যখন একটি ভালো আইনও আপনাকে সুরক্ষা দিতে পারে না
কারাগারের মধ্যেই লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যু এবং জামিনে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসার পর কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর তার ওপর চালানো নির্যাতনের যে বর্ণনা গণমাধ্যমে দিয়েছেন; তা জনগণের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার জন্য তৈরি করা অত্যন্ত প্রশংসিত একটি আইনের প্রয়োগের অভাবকে নতুনভাবে তুলে ধরেছে।
'রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ' করার অভিযোগে এই দুজনকে নয়মাস আগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা একটি মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর সাত বার জামিনের আবেদন করা হলেও তা মঞ্জুর হয়নি।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার যে সদস্যরা তাদের তুলে নিয়ে গিয়েছিল এবং তাদের উপর নির্যাতন চালিয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে, তারা নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ এর কোনও তোয়াক্কাই করেননি। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হেফাজতে থাকা ব্যক্তির ওপর যে কোনও পরিস্থিতিতে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন নিষিদ্ধ করতে এবং হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা থেকে সুরক্ষা দিতে এই আইন তৈরি করা হয়েছিল।
মোদ্দাকথা হল, নির্যাতনবিরোধী এই আইনটি মুশতাক ও কিশোরের উপর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি দলের চালানো নির্যাতনের অভিযোগ থেকে রক্ষা করতে পারেনি।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর নির্বিচারে ক্ষমতা প্রয়োগের বিরুদ্ধে রায় দিয়ে চার বছরেরও বেশি সময় আগে সুপ্রিম কোর্ট নির্যাতনবিরোধী আইনটির যথাযথ প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছিল।
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য এই আইনের তাৎপর্য অপরিসীম। সুপ্রিম কোর্ট তখন বলেছিল, "এই আইনের মাধ্যমে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক অবস্থায় একজন ব্যক্তির আত্মমর্যাদা, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সুরক্ষিত থাকবে।"
সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, "স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত দেশে যে আইনগুলো হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম সুন্দর একটি আইন এটি। সংবিধান তৈরির সময় জাতির পিতা যে লক্ষ্য এবং আকাঙ্ক্ষা ছিলো তার প্রতিফলন ঘটেছে এই আইনের মাধ্যমে"
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মুশতাক এবং কিশোরের সঙ্গে যা ঘটলো তা আমাদের ভিন্ন গল্পই শোনায়।
তাদের যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তা সংবিধানের বিধানকেই ক্ষুন্ন করেছে। সংবিধানের ৩৫ (৫) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: "কোন ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাইবে না কিংবা কাহারও সহিত অনুরূপ ব্যবহার করা যাইবে না।"
উপরোক্ত সাংবিধানিক বিধান কার্যকর করতে সংসদ কর্তৃক নির্যাতনবিরোধী আইন কার্যকর করা হয়েছে। এই আইনের অধীনে সংঘটিত অপরাধের জন্য ন্যূনতম শাস্তি পাঁচ বছর এবং জরিমানাসহ সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
নির্যাতনবিরোধী আইনটি কার্যকর করায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি বাংলাদেশের দেওয়া প্রতিশ্রুতিও সমুন্নত হয়েছিল।
নির্যাতন, নিষ্ঠুর, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ বা শাস্তির বিরুদ্ধে জাতিসংঘের সম্মেলনে ১৯৯৮ সালে স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ। এর স্বাক্ষরকারী হিসেবে কার্যকর আইন প্রণয়ণ এবং ভূখণ্ডে নির্যাতনের ঘটনা রোধে প্রশাসনিক, বিচারিক বা অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বাংলাদেশ।
কিন্তু নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যুর বিরুদ্ধে আইন কার্যকর হলেও এই ঘটনার অবসান ঘটাতে পারেনি। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালে আইনটি কার্যকর হওয়ার পর থেকে গত বছর পর্যন্ত ৫০০টিরও বেশি হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।
আইন প্রয়োগকারী বাহিনী কর্তৃক নির্যাতনের ঘটনা ব্যাপকহারে বেড়েছে। তবে এসব ঘটনায় নির্যাতনবিরোধী আইনের অধীনে মামলা হয়েছে হাতেগোনা।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে এই আইনে দায়ের করা মামলায় প্রথম রায়টি আসে। ওই রায়ে ২০১৪ সালে মিরপুরে পুলিশের নির্যাতনে এক ব্যবসায়ীর মৃত্যুর ঘটনায় তিন পুলিশ সদস্যের যাবজ্জীবন এবং দুজনের সাত বছরের সাজা দেয় আদালত।
চার বছর আগে, ২০১৭ সালে, পুলিশের নির্বিচারে ক্ষমতা প্রয়োগের বিরুদ্ধে যুগান্তকারী এক রায়ে নির্যাতনবিরোধী আইন প্রয়োগ না করার কারণে হতাশা প্রকাশ করেছিল দেশের শীর্ষ আদালত।
আইনটির দুর্বল প্রয়োগের পেছনের কারণ স্পষ্ট। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলি আইনের এমন কিছু বিধান পছন্দ করেননি যা নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যুকে ক্রিমিনাল অফেন্স হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে।
২০১৫ সালে তারা নির্যাতন বিরোধী আইনে বড় ধরনের পরিবর্তনের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছিল এবং হেফাজতে মৃত্যু ও নির্যাতনের জন্য মামলা থেকে সুরক্ষা চেয়েছিল। তারা নির্যাতন বিরোধী আইনের আওতা থেকে নিজেকে বাদ দিতে চেয়েছিল।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগলোর অনেক সদস্য নির্যাতনবিরোধী আইনের বিষয়ে খুব একটা মাথা ঘামান না, যতোটা তৎপরতা দেখানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আর্টিকেল-১৯ এর তথ্য অনুযায়ী, শুধুমাত্র গত বছর এই আইনের অধীনে ১৯৮ টি মামলায় বিভিন্ন পেশার প্রায় ৪৫৭ কে অভিযুক্ত করা হয়েছে এবং তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
লক্ষ্যণীয় যে, এই দুটি আইনই তৈরি করেছে আমাদের সংসদ। তাই এই দুই আইনের ব্যবহার এবং অপব্যবহারের উপর নির্ভর করে এর ভাবমূর্তি।
২০১৮ সালে তৈরি হওয়ার পর থেকে বারবার তীব্র নিন্দার মুখোমুখি হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। সম্প্রতি মুশতাকের মৃত্যু এবং কিশোরের উপর নির্যাতনের পর থেকে এই আইনের বিরুদ্ধে নতুন করে নিন্দার ঝড় উঠেছে।
অন্যদিকে, শীর্ষ আদালত যে আইনটির সর্বাধিক প্রশংসা করেছিল তার প্রয়োগ তেমনভাবে না থাকায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক নিয়ন্ত্রণহীন ক্ষমতার চর্চা বেড়েছে।
আমাদের জাতীয় সংসদ, যা দুটি আইনই তৈরি করেছে, একটির অপব্যবহার এবং অপরটির প্রয়োগ না করা সম্পর্কে এখনো উদাসীন রয়েছে। যদিও আইন প্রয়োগের বিষয়টি পর্যালোচনা করা এবং এ জাতীয় আইনের বাস্তবায়নের জন্য পদক্ষেপের প্রস্তাব করা সংসদ সদস্যদের সাংবিধানিক দায়িত্ব।
সুতরাং, আইনের অপপ্রয়োগের বিষয়ে যখন খোদ সংসদই অন্ধ থাকে তখন আইন অপব্যবহারকারীদের জন্য বিষয়টি আশীর্বাদ হিসেবেই উপস্থিত হয়।
- লেখক: উপ-নির্বাহী সম্পাদক, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড
- মূল লেখা: When even a good law can't protect you
- অনুবাদ: তারেক হাসান নির্ঝর