রাজনীতি পরিশুদ্ধ করার পাশাপাশি কিশোর গ্যাং-এর দিকেও দৃষ্টি ফেরান
কিশোর গ্যাং-এর দৌরাত্ম আবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় দুর্বৃত্ত হিসেবে এদের দেখা যাচ্ছে। অন্তর্বতীকালীন সরকার আসার পর রাজধানীতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক হয়নি। যানবাহন ও জনবল সংকটে পুলিশের টহল কার্যক্রমও পুরোদমে শুরু হয়নি। থানাগুলোও ঠিকভাবে গুছিয়ে উঠতে পারেনি। এই সুযোগে অপরাধী চক্র, বিশেষ করে কিশোর অপরাধীরা নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।
এরা সংখ্যায় বেড়েছে এবং এদের হাতে প্রকাশ্যেই আগ্নেয়াস্ত্রসহ, দা-চাপাতি দেখা যাচ্ছে।
প্রথমে, ঘটনাস্থল মোহাম্মদপুরের কথা বলতে গেলেই দেখা যাবে— গত দুইমাসে খুনখারাবি, ছিনতাই ও ডাকাতি বেড়ে গেছে। অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে গেছে যে, সন্ধ্যার পর লোকসমাগম কমে গেছে। অথচ এই মোহাম্মদপুর প্রচণ্ডরকম কর্মচঞ্চল ও বড় একটি এলাকা। অসংখ্য মানুষের বসবাস এখানে। গাড়ি-রিকশা, দোকানপাট, বাজার, ফুডকার্ট মিলে রাত প্রায় ১২/১টা পর্যন্ত হইচই লেগেই থাকে। নারী-পুরুষ, শিশু দলবেঁধে রাস্তার পাশের দোকানগুলোতে বসে নিয়মিত খাওয়া-দাওয়া করেন, আড্ডা দেন।
অথচ সম্প্রতি পরপর কয়েকটি ঘটনা ঘটে গেছে এখানে। এলাকার জেনেভা ক্যাম্পে মাদক কারবারিদের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে, গোলাগুলিতে শিশুসহ তিনজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এর আগে বসিলায় একটি সুপারশপে অস্ত্রধারীদের ডাকাতির ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। একই রাতে ঢাকা উদ্যান এলাকায় 'গণছিনতাইকারী' দুই দলের মধ্যে সশস্ত্র মহড়ার ভিডিও ছড়িয়েছে। মোহাম্মদীয়া হাউজিং লিমিটেড এলাকার সড়কে কোম্পানির গাড়ি থামিয়ে ছুরি-চাপাতির মুখে ১১ লাখ টাকা ও চেক ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। এমন পরিস্থিতিতে সন্ত্রাসমুক্ত মোহাম্মদপুরের দাবিতে এলাকাবাসী প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছে।
এরকম আরো এলাকায় অপরাধ বাড়ছে। অপরাধীদের তালিকায় অসংখ্য কিশোর-তরুণ দেখা যাচ্ছে। ভিডিও ফুটেজ লক্ষ্য করলে বোঝা যায়, অপরাধীরা কম বয়সী। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশজুড়ে হঠাৎ করে অপরাধ বেড়েছে। কেন বেড়েছে, এর উত্তর এক কথায় দেওয়া যাবে না। তবে ধারণা করা যায়, বিপ্লবের পর প্রশাসনিক জটিলতা সম্পূর্ণ ম্যানেজ করা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া, বড় মাপের প্রায় সব অপরাধী মুক্তি পেয়েছে। এরা নতুন করে কিশোর-নবীনদের নিয়ে দল গোছাতে শুরু করেছে।
অন্যদিকে যারা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দেখভাল করেন, তাদের মধ্যে বিভিন্ন কারণে অস্থিরতা, পরিবর্তন, হতাশা, উদ্বেগ বাড়ছে। নিজেদের অবস্থান নিয়েই ব্যস্ত রয়েছেন তারা। বিভিন্ন পর্যায়ের প্রশাসন ঢেলে সাজানো হচ্ছে বলে এই স্তরেও কাজের গতি ধীর হয়েছে। এছাড়া পূর্ব শত্রুতা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানি করতে মামলা দায়ের, দুষ্কৃতকারীদের দ্বারা রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা ও সহিংসতার ঘটনার সংখ্যাও বেড়েছে। এগুলো সামাল দিতে ব্যস্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
কিশোর-তরুণ গ্যাং এখন হত্যা, মাদকব্যবসা, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, জমি দখল থেকে শুরু করে নারীদেরও উত্ত্যক্ত করছে। খবরে দেখলাম পরিস্থিতি সামাল দিতে কয়েক হাজার কিশোর-তরুণ অপরাধীর তালিকা হালনাগাদ করা হচ্ছে। পুলিশ ইতোমধ্যে অভিযানেও নেমেছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, গত এপ্রিলের আগে রাজধানীতে অন্তত ১২৭টি কিশোর গ্যাং সক্রিয় ছিল। সারাদেশে ছিল ২৩৭টি। এসব গ্যাংয়ের সদস্য ছিল দুই হাজারের বেশি। প্রতিটি থানায় তাদের তালিকা ছিল।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, মোহাম্মদপুরে তিন মাসে ১০ জন খুন হয়েছেন। এসব হত্যাকাণ্ডের বেশিরভাগ ঘটনায় কিশোর-তরুণ জড়িত এবং এদের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ। যৌথ বাহিনীর অভিযানে যেসব অপরাধী ধরা পড়ছে, তাদের অধিকাংশের বয়স ১৫ থেকে ২১ বছরের মধ্যে। কিশোর অপরাধীরা নতুন নয়। গত কয়েকবছর ধরেই এরা বেপরোয়া হয়ে উঠছিল। অর্থ আর ক্ষমতা পাওয়ার জন্য যেকোন ধরনের অপরাধের সাথে খুব সহজেই সম্পৃক্ত হচ্ছে। এখন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা অপরাধ জগতের নেতৃত্বে চলে আসছে।
আসলে এই অপরাধ জগতটি খুব দ্রুতই শক্তিশালী হয়ে উঠছে। গত কয়েকবছর ধরে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বখাটে কিশোর-তরুণ নিয়ে এমন চক্র গড়ে উঠেছে, যারা মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, নারীর শ্লীলতাহানি ও খুনসহ নানান অপকর্মে যুক্ত।
এসব চক্রের সদস্যদের মধ্যে বড় অংশই হচ্ছে কিশোর এবং নেতারা যুবক। এদের 'বস' বা 'বড় ভাই' বলে ডাকে চক্রের সদস্যরা। গতবছর বিভিন্ন এলাকায় কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িত কিশোর গ্যাং সদস্যদের আটকের পর তাদের কাছ থেকেই পুলিশ জেনেছে যে, কিছু অসৎ ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং স্থানীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতারা নির্মাণকাজ-সহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদা তোলার কাজে তাদের ব্যবহার করে থাকেন। তারই কিশোরদের হাতে অস্ত্র দেন ও অপরাধ করতে শেখান।
এখনতো সেই রাজনৈতিক নেতারা নেই, কিন্তু তাদের দেওয়া ট্রেনিং এখনও আছে, অস্ত্র আছে, পরিকল্পনা আছে, আছে সুযোগও। এগুলোকেই কাজে লাগাচ্ছে কিশোর গ্যাং। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর কিশোরদের অপরাধে জড়ানোর প্রবণতা কমেনি, বরং প্রকোপ ও পরিধি দুটোই বেড়েছে।
কিশোর গ্যাং এর সদস্যরা 'গডফাদার' এর পেছনে থেকে পথভ্রষ্ট হয়েছে। কিশোর গ্যাং এর সাথে জড়িত অনেকেই বলেছে, তাদের সামনে কোনো 'রোল মডেল' নেই। এই কিশোরদের জীবনের লক্ষ্য 'অপরাধ সাম্রাজ্যের বড় ভাই' হওয়া। রাজনৈতিক দলের বড় ভাইদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি কিশোরদের প্রলুব্ধ করেছে। এই বাস্তবতারই কথা বলছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম।
গণমাধ্যমকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, "কিশোররা দেখে অপরাধীরা হিরো। তারা দেখে বড়রা নানা অপরাধ করে ক্ষমতাবান হচ্ছে। ফলে তারাও সেই পথে যায়, তারাও গ্যাং গঠন করে নিজেকে ক্ষমতাবান করতে চায়, হিরো হতে চায়।"
কিশোর বলেই যে এরা ছোটখাট অপরাধ করছে, তা কিন্তু নয়। কিশোর অপরাধীরা সাধারণত মাদক বিক্রি ও সেবন, যৌন হয়রানি, চুরি, ছিনতাই, অপহরণ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মারামারি ও খুনসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
অপরাধী চক্রের নেতা বা সদস্যদের বড় অংশ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণে অনেক স্কুল-কলেজের ছাত্রও এসব চক্রে জড়িয়ে পড়ে বা পড়ছে। একটা সময় কিশোররা পাড়ায়-মহল্লায় ঝগড়া-বিবাদ, মারামারি করতো, বসে আড্ডা দিতো, বিড়ি-সিগারেট ফুকতো। কিন্তু ক্রমশ এরা গ্যাংয়ের অংশ হয়ে শক্তি প্রদর্শন, প্রতিশোধ নেওয়া বা নিজেদের গোষ্ঠীকে রক্ষা করতে চাইছে। ফলে তারা চরমভাবে সহিংস হয়ে উঠছে।
সমাজের অভিভাবক, পথ প্রদর্শক ও কাণ্ডারীরা যদি ভুল পথে যায়, তাহলে যুব সমাজ, শিশু-কিশোর সেই দিকেই যাবে এবং যাচ্ছে। এই সমাজে আমাদের, মানে অভিভাবকদের অসচেতনতা, অসততা, দ্বন্দ্ব, বিচ্ছেদ, প্রতিহিংসা, ক্ষমতা ও অর্থলোভের মত নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যগুলো আমাদের সন্তানদের ধ্বংসের পথে পরিচালিত করছে। শিশু-কিশোররা দেখছে পরিবার ও সমাজের মধ্যে চরম অব্যবস্থাপনা, মূল্যবোধের অভাব, ভালবাসাহীনতা, অসততা এবং অর্থের প্রতি মোহ। পরিবারের ভিতরে অপরাধী বা অপরাধের উপস্থিতি শিশুকে বিপদের মুখে এনে দাঁড় করায়।
আজ যা ঘটছে, আগে যা ঘটেছে— সেই ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্নভাবে ঘটলেও আমাদের ভেতর চরম শংকার সৃষ্টি করছে। শিশু থেকে তরুণ-যুবার এই আচরণ এক ধরনের অসহিষ্ণু সমাজের কথা বলছে। শিশু অপরাধ বিষয়ক গবেষকরা মনে করেন, অপরাধে জড়িয়ে পড়া শিশুদের সামাজিক বন্ধন খুব দুর্বল থাকে। এদের অনেকেই মা-বাবা ও পরিবারের ভালোবাসা, যত্ন ও মনোযোগ না পেয়ে অনাদরে অবহেলায় বড় হয়।
আবার অন্যদিকে শিশু কিশোররা যখন প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি কিছু পেয়ে যায়, যখন তাদের কাজের বা আচরণের জন্য কোথাও কোনো জবাবদিহি করতে হয়না। যখন তারা দেখে তাদের অভিভাবক অসৎ এবং অন্যায় করেও শক্তির জোরে টিকে থাকছে, তখন শিশু-কিশোররা খুব সহজেই এমন বিপদজনক পথে পা বাড়ায়।
এই সমাজ তাদের শিখিয়েছে ভিলেনরাই ক্ষমতাধর, ভিলেনরাই প্রকৃত রোল মডেল। এখানে পড়াশোনা করে, ভাল মানুষ হয়ে একজন মানুষ যা পায়, দুর্নীতি করে বা অন্যেরটা কেড়ে নিয়ে এর চাইতে অনেক বেশি পাওয়া যায় এবং আরামেও থাকা যায়। তাই হয়তো এই পথে নাম লেখাচ্ছে আমাদের শিশু-কিশোররা।
কিশোরদের অপরাধের হার বেড়েছে, চরিত্র পাল্টেছে, অপরাধের ধরনে ভয়াবহতা এসেছে, হাতে নানান ধরনের অস্ত্র এসেছে। শিশু-কিশোরদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে এভাবে জড়িয়ে পড়ার হার খুবই উদ্বেগজনক।
যেহেতু এখন দেশে রাজনীতি পরিশুদ্ধ করার কাজ চলছে, তাই আমাদের শিশু-কিশোর সন্তানদের অপরাধী ও গ্যাংস্টার হওয়ার হাত থেকে কীভাবে বাঁচানো যায়, দ্রুত সেই উপায় খোঁজা দরকার।
লেখক: যোগাযোগকর্মী ও কলামিস্ট
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।