউ চাইবে না যে সবাই মিলে মিশে দুই বিলিয়ন ভ্যাকসিন সারা দুনিয়ার সাত বিলিয়ন মানুষের মাঝে সম-বন্টন করা হোক। যদিও এভাবে সম বন্টনের পথে আগালে ২০২১ সারা দুনিয়ার ২০ শতাংশ মানুষ কার্যকরী ভ্যাকসিনগুলো পেতে পারতো। কিন্তু এ ধরণের সমবণ্টনের আশা বাস্তবতা বিবর্জিত, দুরাশা মাত্র।
বরং এটা হবার সম্ভাবনাই বেশী যে ধনী রাষ্ট্রগুলো একে অপরের সঙ্গে ডিপ্লম্যাটিক সংঘাতে লিপ্ত হবে ২০২১ সালে। নিজের দেশের জন্যে অধিক কার্যকরী ভ্যাকসিন গুলো নিশ্চিত করতে গিয়ে।
একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা ভালো বুঝা যাবে। ধরুন এক ধনী রাষ্ট্র অন্য এক ধনীর রাষ্ট্রের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির কাছে ভ্যাকসিন প্রি-অর্ডার দিয়েছে কয়েক মিলিয়ন। কিন্তু ২০২১ সালের মাঝামাঝি এসে দেখা গেলো যে ভ্যাকসিন ম্যানুফ্যাকচারিং করছে যে রাষ্ট্রের কোম্পানি তারা নিজের দেশের নাগরিকদেরকেই ভ্যাকসিন দিতে পারছে না সময়মতো।
তখন ব্যাপারটা হয়ে যেতে পারে একটা বিশাল বড় পলিটিকাল ইস্যু। এরকম অবস্থায় জাতীয় স্বার্থের কথা চিন্তা করে প্রি-অর্ডারের আলাপ বাদ দিয়ে ভ্যাকসিন ম্যানুফ্যাকচারারকে জোড় করে বাধ্য করতে পারে তার নিজ রাষ্ট্র নিজের জনগণকে সবার আগে ভ্যাকসিন দেবার জন্যে। এমন ঘটনাই ঘটেছিল ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে যখন ট্রাম্প সরকার বলেছিল যে হাইড্রোক্সি ক্লোরকুইন দিয়ে করোনার চিকিৎসা করা যায়। এই খবর শোনার সাথে সাথে ভারত সরকার এই বিশেষ উপাদানটির বিদেশে রপ্তানি বন্ধ ঘোষণা করে দিয়েছিল নিজের দেশের স্বার্থ চিন্তা করে।
ভ্যাকসিনের সাপ্লাই সাইডের আর একটা খুব বড় অনিশ্চয়তা হচ্ছে গণহারে এই ভ্যাকসিন প্রস্তুত করার সময় ভ্যাকসিনটির ভাইরাস বিরোধী কার্যকারিতা ধরে রাখতে পারার ব্যাপারটি।
ধরুন একটি কার্যকরী ভ্যাকসিনের ফর্মুলা একাধিক দেশকে দিয়ে দেয়া হলো স্বল্প মূল্যে। কিন্তু ফর্মুলা পেয়েই মিলিয়ন মিলিয়ন ভ্যাকসিন একই কোয়ালিটি নিশ্চিত করে তৈরি করতে পারার সক্ষমতা পৃথীবিতে খুব কম দেশেই আছে। আমেরিকান ভ্যাকসিন আবিষ্কারক ফাইজার কিংবা মডার্নার মতো কোম্পানি গুলো নিজেরাই মিলিয়ন মিলিয়ন ভ্যাকসিনের মান ধরে রাখতে পারবে কিনা সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে খোদ আমেরিকান রেগুলেটরদের মধ্যেই।
গণহারে ভ্যাকসিন তৈরির সক্ষমতা এবং মান নিয়ন্ত্রণের সীমাবদ্ধতার কারণে নিশ্চিতভাবে ধরে নিতে পারেন যে গরীব রাষ্ট্র এবং ধনী রাষ্ট্রের মধ্যে কার্যকরী কোভিড ভ্যাকসিন পাওয়ার কোয়ালিটির ব্যাপক তারতম্য হবে।
ধনী রাষ্ট্রগুলো ২০২১ সালে এবং বাদ বাকী বিশ্ব ২০২২ সাল নাগাদ কার্যকরী ভ্যাকসিন গুলো তাদের জনগনের নাগালের মধ্যে এনে দিতে পারবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এক্ষেত্রে আশার কথা হচ্ছে, চাইনিজ, রাশিয়ান, কিংবা ভারতীয় ভ্যাকসিন যদি ফাইজারের কিংবা মডার্না ভ্যাকসিনের মতো ৯৫% কার্যকরী না হয়ে কোন মতে ৫০% এর বেশি কার্যকরি হয়, তাহলেও কিন্তু অনেক উপকার হবে গরীব রাষ্ট্র গুলোর। ঐতিহাসিকভাবে কোন ভ্যাকসিন ৫০-৬০% কার্যকর হলেই ভালো ভ্যাকসিন হিসেবে স্বীকৃতি পেতো। একারণে টপ কোয়ালিটি ভ্যাকসিনের প্রতিযোগিতায় চোখ রাখার পাশাপাশি আমাদের চোখ রাখতে হবে চাইনিজ কিংবা অন্য কোন দেশের ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা এবং বিতরণের উপরে।
ইতোমধ্যে অক্সফোর্ড তার ভ্যাকসিন বিনা লাভে গরীব দেশ গুলোতে বিক্রির ঘোষণা দিয়েছে। এর বাইরে বিল গেইটস ফাউন্ডেশন, গ্যাভি নামের আর একটি অ্যালায়েন্স উন্নত মানের ভ্যাকসিন গরীব দেশগুলোতে সময় মতো পৌঁছে দেবার অঙ্গিকারও করেছে।
টপ কোয়ালিটি ভ্যাকসিন গুলো নিজের দেশে বিতরণের ক্ষেত্রে অনুন্নত দেশ গুলোর জন্যে সব চাইতে বড় চ্যালেঞ্জ হবে ভ্যাকসিন ট্রান্সপোর্টেশন। ফাইজারের ভ্যাকসিনটি অতিরিক্ত কম তাপমাত্রায় রাখতে হয়। এতো কম তাপমাত্রার ফ্রিজে এগুলো রাখতে হয় যা রিসার্চ ল্যাবরেটরি ছাড়া উন্নত বিশ্বের দেশ গুলোতেও পাওয়া যায় না। অনুন্নত বিশ্বের রাস্তায় এই ভ্যাকসিন পরিবহন হবে বিশাল বড় এক চ্যালেঞ্জ। তবে অক্সফোর্ড এবং মডার্নার ভ্যাকসিন গুলো তুলনামূলক ভাবে সহজে ট্রান্সপোর্ট করতে পারা যাবে।
উপরের আলোচনার উপসংহারে বলতে হবে, ২০২১ সালে সারা দুনিয়াতে ভ্যাকসিন আসলেও, কোন দেশে কোন কোয়ালিটির ভ্যাকসিন, কতো পরিমাণে, কতো তাড়াতাড়ি পৌঁছাবে তা নিয়ে থেকে যাবে অনেক বড় অনিশ্চয়তা। এই অনিশ্চয়তা শুধু অনুন্নত বিশ্বে না, উন্নত বিশ্বের জন্যেও প্রযোজ্য হবে। আর এই অনিশ্চয়তার হাতে জিম্মি হয়ে থাকবে ভাইরাসের হাত থেকে এক একটি দেশের অর্থনৈতিক মুক্তি।
২০২১ সালের এই ভ্যাকসিন বিতরণের এই মহাযজ্ঞকে আরো বেশি অনিশ্চিত করে তুলতে পারে জটিল হয়ে আসা বিশ্ব-রাজনীতি এবং ক্রমবর্ধমান উগ্র-জাতীয়তাবাদ।
- লেখক: কলামিস্ট এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ ডালাসের শিক্ষক।