‘যেকোনো উপায়ে’ রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়া ও টিকে থাকা রাজনীতির মূল লক্ষ্য হতে পারে না
পৃথিবীতে অল্প কিছু পেশা আছে যেখানে বয়স কোন বাধা নয়। রাজনীতি তেমন একটি পেশা, যেটা আমৃত্যু করা যায়।
মাহাথির বিন মোহাম্মদ থেকে জো বাইডেন, বয়সের এই প্রান্তে এসে তাদের রাষ্ট্র পরিচালনার মত কাজে যুক্ত না থেকে 'চাপমুক্ত' জীবনযাপন করার কথা। কিন্তু তারা সদর্পে রাজনীতিতে আছেন।
আমরাও পিছিয়ে নেই। আমাদের যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন এবং যারা রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য 'অধিকতর যোগ্য' মনে করে রাজনীতির মাঠে আছেন, তাদের সবার বয়স এখন আর কোনো ধরনের 'চাপের' মধ্যে থাকার কথা নয়।
বাংলাদেশ 'দুরন্ত গতিতে' এগিয়ে যাচ্ছে। চোখ মেললেই অবকাঠামোর উন্নয়ন দেখা যায়। সামাজিক ও মানবিক উন্নয়ন সূচকের ২/১টি ধাপে কিছুটা অবনমন ঘটলেও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সূচকের অগ্রগমন বিশ্বে বাংলাদেশের কদর বাড়িয়েছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন আওতাধীন এক কমিশনার মহোদয়ের গল্প শুনছিলাম। তিনি প্রতিদিন অফিসে আসার সময় তার সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ ছেলেকে সাথে নিয়ে আসেন। বাবার সাথে সে-ও একটা চেয়ারে টুপি মাথায় দিয়ে বসে। দর্শনার্থী ও বিভিন্ন কাজে যারা আসেন তাদের সবার সাথে ছেলেকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। ছেলেও মিষ্টি হেসে সালাম দিয়ে পরিচিত হয় এবং বাবার কাজ প্রত্যক্ষ করে।
জিজ্ঞাসা করায় কমিশনার মহোদয় জানান, "ছেলেকে এখন থেকে শেখাচ্ছি, মানুষের সাথে কীভাবে মিশতে হয়, কীভাবে সমস্যা শুনতে হয় এবং কাজ করতে হয়।"
কমিশনার মহোদয়ের মহতী উদ্যোগ। তার অবর্তমানে যেন তার ছেলে হাল ধরতে পারে। ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তিনি তার মতো করেই চিন্তা করেছেন।
কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে ভবিষ্যত নেতৃত্ব গড়বার চিন্তা ও প্রচেষ্টা আশঙ্কাজনকভাবে অনুপস্থিত। সে-কারণে কোথাও কোনো শূন্যতা তৈরি হলে আমরা অসহায় বোধ করি। শূন্যস্থান পুরণের দ্রুত প্রয়োজনে ঐ পরিবারের যে কাউকে সামনে নিয়ে আসা হয়। এই চর্চা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করে রাষ্ট্র কাঠামোর সর্বত্র। কোনো পর্যায়ের কোথাও বিকল্প নেতৃত্বের তালিকা তৈরি করা হয় না। এটা থাকলে মানুষ সহজে তালিকার ক্রমে তার পছন্দের নেতৃত্ব সম্পর্কে মতামত জানাতে পারতো। সে সুযোগ রাখা হয়নি।
আমাদের এই উপমহদেশের রাজনীতিতে 'আমিত্বের' প্রভাব প্রকট। কোনো নেতা চান না, তার বিকল্প অন্য কেউ গড়ে উঠুক। আইনগত উত্তরাধিকার যারা কেবল তাদের নিয়েই ভেবেছেন, পরবর্তী বিকল্প হিসেবে। নিজের সন্তান না থাকলে ভাইপো-স্থানীয় কেউ হবেন পরবর্তী নেতা।
এভাবেই 'পরিবারতন্ত্র' স্থান করে নিয়েছে এই উপমহাদেশের রাজনীতির অঙ্গন; এই প্রবণতা এই উপমহাদেশের বাইরেও কমবেশি দেখা যায়। এটা দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র চর্চার অন্তরায়।
গণতন্ত্রের অর্থ যদি হয় বহুবাদিত্ব, তাহলে দলের মধ্যে বিভিন্ন মত ও আদর্শের অবস্থানের মান্যতা দিতে হবে। প্রত্যেকে তার নিজস্ব মত প্রকাশ ও প্রচার মানতে পারার সংস্কৃতি থাকতে হবে। তবে দলের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে গৃহীত মতাদর্শ মানতে হবে সবার।
দলের অভ্যন্তরের সকল মত ও চিন্তা সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের অধীন- এটিই গণতন্ত্র অনুশীলনের মূল কথা। বিভিন্ন মত ও চিন্তার সাথে আদর্শগত লড়াই করাটাই গণতন্ত্র। আমাদের মূলধারার রাজনীতিতে এই চর্চা দেখা যায় না। বরং ভিন্নমত 'দমন' করা হয় নিষ্ঠুরভাবে। এর প্রভাব গিয়ে পড়ে সরাসরি সমাজে। ফলে সমাজের সহনশীলতা দ্রুত নষ্ট হচ্ছে।
আমাদের পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াগুলো দেখলে বোঝা যায়, এখানে খুব আলাপ আলোচনার সুযোগ থাকে না। ভিন্ন মত বা চিন্তা প্রকাশের উপযুক্ত পরিবেশ খুঁজে পওয়া যায় না। ফলে সমাজে বহু চিন্তার জায়গায় একক চিন্তা ও একক মতের প্রাধান্য বৃদ্ধি পেতে থাকে। সবাই মিলে বা বহুজনে একত্র হয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয় না। ওটা এখন মুষ্টিমেয় কয়েকজনের বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
মানুষ এখন আর কোনো কিছুতে দায় বোধ করে না। আমরা এখন পারস্পারিক বন্ধন ছেঁড়া বিছিন্ন প্রাণিতে পরিণত হয়েছি। আমাদের রাজনীতি এখন আর সমাজিক ঐক্য তৈরি না করে বরং সামাজিক অনৈক্য লালন করছে। সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সেই সাক্ষ্য দেয়।
আমাদের রাজনীতির অভিভাবক এখন খানিকটা রিপ্রেজন্টেশন অব দ্যা পিপল অর্ডার বা আরপিও। আরপিও মেনে এখন রাজনৈতিক দলগুলোকে চলতে হবে। আরপিও না মেনেও রাজনীতি হয়তো করা যাবে কিন্তু নিয়মতান্ত্রিকভাবে নির্বাচন করে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যেতে হলে আরপিও-র শর্ত মেনে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত হতে হবে।
নিবন্ধিত হওয়ার শর্তের তালিকা মোটেই ছোট নয় বরং লম্বা। কী করতে হবে এবং কী করা যাবে না- তা স্পষ্ট করা আছে। কিন্তু যেটা সবচেয়ে জরুরি, দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র চর্চা নিয়ে আরপিও-র কোথাও কিছু বলা নেই।
রাজনৈতিক দলগুলোর গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সকলের মতামতের ভিত্তিতে দলীয় নেতৃত্ব গঠিত হওয়ার কথা। নেতৃত্ব দলের বিভিন্ন পর্যায়ের কাঠামোর মতামতের ভিত্তিতে দলীয় সিদ্ধান্ত তৈরি হবার কথা- এই চর্চাটুকু থাকলেও দলের মধ্যে গণতন্ত্র বিকশিত হওয়ার সুযোগ পেত।
রাজনৈতিক দলগুলোর কাউন্সিল একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচী। সারাদেশ থেকে কর্মীদের দ্বারা কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের জন্য নির্বাচিত প্রতিনিধিরা বছরে একবার সমবেত হন। পার্টির আগের বছরের গৃহীত নীতি ও কৌশল বাস্তবায়নের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা ও পর্যালোচনা হবে কাউন্সিলে। পার্টির বিভিন্ন কর্মসূচী বাস্তবায়নের সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়েও আলোচনা হবে কাউন্সিলে।
সমগ্র আলোচনার ভিত্তিতে নতুন রাজনৈতিক নীতি ও কৌশল গৃহীত হওয়ার পাশাপাশি নেতৃত্ব নির্বাচন করা হয় যারা গৃহীত নীতি ও কৌশল এগিয়ে নিয়ে যাবেন। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্র মৌলিক কাঠামো অনেকটা এই রকমের।
কিন্তু বাস্তবে হয়টা কী? দিনভর বক্তৃতা হয়। প্রতিটি বক্তৃতা মোটামুটি একই ধরনের। সবাই অভিন্ন উচ্চারণে নেতা- নেত্রীর গুণকীর্তন করতে থাকেন। নিজের গৃহীত নীতি- কৌশল ও রাজনৈতিক কর্মসূচী অন্য সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ সেটা বারবার বলতে থাকেন। এর সাথে যুক্ত করেন, এরাই একমাত্র দল যারা দেশকে ভালোবাসে আর অন্যরা দেশকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।
সারাদিন ধরে এই জাতীয় আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হয়, আগামী দিনের জন্য রাজনৈতিক পন্থা ও দলীয় নেতৃত্ব গঠনের দায়িত্ব হবে 'একজনের'। তিনি সবটা ঠিক করে দিবেন। আর সেই 'তিনিটা' হলেন দলীয় প্রধান। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি মুখ থুবড়ে পড়ে। আমরা ক্রমান্বয়ে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও চেতনা বিবর্জিত জাতিতে পরিণত হতে থাকি।
'প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ' এর অর্থ, কেন্দ্রিকতা নয় বরং গণতান্ত্রিকতা। সকল সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা কোন একটি জায়গার পরিবর্তে সাধারণের উপর নির্ভরশীল হওয়ার সংস্কৃতি। কেন্দ্রিকতা স্বেচ্ছাচারী করে তুলতে পারে। স্বেচ্ছাচারিতা স্বৈরতন্ত্রের জন্ম দেয়। সাধারণ মানুষ সবকিছু হতে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ভোট দিতেও আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
এরকম পরিস্থিতিতে স্বৈরতন্ত্রের সাময়িক সুবিধা হলেও সর্বনাশ হয় গণতন্ত্রের। কেন্দ্রিকতার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি স্বৈরতন্ত্র, সেকারণে এই চক্র ভাঙতে হবে। এটা নিয়ে কেউ কথা বলছেন না। এমন কিছু বিষয় নিয়ে মাতামাতি করা হয়, যার ফলে, সর্বক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা সাধারণের কাছে ফিরিয়ে দেবার চিন্তা হারিয়ে যায়।
'যে কোন উপায়ে' রাষ্ট্র ক্ষমতায় টিকে থাকা অথবা 'যে কোন উপায়ে' রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়া, এই যদি হয় সমগ্র রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার মূল লক্ষ্য, তাহলে এর কোথাও সাধারণের স্থান রাখা হয়নি। গণতন্ত্রের অপরিহার্য শর্ত, সাধারণের ক্ষমতায়ন- এই প্রত্যয়টি রাজনৈতিক ভবিষ্যত কর্মসূচী ও বর্তমান কার্যক্রমে আশঙ্কাজনকভাবে অনুপস্থিত।
"আমরা (পড়তে হবে আমি) ক্ষমতায় গেলে সকল ক্ষমতা জনগণের কাছেই ফিরিয়ে দিবো"- এ কথা মানুষ বিশ্বাস করে না। ফলে আপনি বা আপনারা কী করতে চান সেটা স্পষ্ট করেন এবং আগে কেন করেননি তা নিয়ে প্রকাশ্যে আত্মসমালোচনা করেন। অহেতুক বাগড়ম্বর না করে নিজেদের ব্যর্থতা ও অযোগ্যতা সামনে নিয়ে আসেন। এটার মধ্য দিয়েই রাজনীতির নতুন মাত্রা যোগ হতে পারে।