প্রসঙ্গ কিশোর অপরাধী: আমাদের সন্তানেরা হারিয়ে যাচ্ছে খুব দ্রুত
লেখাটা যখন শেষ করে ফেলেছিলাম, তখন যে খবরটি চোখে পড়লো, তা দেখে আবার বুঝতে পারলাম, আমরা কতটা ভুল পথে হাঁটছি। অসুখের গভীরে না গিয়ে, মলম লাগানোর উদ্যোগ নিচ্ছি। কিশোর অপরাধ ও গ্যাং বেড়ে যাওয়ায় শিশুদের বয়সসীমা ১৮ থেকে কমানোর চিন্তা করছে আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার প্রেক্ষিতে এই আলোচনা হয়েছে বলে কমিটি জানিয়েছে। শিশু-কিশোরদের অপরাধ জগত থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য নিঃসন্দেহে এটি একটি অর্থহীন উদ্যোগ হবে। এখানে বয়স তেমন কোন ব্যাপার না, জরুরি হচ্ছে পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষা এবং স্কুলের ভূমিকা। যেখানে আমরা ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছি।
পত্রিকার সংবাদ বলছে, কাটাকাটির জেরে চট্টগ্রামের একটি স্কুলে অষ্টম শ্রেণীর এক ছাত্রীর ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত হয়েছে নবম শ্রেণীর আরেক ছাত্রী। 'হিরোইজম' দেখাতে গিয়ে শিক্ষককে পিটিয়ে মেরেছে আশুলিয়াতে এক ছাত্র। পিরোজপুরের একটি গ্রামে জমি নিয়ে বিরোধের জেরে এক ভাই আরেক ভাইয়ের চোখ তুলে নিয়েছে। খুলনায় চাচাতো ভাইয়ের টেঁটার আঘাতে ভাই নিহত। নরসিংদীতে এক যুবককে বাড়ির আঙিনায় গাছের সঙ্গে বেঁধে পিটিয়ে হত্যা করেছে তারই দুই ভাই। নোয়াখালিতে এলোপাতাড়ি পিটিয়ে ও কুপিয়ে বড় ভাইয়ের হাতে ছোট ভাই খুন হয়েছেন।
সবচেয়ে ভয়াবহ ও দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, এই হত্যাকান্ডগুলো সব প্রকাশ্যে ঘটেছে এবং এগুলোর কিছু দর্শকও ছিল। কেউ কেউ এসব মারধোরের ঘটনা ভিডিও-ও করেছে কিন্তু মারধোর থামাতে সেইভাবে এগিয়ে আসেনি। ঘুঘুগুলো বিষ খেয়ে যেমন এলোপাথারিভাবে মরে পড়ে ছিল, এই মানুষগুলোও সেইভাবেই হত্যার শিকার হয়ে পড়ে ছিল।
ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্নভাবে ঘটলেও আমাদের ভেতর চরম শংকার জন্ম দিয়েছে। শিশু থেকে তরুণ-যুবার এই আচরণ একধরণের অসহিষ্ণু সমাজের কথা বলছে। ছেলের অবলীলায় বাবাকে খুন, প্রেমে ব্যর্থ হয়ে প্রেমিকাকে মেরে ফেলা, ধর্ষণ এবং অঙ্গহানি করার ঘটনা ঘটেই চলেছে।
মানুষের এই অসহিষ্ণু হয়ে ওঠার পেছনে যে মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা কাজ করছে, সে প্রসঙ্গে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার বলেন, "এগুলো নিয়ে এখন গভীরভাবে গবেষণা করা প্রয়োজন। আমাদের মধ্যে এক ধরনের সামাজিক অসহিষ্ণুতা তৈরি হয়েছে। মানুষের মধ্যে অনেক ক্ষোভ আছে। যেটা তাকে অসহিষ্ণু করে তুলছে। এগুলো মূলত মনস্তাত্ত্বিক কারণ।"(ডয়চে ভেলে)
শিশু-কিশোর ও যুবকদের অপরাধমূলক কর্মকান্ডে এইভাবে জড়িয়ে পড়া নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। শিশু অপরাধ বিষয়ক গবেষকরা মনে করেন, অপরাধ যারা করছে, সেই শিশুদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, তাদের সামাজিক বন্ধন খুব দুর্বল এবং এই সামাজিক বন্ধনহীনতা একধরণের সমস্যা তৈরি করেছে। মা-বাবার ভালোবাসা ও যত্ন না পাওয়া, ম-বাবা ও পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছ থেকে সময় কম পাওয়া, পরিবার থেকে লালনপালনে সামাজিকীকরণের ধাপগুলো না মানা, স্কুলে যথাযথ শিক্ষা না পাওয়া এবং আদর্শিক জায়গা থেকে তাদের সামনে কোনো 'রোল মডেল' না থাকা, শিশুদের বিধ্বস্ত করে তোলে।
শিশুকে কিভাবে বড় করা হচ্ছে, তার উপর নির্ভর করে সেই শিশুর মধ্যে তার পরিবার, অন্য ব্যক্তি ও সমাজের প্রতি কতটা আকর্ষণ গড়ে উঠবে। শিশু যদি ভালবাসাহীন, ঝগড়াঝাঁটিপূর্ণ ও সন্দেহ-কোন্দলের মধ্যে বড় হয় তাহলে সেই শিশুও মায়াহীন মানুষ হবে। আপনজনের প্রতি তাদের কোন টান থাকে না। পরিবারের মানুষের সাথে যেসব শিশুর মানসিক নৈকট্য বা শারীরিক স্পর্শের কোন যোগ থাকেনা, এরাই বড় হয়ে অসুস্থ মানসিকতার মানুষ হয়। জীবনের কোন এক সংকটে এই শিশু-কিশোররাই ঘৃণা ও দূরত্বকেই বেছে নেবে নিজের আবেগজনিত কষ্ট থেকে বাঁচতে এবং হয়ে উঠবে সহিংস। এই সহিংসতা ঘটাতে পারে নিজের সাথে, পরিবারের মানুষের সাথে বা বাইরের জগতের কারো সাথে।
একটা লেখায় দেখলাম আমেরিকান লেখিকা জিন লিডলফের গবেষণামূলক বই "দি কন্টিনিউয়াম কনসেপ্ট" এর থেকে নেয়া কিছু কথা, যে কথাগুলো আমাদের জানা দরকার। "দি কন্টিনিউয়াম কনসেপ্ট" বইতে লিডলফ লিখেছেন, শিশুর জন্মের পর কয়েক বছর তার প্রয়োজন মা-বাবা বা কেয়ারগিভারের শরীরের সাথে সেঁটে থাকা। এর ফলে শিশুর সাথে কাছের মানুষগুলোর যে শারীরিক বন্ধন তৈরী হয়, সেটা তার মধ্যে এমন ব্যক্তিক ও সামাজিক নিরাপত্তাবোধ তৈরী করে যা তাকে করে তোলে মানবিক, প্রেমাকাঙ্ক্ষী এবং সমাজ ও পরিবারের প্রতি ত্যাগী। আত্মকেন্দ্রিক মনোভাব ভবিষ্যতে তাকে দমিয়ে দিতে পারে না।
একটি শিশু মায়ের শরীরের ভেতরের উষ্ণতায় ও নিরাপত্তায় বেড়ে ওঠে প্রায় বছর ধরে। জন্ম হলেই সে শীতল একাকিত্বে নির্বাসিত হয়। তখন অন্য একটি উষ্ণ দেহের স্পর্শ তাকে নিরাপত্তা দেয়, যা তার আবেগগত সংশয় দূর করে। এবং শিশু ভবিষ্যতের একটা নিরাপদ আবেগগত সম্পর্কের প্রতি উৎসাহী হতে পারে। দি কন্টিনিউয়াম কনসেপ্টে এই ধারাবাহিকতার কথাই বলা হয়েছে, যেটা একবার বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে শিশু ছিটকে পড়ে। আর একবার ছিটকে পড়লে একটা প্রজন্মই শেষ হয়ে যায়।
অনেকে মনে করেন, শিশু-কিশোরেরা মন্দ পথে চলে যায় দারিদ্রের কারণে। এটি একটি কারণ কিন্তু মূল কারণ নয়। আমরা কয়েকবছর ধরে সংবাদমাধ্যমে কিশোর দল তৈরির খবর দেখতে পারছি। এরা এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। টিনএজ বা বয়ঃসন্ধিকালের বাচ্চারা মারামারি, হৈচৈ, ঝগড়া-বিবাদ করতেই পারে কিন্তু তাই বলে খুন, ধর্ষণ, নারী পাচার, নিজেদের মধ্যে সংঘাত, বন্ধুকে মেরে ফেলা, শিক্ষককে পিটিয়ে মারা, মিথ্যা অভিযোগে জেলে পাঠানো বা কান ধরে জুতার মালা পরিয়ে হেনস্তা করা বা হত্যার আগে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়া?
শিশু-কিশোর অপরাধীদের অধিকাংশের বয়সই ১৪ থেকে ১৮ এর মধ্যে। উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানরা আছে। নিম্নবিত্ত ঘরের পড়াশোনা না জানা কিশোর-তরুণরা আছে নেতৃত্বে। বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, শিক্ষিত, স্বচ্ছল ও ধনী পরিবারের বেপরোয়া বা বখাটে সন্তানেরা চালিত হচ্ছে সমাজের বঞ্চিত পরিবারের লেখাপড়া না করা কিছু মাস্তানদের দ্বারা। অপরাধীদের তালিকায় কিশোরী-তরুণীরাও রয়েছে।
বিভিন্ন অপরাধের সাথে শিশু-কিশোরদের ক্রমবর্ধমান সংশ্লিষ্ট হওয়ার হার উদ্বেগজনকভাবে যে বেড়েছে, তা কিন্তু খুব সম্প্রতি নয়। অনেকদিন ধরেই ধীরে ধীরে বাড়ছে কিন্তু আমরা নজর দেইনি এবং এখনও দিচ্ছি না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, "এই ধরনের ঘটনা আগেও ছিল, এখনও হচ্ছে। তবে কিছুটা ধরন পাল্টে গেছে। আগে মানুষের মধ্যে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা ছিল, এখন সেটা দিন দিন কমছে। আগে পারিবারিক বিষয় ভাগাভাগির সময় পরিবারের সদস্যরা যে সহনশীলতা দেখাতেন, এখন সেটা দেখাচ্ছেন না। এগুলো কমার পেছনে কারণটা হল, এখন মানুষ অনেক বেশি ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছেন। (ডয়চে ভেলে)
যে শিশু-কিশোর অনাদরে বা অবহেলায় বড় হয়, অসুখী পরিবারে বড় হয়, বাবা-মায়ের মধ্যে বিচ্ছেদ ও মারামারি দেখে বড় হয়, তাদের মধ্যে একধরণের ক্ষোভ কাজ করে। এদেরই নামমাত্র মূল্যে অপরাধ জগতে ভিড়িয়ে নেয়া যায় এবং এরা নিজেরাই একসময় অপরাধ জগতের সাথে জড়িয়ে যায়। বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে বলে আমরা বিষয়টি আমলে নেইনা। কিন্তু এখন তো আগুনের আঁচ আপনার আমার সন্তানের গায়েও লাগছে। আমরা দেখছি, শিশুরা হত্যা ও ধর্ষণের মতো ভয়াবহ অপরাধের সাথে অত্যাধিক হারে যুক্ত হচ্ছে। মূলত পরিবারের অভাব, প্রাচুর্য, শিক্ষার অভাব, শাসনহীনতা, অভিভাবকের উদাসীনতা, মূল্যবোধের সংকট, পরিবারের ভিতরে অপরাধীর বা অপরাধের উপস্থিতি শিশুকে বিপদের মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে বন্ধুবান্ধবরাই শিশু-কিশোরদের অপরাধ জগতের দিকে টেনে নিলেও, বাবা মায়ের উদাসীনতা, গাছাড়া ভাব এবং অতিরিক্ত প্রশ্রয় দেয়ার প্রবণতা শিশুকে অপরাধী বানিয়ে ছাড়ছে। এছাড়া সমাজের মধ্যে বিরাজমান ফারাকও শিশুকে অপরাধী হতে পথ দেখায়।
সমাজের উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরাও অপরাধ জগতের সাথে ব্যাপকভাবে জড়িয়ে পড়ছে। স্বচ্ছল পরিবারের বাবামায়েরা তাদের ব্যস্ততা ও অসচেতনতার কারণে পারছেনা সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দিতে, তাদের যত্ন নিতে, তাদের কাজকর্মের প্রতি দৃষ্টি দিতে এবং পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ বজায় রাখার মত শিক্ষা দিতে।
আর ব্যক্তিগতভাবে সময় দিতে না পারার এই ব্যর্থতা ঢাকতে গিয়ে সন্তানের হাতে তুলে দেয়া হয় অপরিমিত অর্থ, প্রাচুর্য ও যা খুশি তাই করার স্বাধীনতা। যা সন্তানকে করে তোলে বেপরোয়া, দুর্বিনীত ও অপরাধী। সেইসব বখে যাওয়া শিশ-কিশোররা যেমন সহজে এই মন্দ পথে পা বাড়ায়, তেমনি দাগী অপরাধীরাও খুব সহজে তাদের ব্যবহার করার সুযোগ পায়।
এখানে অভিভাবক সন্তানকে সময় দেয়ার পরিবর্তে ফ্যাসিলিটি দেয়ার ব্যাপারে বেশি উৎসাহী থাকে, তারা মনে করে এটাই যথেষ্ট প্যারেন্টিং। আর তাই শিশু-কিশোরদের হাতে থাকা গাড়ি, মটরসাইকেল, দামী ফোন, ঘড়ি, জামা কাপড়, ক্রিকেট ব্যাট সবই ব্যবহৃত হচ্ছে অপরাধ কার্যক্রমের সাথে। পরিবার, স্কুল ও সমাজ শিশুকিশোরকে কি শেখাচ্ছে যে --- বুলি করা বা মানুষকে মন্দ কথা বলা খারাপ, মানুষের ধর্ম নিয়ে কটুক্তি করা অপরাধ, কারো গায়ের রং বা শারীরিক গঠন নিয়ে হাসাহাসি করা পাপ, কে ধনী বা কে দরিদ্র এটা নিয়ে কথা বলাটা অভব্যতা? শিশুরা বর্ণবাদী মানসিকতা নিয়ে বড় হচ্ছে।
প্যারেন্টিং কেমন হওয়া উচিৎ, সে সংক্রান্ত একটা গল্প দিয়ে লেখাটি শেষ করছি। ঢাকার একটি সরকারি স্কুলে ক্লাস সিক্সের ছাত্রী আমি। খেলার পিরিয়ডে আমরা 'খো' বলে একটি খেলা খেলছিলাম। খেলার নিয়ম অনুযায়ী দুই দলের একজন আরেকজনকে খো বলে ধাওয়া দেয়। এইভাবে ধাওয়া দিতে গিয়ে আমার হাতের আঙুল আমার ক্লাসমেটের কানের রিং-এ ঢুকে গেল এবং রিংটি কানের লতি ছিঁড়ে মাঠে পড়ে গেল। দারুণ হইচই ও উত্তেজনা হলো। আমি ভয়ে ও অপরাধবোধে কেঁদে ফেললাম। টিচাররা অবশ্য আমাকে তেমন কিছু বললেন না। কারণ স্কুলে বড় রিং পরা নিষেধ ছিল, আর আমার এই অপরাধ ইচ্ছাকৃত ছিল না।
কিন্তু আমার আব্বা-আম্মা আমার অপরাধ ক্ষমা করলেন না। তারা আমাকে আমার ক্লাসমেটের বাসায় নিয়ে গেলেন, তার ও তার পরিবারের কাছে ক্ষমা চাওয়ানোর জন্য। আমার সাথে আব্বাও ক্ষমা চাইলো অনিচ্ছাকৃত এই দুর্ঘটনার জন্য। ওর পরিবার আমাকে ভালবেসে কাছে টেনে নিয়ে আব্বাকে নিশ্চিন্ত করলেন। আমি প্যারেন্টিং বলতে এটাই বুঝি, যা আমরা হারিয়ে ফেলছি খুব দ্রুত।
- লেখক: সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন